দেশজুড়ে

সেই রোহিঙ্গা এই রোহিঙ্গা

নিজ দেশ মিয়ানমারে নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় নেয়ার দুই বছর পূর্ণ হলো আজ। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট স্থল ও জল সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে শুরু করে রোহিঙ্গারা।

Advertisement

সেদিন চরম অসহায়ত্ব নিয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা বর্ণনাতীত মানবিক সহায়তা পেয়েছিল। স্থানীয় পর্যায়ে শুরু হওয়া সেই সহযোগিতা এখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গিয়ে পাল্টে গেছে রোহিঙ্গাদের অসহায়ত্বের চিত্র

বাংলাদেশ সরকারের আন্তরিকতায় দেশি-বিদেশি নানা সংস্থার অর্থায়নে রাখাইনের দুর্বিসহ জীবন-যন্ত্রণা অনেকটা ভুলে গেছে রোহিঙ্গারা। নিজেদের দেশের চেয়ে বেশি স্বাধীনতা নিয়ে তারা আশ্রিত দেশে অবাধে বিচরণ করছে। কিন্তু সেই মানবিক সহায়তার বদলে চরম উগ্রতার বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে রোহিঙ্গারা।

টেকনাফ-উখিয়ার বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে বেশ কয়েকটি অপরাধী দল গঠন করে ক্যাম্পের অভ্যন্তরে অপরিকল্পিতভাবে দোকানপাট ও মাদক বিক্রির আখড়া তৈরি, মানবপাচার, অপহরণের পর মুক্তিপণ আদায়, ডাকাতি ও মাদকের টাকায় আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহসহ নানা অপরাধ কর্ম করছে তারা। আক্রমণ করে স্থানীয়দেরও হত্যা করছে রোহিঙ্গারা। গত বৃহস্পতিবার রাতেই টেকনাফের হ্নীলা জাদিমুরা এলাকায় স্থানীয় ওয়ার্ড যুবলীগ সভাপতি ওমর ফারুককে গুলি করে হত্যা করেছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা।

Advertisement

পুলিশের দেয়া তথ্য মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ বিরোধ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে প্রায় ৪৫ জন রোহিঙ্গা। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ৮ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৬ জন, মার্চে ১০ জন, এপ্রিলে ৪ জন, মে মাসে ৫ জন, জুনে ৭ জন, জুলাইয়ে একজন ও ২৪ আগস্ট পর্যন্ত ৫ রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে।

পুলিশের ভাষ্য, ৪৫ জন রোহিঙ্গার মধ্যে পুলিশ ও বিজিবির সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে ৩২ জন। নিহতদের অধিকাংশ ইয়াবা কারবারি, মানব পাচারকারী ও সশস্ত্র ডাকাত।

কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী খোকা বলেন, মানবিক আশ্রয়কে রোহিঙ্গারা অপব্যবহার করছে। সরকারের সামগ্রিক সহযোগিতা পেয়েও নানা অপরাধে জড়াচ্ছে তারা। রোহিঙ্গারা আমাদের জন্য ‘বিষফোড়া’ হয়ে উঠছে। তাদের প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করা না গেলে পরিস্থিতি আরও জটিল হবে।

এদিকে আশ্রিত জীবনে নিজ দেশ মিয়ানমারের চেয়ে শতগুণ বেশি স্বাধীনভাবে চলাফেরা ও সামগ্রিক সুযোগ-সুবিধা পাওয়ায় দেশে ফিরতে নানা তালবাহানা করছে রোহিঙ্গারা। তারা আগে মিয়ানমারে কোনো ধরনের সুযোগ-সুবিধা না পেলেও এখন জীবন ধারণের নানা অনুসঙ্গ দিতে রাজি হয়েছে দেশটি। তারপরও নিজ দেশে ফিরতে চাচ্ছে না রোহিঙ্গারা। নাগরিকত্বসহ নানা দাবির দোহাই দিয়ে তারা পরপর দুইবার প্রত্যাবাসনের সিদ্ধান্ত ভেস্তে দিয়েছে।

Advertisement

এদিকে রোহিঙ্গাদের প্রথম আশ্রয় দেয়া স্থানীয়রা জানিয়েছেন, গত দুই বছর আগে আসা অসহায় রোহিঙ্গা নেই তারা। আচার-আচরণ পাল্টে তারা ক্রমে উগ্র হয়ে উঠছে। কথায় কথায় স্থানীয়দের সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদে জড়াচ্ছে, বুক কাঁপছে না খুন করতেও। তাদের বীরদর্পে ঘুরে বেড়ানো দেখলে আশ্রিত বলে মনেই হয় না।

অনিশ্চয়তার মাঝে দেশ ছাড়া রোহিঙ্গারা ভিন দেশের মাটিতে ঘর করে থাকার সুযোগ পেয়েছে। জীবন ধারণের নানা অনুসঙ্গ নিয়ে সেই ঘরেই তাদের দুই বছর পূর্ণ হলো আজ। দুই বছরে দুই বার প্রত্যাবাসনের দিনক্ষণ ঠিক হলেও প্রত্যাবাসন নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। কিছু কিছু এনজিও এবং মিয়ানমার সরকারের ‘চর’ হয়ে কাজ করা কিছু রোহিঙ্গার অপচেষ্টায় প্রত্যাবাসন বার বার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ উঠছে। এদেরই শেখানো বুলিতে সাধারণ রোহিঙ্গারা বলছেন, নিরাপদ আশ্রয়, নিজের ভিটেসহ সম্পদ, নাগরিকত্ব এবং নিপীড়নের বিচার নিশ্চিতসহ নানা দাবি পূর্ণ না হলে তারা ফিরে যাবে না।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইনে নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার অভিযোগে রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন শুরু হয়। ঘরবাড়ি জ্বালানো, ধর্ষণ, হত্যাসহ নানা সহিংসতায় প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে রোহিঙ্গারা। এ সময় প্রায় সাড়ে ৭ লাখ রোহিঙ্গা আসে বাংলাদেশে। এরাসহ পূর্বে আসা রোহিঙ্গা মিলিয়ে নিবন্ধনের আওতায় এসেছে ১১ লাখ ১৮ হাজার ৪১৭ জন। এরা উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থান করছে।

গত দুই বছরে বিশ্বের নানা সরকার প্রধান থেকে শুরু করে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, মিয়ানমারের প্রতিনিধি দল, আসিয়ান, ওআইসি এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধি দল একাধিকবার রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেছেন। একইভাবে পরিদর্শনে আসেন জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস এবং বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম। সর্বশেষ পরিদর্শনে আসেন মিয়ানমার সরকার কর্তৃক গঠিত স্বাধীন তদন্ত কমিশন। কিন্তু বিশ্ব নেতাদের এত পরিদর্শনের পরও রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন এখনও আলোর মুখ দেখেনি

শনিবার (২৪ আগস্ট) দুপুরে বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা আমির হামজা (৪৮) বলেন, বাপ-দাদার দেশ মিয়ানমার। সেখানেই জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। কিন্তু লজ্জাজনকভাবে আমরা বিতাড়িত হয়েছি। তাই নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা ও স্বাধীনভাবে চলাফেরার সুযোগ নিশ্চিত না হলে মিয়ানমারে ফিরে গিয়ে কী করব? এর চেয়ে এখানে (বাংলাদেশে) মরে যাওয়াই ভালো।

কুতুপালং ৪ নম্বর ক্যাম্পের সালামত খান (২৮) বলেন, রেডিওসহ নানা খবরে শুনি আমাদের মিয়ানমার ফিরিয়ে নেবে। আমরাও চাই নিজ দেশে ফিরে যেতে। কিন্তু কেন তা বিলম্ব হয়, এর সঠিক উত্তর কেউ দিতে পারে না।

কুতুপালং ক্যাম্পের এ-২ ব্লকের রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ ইব্রাহিম বলেন, বলতে গেলে মিয়ানমারের চেয়ে আমরা এখানে ভালো আছি। সামরিকজান্তাদের (মিয়ানমারের) কথায় বিশ্বাস নেই। আন্তর্জাতিক মহলের চাপে পড়ে তারা আমাদের ফিরিয়ে নেয়ার কথা বললেও সেখানে নিয়ে ভিন্ন আচরণ করবে। নাগরিকত্ব না দিয়ে উল্টো ক্যাম্পেই বন্দি জীবন কাটাতে বাধ্য করাবে তারা।

কুতুপালং তিন নম্বর ক্যাম্পের মাবিয়া খাতুন (৬৫) বলেন, কয়েক প্রজন্ম পার করেছি রাখাইনে। কিন্তু ২০১৭ সালের মতো ভয়াবহতার মুখোমুখি হয়নি। যে স্মৃতি নিয়ে এসেছি, বাকি সময়টা এই ঝুপড়ি ঘরে (বাংলাদেশে) কাটিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। নাগরিকত্ব ও নিরাপদ পরিবেশ পেলে ফিরেও যেতে চাই। কারণ স্বামী ও স্বজনদের কবরের পাশে শেষ যাত্রাটা পাব।

কক্সবাজারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. আবুল কালাম বলেন, আমরা মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছিলাম। এখন প্রত্যাবাসনের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। তাদের জোর করে ফেরাতে চাচ্ছি না বলেই প্রত্যাবাসনে দেয়া দুই বারের সময় ভেস্তে গেছে। এরপরও রোহিঙ্গাদের কাছে মিয়ানমারের দেয়া ঘোষণা তুলে ধরে তাদের সঙ্গে মতবিনিময় চালিয়ে যাচ্ছি। হয়তো একদিন রোহিঙ্গারা বিষয়টি বুঝে স্বেচ্ছায় চলে যাবে।

আরএআর/এমএসএইচ