মতামত

এমপি রুমিনের প্লট বিতর্ক

বিএনপির সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানার সরকারি প্লট চেয়ে করা আবেদনের ইস্যুতে সোশ্যাল মিডিয়া ও মূলধারার গণমাধ্যমে আলোচনা-তর্ক-বিতর্ক আর তীর্যক মন্তব্য দেখে মনে হচ্ছে, এর আগে কোনো এমপি বুঝি এই সুবিধা নেননি। অথবা এটিও মনে হতে পারে যে, সরকারি প্লট পাওয়ার অধিকার কেবল সরকারি দলের এমপিদেরই। অথবা এমনও মনে হতে পারে যে, এমপি রুমিন বোধ হয় কোনো অন্যায় আবদার করেছেন অথবা তিনি যা চেয়েছেন তা অবৈধ। এর আগে কারা কারা তথ্য গোপন করে বা মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে সরকারি প্লট নিয়েছেন,তার কি সঠিক অনুসন্ধান এবং সেই তালিকা প্রকাশ করা হবে? যদি তা না হয়, তাহলে কেন এই বিতর্ক?

Advertisement

এই কেনর উত্তর খোঁজার আগে একনজরে দেখা দরকার একজন সংসদ সদস্য কী কী সুবিধা ভোগ করেন। প্রথমত তাদের জন্য নির্ধারিত ভবনে (সংসদ ভবনের উল্টো দিকে এবং নাখালপাড়ায়) তারা একটি করে ফ্ল্যাট পান; যতদিন তারা এমপি থাকবেন, ততদিন সেখানে থাকতে পারবেন। শুল্কমুক্ত সুবিধায় ব্যক্তিগত গাড়ি অনেক কম দামে আমদানির সুবিধাও তারা পান। এর বাইরে একজন এমপি প্রতি মাসে বেতন ৫৫ হাজার টাকা; নির্বাচনী এলাকার ভাতা ১২ হাজার ৫০০ টাকা; সম্মানী ভাতা ৫ হাজার টাকা; পরিবহন ভাতা ৭০ হাজার টাকা; নির্বাচনী এলাকায় অফিস খরচ ১৫ হাজার টাকা; লন্ড্রি ভাতা দেড় হাজার টাকা; মাসিক ক্রোকারিজ, টয়লেট্রিজ কেনার জন্য ৬ হাজার টাকা; টেলিফোন ভাতা ৭ হাজার ৮০০ টাকা; দেশের অভ্যন্তরে বার্ষিক ভ্রমণ খরচ বাবদ এক লাখ ২০ হাজার টাকা; স্বেচ্ছাধীন তহবিল বার্ষিক পাঁচ লাখ টাকা বরাদ্দ পান। এছাড়া ২০১৫ -২০১৯ সাল পর্যন্ত একজন সংসদ সদস্য প্রতি বছর চার কোটি টাকা করে থোক বরাদ্দ পান।

দেখা যাচ্ছে বৈধ পথেই একজন সংসদ সদস্য সরকারি ফ্ল্যাট ও গাড়ির বাইরেও প্রচুর সুবিধা পাচ্ছেন। যে কারণে এমপি হওয়ার জন্য মানুষের এত চেষ্টা-তদবির। উন্নত বিশ্বের এমপিরাও সরকারিভাবে এত সুবিধা পান কি না, তা নিয়ে গবেষণা হতে পারে। আবার এমপিরা আইনত আইনপ্রণেতা হলেও স্থানীয় কোনো উন্নয়ন কাজ তাকে বাদ দিয়ে হয় না।

সুতরাং সেখান থেকেও একটা ‘পার্সেন্টিজ’ যে তারা পান, সেটি ওপেন সিক্রেট। এর বাইরে এমপির পরিচয় কাজে লাগিয়ে নিজের ও আত্মীয়-স্বজনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে বৈধ-অবৈধ নানা সুযোগ; সরকারি বিভিন্ন চাকরির তদবিরসহ নানা খাত থেকেও তাদের আয় হয়। যদিও এসব আয় হিসাবের খাতায় যুক্ত হয় না। বৈধ সুবিধার বাইরে এসব হিডেন সুবিধা গ্রহণ করেন না, এমন এমপির সংখ্যা কত—সেটি জানা খুবই কঠিন।

Advertisement

রাজনীতির মাঠ এবং আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় সরকারি ও বিরোধী দলীয় এমপিদের মধ্যে বিরোধ ও মতভিন্নতা থাকলেও নিজেদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর ক্ষেত্রে তারা একাট্টা। কেননা সরকারি-বেসরকারি সব এমপির সুবিধাই সমান। এমনকি সরাসরি নির্বাচিত এবং সংরক্ষিত আসনের এমপির প্রায়োগিক ক্ষমতায় তফাৎ থাকলেও সুযোগ-সুবিধা যেমন প্লট, ফ্ল্যাট, শুল্কমুক্ত গাড়ি, সংসদ চলাকালীন সংসদ এলাকা থেকে স্পিকারের অনুমতি ব্যতিরেকে তাকে গ্রেপ্তার করতে না পারাসহ অন্যান্য প্রিভিলেজ বা বিশেষ অধিকার সবই অভিন্ন।

সংসদে উত্থাপিত সব বিলেই বিরোধী দলের এমপিরা সংশোধনী দেন বা বিল পাসের বিরোধিতা করেন। কিন্তু নিজেদের সুযোগ-সুবিধা ও বেতন-ভাতা বাড়ানোর জন্য আইন সংশোধনের প্রশ্নে কখনো বিরোধিতা হয়েছে বলে মনে হয় না। বরং ২০১৬ সালের মে মাসে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সংসদে মেম্বারস অব পার্লামেন্ট (রেমুনারেশন অ্যান্ড অ্যালাউন্সেস) (অ্যামেন্ডমেন্ট) বিল-২০১৬ উত্থাপন করলে তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সদস্যরা বেতন-ভাতা আরও বাড়ানোর দাবি জানিয়েছিলেন। জবাবে আইনমন্ত্রী তখন বলেছেন, ‘আমরা নিজেরাই নিজেদেরটা বাড়াচ্ছি। বিবেচকের মত বাড়াতে হবে।’

২.এখন প্রশ্ন হলো,গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে ১০ কাঠার একটি সরকারি প্লট চেয়ে একাদশ সংসদে সবশেষ যোগদানকারী বিএনপির সংসদ সদস্য (সংরক্ষিত আসন) রুমিন ফারহানার চিঠি নিয়ে কেন বিতর্ক তৈরি হলো? সরকারি প্লট তো এর আগেও এমপিরা নিয়েছেন। তাহলে রুমিনের বিষয়টি কেন সামনে এলো? এর কয়েকটি কারণ থাকতে পারে।

ক. এর আগে প্লট চেয়ে করা এরকম চিঠি কখনো সোশ্যাল মিডিয়া বা মূলধারার গণমাধ্যমে আসেনি বা আনা হয়নি।

Advertisement

খ. রুমিন ফারহানা এবং তার দলের নেতারা শুরু থেকেই এই সংসদকে অবৈধ এবং বর্তমান সরকার জোর করে ক্ষমতায় আছে বলে অভিযোগ করছেন। ফলে অবৈধ সংসদ ও তাদের ভাষায় জোর করে ক্ষমতায় থাকা সরকারের কাছে রুমিন ফারহানা কেন প্লট চেয়ে আবেদন করলেন?

গ.টেলিভিশনের টকশোতে বিএনপির যেসব নেতা কড়া ভাষায় সরকারের সমালোচনা করেন, রুমিন ফারহানা তাদের অন্যতম। এমনকি সংসদে যোগ দেয়ার প্রথম দিনেই একাদশ সংসদকে অবৈধ বলে বক্তব্য দিয়ে তিনি আলোচনায় আসেন। ফলে এই সরকারের কাছেই প্লট চেয়ে তার আবেদনের খুব বেশি সংবাদমূল্য না থাকলেও মুখরোচক আলোচনার জন্য যথেষ্ট।

ঘ. ভাষা সৈনিক অলি আহাদের মেয়ে রুমিন ফারহানা রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছেন বছর কয়েক হলো। পরে তিনি বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক হন। কিন্তু হঠাৎ করেই রাজনীতিতে এসে সংসদ সদস্য হওয়ায় দলের ভেতরেই তার প্রতিদ্বন্দ্বী তৈরি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। ফলে প্লট বিতর্কে তার দলের লোকজনের উসকানিও থাকতে পারে।

ঙ. রুমিনের প্লট চেয়ে আবেদনটি নিয়ে বিতর্কের আরেকটি কারণ তিনি চিঠিতে ভুল তথ্য দিয়েছেন। কেননা নির্বাচনি হলফনামায় তিনি উল্লেখ করেছেন রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে তার ১৮৫০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট আছে, যেটি তার মা তাকে দিয়েছেন। কিন্তু পূর্ত মন্ত্রণালয়ে সরকারি প্লট চেয়ে করা আবেদনে লিখেছেন, ঢাকায় তার নিজের প্লট বা ফ্ল্যাট নেই। গণমাধ্যমের খবর বলছে, ফ্ল্যাট তো বটেই, রাজধানীর লালমাটিয়ায় তার প্লটও আছে। তার মানে তিনি প্লটের আবেদনে মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন।

এখন অনেকে হয়তো বলবেন, এর চেয়ে অনেক বেশি মিথ্যার আশ্রয় জনপ্রতিনিধি ও রাজনীতিবিদরা নিয়ে থাকেন। কিন্তু রুমিন ফারহানা যেহেতু ‘ভোকাল’ এবং গণমাধ্যমের টকশো ও লেখালেখিতে নীতিকথা বলেন, সুতরাং একটি সরকারি প্লট পাওয়ার জন্য তিনি মিথ্যার আশ্রয় নেবেন, তা দেশের মানুষ প্রত্যাশা করে না। তার প্লট চেয়ে আবেদনের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা ও বিতর্কের বোধ হয় এটিও কারণ।

লেখক : বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর।

এইচআর/পিআর