মতামত

মধ্যরাতের তিন রক্তাক্ত তরুণ এবং প্রবাসী নিরাপত্তা

ব্রিটিশ-বাংলাদেশী তিন তরুণ বাংলাদেশে বেড়াতে গিয়েছিলেন এই গ্রীষ্মের ছুটিতে। ব্রিটেনের বার্মিংহামে তাদের আবাস। বাপ কিংবা চাচারা তাদেরকে উৎসাহিত করেছেন, দেশ আর সমাজ নিয়ে একটা সুন্দর ছবি হয়তো উপস্থাপন করেছেন তাদের সামনে। যা তাদেরকে দেশমুখি করেছিল। এক স্বপ্নের হাতছানি ছিল ঐ তরুণদের সামনে। বাপ-মা’রা বলেছেন, এ এক নিটোল সবুজে ঘেরা দেশ, যেখানে অতিথিদের বরণ করে নেয়া হয়, সিলেট তথা বাংলাদেশ প্রবাসী বিশেষত যে কোন বিদেশীদের সবাইকে স্বাগত জানায়।

Advertisement

অভিভাবকদের উৎসাহে তারা উজ্জীবিত হয়েছে, পিতৃভূমি তাদেরকে টেনেছে। তাইতো সামার ব্রেকের পাশাপাশি ভিন্ন আমেজের ঈদ আনন্দ কাটাতে তারা গিয়েছিল সিলেটে। কিন্তু যে আকাঙ্খা আর উচ্ছ্বাস নিয়ে সিলেটের বালুচর এলাকায় আনন্দময় সময় কাটানোর কথা, সেখানে দুঃস্বপ্ন সঙ্গী হয়েছে তাদের। হাসান-ইমন-নাহিয়ান নামের ২৪ বছরের একজন আর ১৮ বছরের দুজনের (তারা একে অপরের চাচাত ভাই) উপর আক্রমণ করেছে সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠনের কর্মীরা। ৬ আগস্ট মধ্যরাতে তারা খেতে গিয়েছিল, শহরের একটা রেস্টুরেন্টে, সেখানেই তারা রক্তাক্ত হয়। প্রত্যক্ষদর্শী এমনকি পুলিশ পর্যন্ত বলছে, তারা খাবার খেয়ে যখন বেরিয়ে আসছিল রেস্টুরেন্ট থেকে, গেটে দাঁড়িয়ে থাকা তখন কয়েকজন তরুণ তাদের কটূক্তি করে। এই কটূক্তির প্রতিবাদ করলে ওদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ঐ তরুণরা। হামলার শিকার হতে হয় তাদের। শুধু তাই না, হামলায় তারা যখন রক্তাক্ত, তখন তাদের বহন করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া গাড়িটিও ভাংচুর করে তারা। হামলাকারী তরুণেরা এই পাড়ায় পরিচিত। এবং ছাত্রলীগ ক্যাডার হিসেবেই তাদের পরিচিতি। তারা স্বেচ্ছাসেবক লীগ জেলা ইউনিটের এক সহসভাপতি’র অনুগত বলে সংবাদ চাউর হয়েছে সিলেটের পত্র-পত্রিকায়। এর সত্যতা পাওয়া যায়, যখন ঐ নেতা গণমাধ্যমে বলেন, প্রবাসী তিন তরুণ তাঁর কর্মীদের মারধর করলে তাঁর দুজন কর্মী আহত হয়।

২৪ এবং ১৮ বছরের তিনজন প্রবাসী তরুণ মধ্যরাতে সিলেট শহরের একদল রাগী তরুণদের সাথে বাকবিতন্ডায় যাবেই বা কেন। এ সাহসটুকু তাদের না থাকারই কথা। তাছাড়া অহেতুক তারা ঝগড়ায় জড়াবেই কেন? পুলিশ এবং প্রত্যক্ষদর্শীর তথ্য অনুযায়ী ছাত্রলীগের ক্যাডাররাই তাদের আক্রমণ করেছে। প্রশ্ন আসতেই পারে, এরা আক্রমণ করবেই বা কেন।

এমনিতেই পাড়ায় পাড়ায় যে ‘সন্ত্রাস সংস্কৃতি’ গড়ে উঠেছে, তাতে অপরিচিতদের দেখলেই এলাকার স্থায়ী সন্ত্রাসী গ্রুপ সন্দেহ করে। অন্যদিকে প্রবাসী জানার পরও বিশেষত কিশোর-তরুণদের নিয়ে কেউ কেউ নিছক তামাশা কিংবা কটূক্তি করে, অপমান করে। এটা পাড়ার মাস্তানদের একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। বার্মিংহাম থেকে সিলেটে যাওয়া এই তিন তরুণ সম্ভবত এই কটূক্তি কিংবা তামাশার শিকার হল, রক্তাক্ত হল।

Advertisement

এ নিয়ে ব্রিটেনে জোর আলোচনা চলছে। এটা একটা স্বাভাবিক ব্যাপারও। কারণ বাংলাদেশে গিয়ে যদি সরকার দলীয় ক্যাডারদের তামাশার কাছে ব্রিটেনে বেড়ে উঠা তরুণরা অসহায় হয়ে পড়ে, রক্তাক্ত হয়ে দুঃস্বপ্ন সাথে নিয়ে ফিরে আসতে হয়, তাহলে দেশের প্রতি আস্থার জায়গাটা ক্রমেই প্রশ্নবিদ্ধ হতে থাকে। আর সেজন্যই প্রতিবাদ করা কিংবা সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে জানানো ব্রিটেনের বাংলাদেশী কমিউনিটির দায়িত্বের মাঝেই পড়ে। এবং যারা ব্রিটেনে বাংলাদেশী রাজনীতি করেন, দেশের মন্ত্রী-এমপি-আমলাদের সাথে উঠতে-বসতে পছন্দ করেন, তাদের কাছে এ কমিউনিটির মানুষের একটা প্রত্যাশা থাকে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশী রাজনীতির ব্রিটেনবাসী এই ‘মহান’ মানুষগুলো এর ধারে-কাছে যায়নি, এমনকি উল্লেখ করার মত কোন প্রতিবাদও করেনি। অথচ তাদের প্রতিবাদটা আরও সরকার-স্পর্শী হতে পারতো। এবং তাদের উদ্যোগ থাকলে সরকারের প্রতি প্রবাসীদের আস্থার জায়গাটুকু সুসংহত হতে পারতো।

এই তরুণদের হামলার প্রতিক্রিয়ায় যা কিছুই হয়েছে, ব্রিটেনে হয়েছে এখানকার বাংলাদেশীদের দ্বারা পরিচালিত সামাজিক সংগঠনগুলোর মাধ্যমে। অন্যদিকে একটা বড় ভূমিকা রেখেছে বিশ্বব্যাপী ব্যবহার হওয়া ফেসবুক কিংবা ডিজিটাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। তিন তরুণের রক্তাক্ত ছবি ভাইরাল হয়েছে। বিশেষত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা প্রবাসীরা এ চিত্রটি ভাইরাল করেছেন। প্রবাসী যারা, এমনিতেই তাদের অভিযোগ-অনুযোগ আছে প্রচুর।

এক কোটিরও অধিক প্রবাসীদের নিয়ে যখন সরকারের কর্তা ব্যক্তিবর্গ কোন মঞ্চে কথা বলেন, প্রায়ই অত্যন্ত আহ্লাদের সাথে প্রবাসীদের অবদানের কথা বক্তৃতায় তুলে ধরেন। স্বাভাবিকভাবে যখন বক্তারা তাদের ঐ প্রবাসীদের নিয়ে বাণী দেন, তখন হাসি পায়। কারণ তাদের আলাপ কিংবা বক্তৃতায় মনে হয় তারা ঐ প্রবাসীদের পক্ষে কিছু কথা বলে তাদের করুণা করছেন। অথচ প্রবাসীরা তাদের যোগ্যতা দিয়েই নিজেদের অবস্থান সুসংহত করে পৃথিবীর দেশে দেশে।

বাংলাদেশের ষোল কোটি মানুষের মাঝে সবাই যেমন রাজনীতির হোমড়া-চোমড়া নন, কিংবা সব মানুষই ব্যবসায়ী হতে পারে না, কিংবা শিক্ষক-ডাক্তার-প্রকৌশলী-সাংবাদিক-উকিল-আমলা রাষ্ট্রের কয়েকটি উইং কিংবা অংশ মাত্র। লাখো-কোটি মানুষ ভিন্ন ভিন্ন শ্রমের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের অর্থনীতি কিংবা রাষ্ট্রীয় ভিত যেমন মজবুত হয়, সেভাবেই প্রবাসী কিংবা অভিবাসীরা পৃথিবীর দেশে দেশে ব্যবসা কিংবা উচ্চ পর্যায়ের চাকুরির পাশাপাশি ভিন্ন ধরনের শ্রম দিয়েই অর্থ উপার্জন করছে। তাঁরা তাদের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা বাংলাদেশে পাঠিয়ে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে একটা ব্যাপক ভূমিকা পালন করছে। সুতরাং প্রবাসীদের প্রতি করুণার চাহনি দিয়ে আহ্লাদি আলাপটা প্রবাসীদের প্রতি ব্যঙ্গ করা ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না।

Advertisement

শুধু দলীয় দাস ছাড়া প্রবাসেও এরকম আলাপচারিতাকে আর কেউ একটা গুরুত্বের সাথে নেয় না। নেবেই বা কেন, তিন তরুণের রক্তাক্ত হবার পর দল-ভক্তদের ভাবলেশহীন নির্বিকার থাকায় তা আবারও প্রমাণিত হল এই ব্রিটেনে। অথচ এই এরাই তাদের কোন ছোটখাট প্রভাবশালী নেতার বিয়ে-বার্ষিকী, ভাই-বোন-পিতা-মাতার জন্ম দিন-মৃত্যুদিন মনে রাখে... অন্তত তারা ফেসবুক উষ্ণ রাখে।

আশার কথা হল,হামলায় জড়িত অভিযোগে ৬ জনকে পুলিশ আটক করেছে। স্থানীয় প্রশাসন এ উদ্যোগটি নিয়ে সন্দেহ নেই একটা উদাহরণ সৃষ্টি করতে পেরেছে। কিন্তু এই আটকের আগের রাজনৈতিক কথা-বার্তাগুলোকে যদি আমরা আমলে নেই, তাহলে দেখি ভিন্ন চিত্র। এই হামলা কিংবা তার পরবর্তী পরিস্থিতি বাছ-বিচার না করে মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি যখন বলে দিলেন, তার কর্মীদের কোনই অপরাধ নেই। তিনি এখানে উপস্থিত না থেকে ঢালাও মন্তব্যটা করে সন্ত্রাসীদের পক্ষে তাঁর অবস্থানটা সরাসরি পরিষ্কার করলেন। এ-ও প্রমাণ করলেন, তিনি অপরাধীদের অপকর্মকেই সমর্থন করছেন। রাজনীতির প্রভাব এভাবেই প্রতিনিয়ত সন্ত্রাসীদের আসকারা দেয়।

ইয়াবা ব্যবসায়ীতে সয়লাব হয়ে গেছে দেশ। এই ব্যবসায়ীরা একদিনে জন্ম নেয়নি। এরা কোন না কোনভাবেই কোন নেতার রাজনৈতিক ছায়ায় বেড়ে উঠছে কিংবা উঠেছে। প্রতিদিন ক্রস ফায়ার হচ্ছে। সত্যি কথা হল, ক্রসফায়ারে প্রায়ই মারা পড়ছে এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী কিংবা মাদক সম্রাটেরা। এ নিয়ে আইনী কথাবার্তা উচ্চারিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত, কিন্তু দুএকটা ঘটনা ছাড়া প্রত্যেকটি ক্রসফায়ারে নিহতদের পক্ষে খুব একটা কথা বলছে না কেউই।

রাজনীতির মাধ্যমেই জনগণের পাশে যান নেতারা কিংবা রাজনৈতিক কর্মীরা। অতএব রাজনীতি মানুষের কল্যাণেই হওয়ার কথা। এটা যে হচ্ছে না, তা আমরা কোনভাবেই বলতে পারি না। বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী প্রবাসীদের নিয়ে কথা বলেন প্রায়ই, তিনি স্বপ্ন দেখান। প্রবাসী বিশেষত ব্রিটেন প্রবাসীদের নিয়ে তাঁর কথাগুলোতে মূলত করুণা থাকে না, থাকে কৃতজ্ঞতার উচ্চারণ।

সম্ভবত প্রধানমন্ত্রীই এই সরকারের একজন ব্যতিক্রমী মানুষ, যিনি ব্রিটেনের বাংলাদেশীদের নিয়ে ভাবেন, ভাবেন সারা পৃথিবীর প্রবাসীদের নিয়ে। তাঁর পথ ধরেই তাঁর দলের নেতারা অকৃত্রিম কথাগুলো বলবেন এই আশাটাই করে প্রবাসের মানুষগুলো। তিন তরুণের এমন রক্তাক্ত চিত্র দেশের আর কোথাও যেন প্রতিবিম্বিত না হতে পারে, সেজন্যই মধ্যরাতের সেই সন্ত্রাসীদের শাস্তি নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। রাজনীতির প্রভাবশালীরা যদি একটু দূরে থাকে, তাহলে এই রক্তাক্ত অধ্যায়ের বিচার নিশ্চিত হবে, এ আশা আমরা করতেই পারি।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।

এইচআর/এমএস