খোলা আকাশের নিচে কাঠের তৈরি একটি খুপরিতে প্ল্যাস্টিকের চেয়ারে বসে আছেন জোসে অ্যান্তনিও। অবৈধ উপায়ে সোনার খনিতে কাজ পরিচালনার জন্য এটিই তার প্রধান কার্যালয়। জোসে অ্যান্তনিওর এই খুপরির অবস্থান ব্রাজিলের আমাজন অঞ্চলের প্যারা স্টেটের ট্যাপাজোস নদীর কিনারে। সেখানে আরও শত শত খুপরি রয়েছে।
Advertisement
বাইরে বিশাল আকারের কয়লার স্তূপের পাশে পার্ক করে রাখা হয়েছে একটি হাইড্রলিক খনন মেশিন। আমাজনের গভীর জঙ্গলে শত শত বাদামি রঙের মেশিন রয়েছে। এই মেশিনটির কিছু যন্ত্রাংশ প্রয়োজন। এ যন্ত্রাংশ আনা হবে কুঁড়েঘর থেকে নদী পেরিয়ে একটি আদিবাসী গ্রামের ভেতর দিয়ে মোটরসাইকেলে ১০ মিনিটের দূরত্ব অবস্থিত গোপন একটি আস্তানা থেকে। সেগুলো আনার পর অল্প কিছু সময়ের মধ্যে খননকাজের জন্য নিয়ে যাওয়া হবে এ মেশিন।
ব্রাজিল সরকারের নিষ্ক্রিয় আইন ও দুর্বল প্রয়োগ, আন্তর্জাতিক বাজারে চড়া মূল্যের গুঞ্জনে পৃথিবীর ফুসফুস খ্যাত আমাজনে এখন অবৈধ উপায়ে নজিরবিহীনভাবে সোনার খনির খোঁজ করছে স্থানীয় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ।
হাজার হাজার অবৈধ খনির সন্ধানকারীরা সোনার খোঁজে খননকাজ পরিচালনা করছেন। এ জন্য তারা আমাজনের গাছ কাটছেন ও নদী দূষণ এবং আদিবাসীদের জমি দখল করছেন। ব্রাজিলের ডানপন্থী প্রেসিডেন্ট জাইর বোলসোনারো সরকারের সঙ্গে শিল্প কারখানা ও সোনার খনির সন্ধানকারীদের মিত্র সম্পর্ক রয়েছে। তিনি খনি খনন ও খনিজ পদার্থ সমৃদ্ধ আদিবাসীদের ভূমি আইনের মাধ্যমে উন্মুক্ত করে দেয়ার অঙ্গীকার করেছেন।
Advertisement
প্রেসিডেন্ট বোলসোনারো প্রত্যেক সপ্তাহে ফেসবুক লাইভে এসে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেন। সম্প্রতি এক লাইভে তিনি বলেন, ‘আমি যতদূর উদ্বিগ্ন, তাতে যদি একজন আদিবাসী (ব্যক্তি) তার নিজের ভূমি থেকে খনিজ পদার্থ উত্তোলন করতে চান, তাহলে তিনি তা পারবেন।’
আমাজনের ভূতত্ত্ব ও পরিবেশ নিয়ে কাজ করে দেশটির সংস্থা আমাজন জিও রেফারেন্সড সোসিও-এনভায়রনমেন্টাল ইনফরমেশন নেটওয়ার্ক। সংস্থাটি বলছে, ব্রাজিল ভূখণ্ডে থাকা চিরহরিৎ এই বনাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে সাড়ে চারশ’র বেশি অবৈধ খনি খনন স্থাপনা রয়েছে। এর মধ্যে শুধু আদিবাসীদের ভূমিতেই রয়েছে কয়েক ডজন।
সংকটের প্রাণকেন্দ্র
আজ, ট্যাপাজোস নদীর অববাহিকাই খনি খনন সংকটের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। হালকা একটি বিমানে করে আমাজনের ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা দেখা সম্ভব হয়েছে। বন সাবাড় হচ্ছে এবং নদীর তীর উপচে বাদামি রঙয়ের কাদার স্তূপ জমছে।
Advertisement
এ ধরনের কিছু কাজ এই অঞ্চলে আবার বৈধও। প্রত্যেক বছর, এখানে অন্তত ৩০ টন স্বর্ণ অবৈধভাবে কেনাবেচা হয়। গত এপ্রিলে ব্রাজিলের জাতীয় খনি সংস্থা দেশটির কংগ্রেসের কাছে একটি প্রতিবেদন হস্তান্তর করে। এই প্রতিবেদনে বলা হয়, বৈধ উপায়ে আমাজনের জঙ্গলে প্রত্যেক বছর যে পরিমাণ সোনা বেচাকেনা হয়, তার চেয়ে ছয়গুণ (এক দশমিক এক বিলিয়ন ডলার) বেশি হয় অবৈধভাবে।
অবৈধ এই খনি শ্রমিকদের অধিকাংশ দরিদ্র শ্রেণির, যাদের কোনো শিক্ষা নেই। তবে তারা স্বপ্ন দেখেন হঠাৎ ধনবান হয়ে যাবেন। তাদের মধ্যে নিরক্ষতার হার সর্বোচ্চ।
আমাজনের ছোট্ট শহর ক্রিপুরিজাও। এখান থেকে প্রত্যেক দিন কয়েক ডজন ছোট বিমানে করে খনন মেশিনের যন্ত্রাংশ, জ্বালানি ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নিয়ে যাওয়া হয় গভীর জঙ্গলে। বিমানের আসনের জন্য অপেক্ষমান বেশ কয়েকজন খনি শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলেছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা।
তারা বলেছেন তাদের সহজ-সরল ও স্বাভাবিক জীবন যাপনের কথা। যেখানে প্রচুর পরিমাণে উপার্জন করা যায়। পরে তারা এই অর্থ মদ্যপান এবং পতিতালয়ে গিয়ে শেষ করেন। ৩৭ বছর বয়সী খনি শ্রমিক নেরিভ্যান দা সিলভা বলেন, ‘এটা যখন ভালো, তখন ভালোই। কিন্তু সচরাচর ভালো অপেক্ষা কঠিন সময় পার করতে হয়।’
একটি খনির নিয়ন্ত্রণ করেন স্বর্ণ খনি সম্রাট হিসেবে পরিচিত জোসে অ্যান্তনিও। তার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে স্থানীয় আদিবাসী গোষ্ঠী মুন্ডুরুকুদের ২.৪ মিলিয়ন হেক্টর জমি; যেখানে ১৪ হাজার উপজাতির বসবাস। সম্প্রতি ব্রাজিলে আদিবাসীদের ভূখণ্ডে খনিজ সম্পদ আহরণ পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। গত বছর কর্তৃপক্ষ অভিযান চালিয়ে জোসে অ্যান্তনিওর খনন মেশিন ধ্বংস করে দেয়। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘আমাদের এসব কার্যক্রমই তাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। আমাদের কারণেই তারা খেতে পারে, মোটরসাইকেল, ফ্রিজ, টেলিভিশন কিনতে ও ভালো পোশাক পরতে পারে।’
আদিবাসীদের ওপর প্রভাব
মুন্ডুরুকু আদিবাসীদের নেতা আলেসসান্দ্রা কোরাপ। তিনি একটি গ্রামের প্রধান। কোরাপ বলেন, বোলসোনারোর কথাবার্তার কারণে খনিজ আহরণকারীরা আদিবাসীদের ভূখণ্ডে খননকাজ চালাতে উৎসাহ পেয়েছিল। তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট বলেছেন, খনির খনন কাজ বৈধ করা করা হবে। যাতে মানুষ বলতে পারে, আমি আমার জমিতে খনন করবো।
বিবিসি ব্রাজিলের হাতে আসা স্যাটেলাইটের সাম্প্রতিক ছবিতে দেখা যায়, আদিবাসী অধ্যুষিত তিনটি অঞ্চলে ব্যাপকভাবে অবৈধ খনন কাজ চলছে। এর মধ্যে মুন্ডুরুকু সম্প্রদায়ের ভূখণ্ডও রয়েছে। চলতি বছরের শুরুর দিকে এসব অঞ্চলে খননকাজ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। খনির খনন কাজের মারাত্মক প্রভাব পড়ছে সেখানকার জনজীবনের ওপর। অবৈধ খনন কাজের জন্য সেখানে ম্যালেরিয়া, পতিতাবৃত্তি, মানবপাচার, মাদকাসক্তি ও সহিংসতা বাড়ছে। যখন একটি খনির কাজ শেষ হয়ে যায়, তখন জঙ্গলের অন্য অংশ ধ্বংস করে নতুন করে খনিজ পদার্থের সন্ধান চলে। চক্রাকারভাবে চলে এই কাজ।
প্যারা স্টেটে অবৈধ খনিজ সম্পদ আহরণে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে নিয়ে কাজ করেছেন মার্কিন নৃতাত্ত্বিক গ্লেন শেপার্ড। তিনি বলেন, কিছু ক্ষেত্রে আদিবাসী নেতারা খনি খনন কাজে জড়িয়ে পড়েন। কিন্তু একবার যখন দরজা উন্মুক্ত করে দেন, তখন সেটি দ্রুতই তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। সম্প্রতি ব্রাজিলের ফেডারেল প্রসিকিউশনের কার্যালয়, ফেডারেল পুলিশের সঙ্গে একটি অনুসন্ধান চারিয়েছে। এতে দেখা গেছে, স্যান্তারেম শহরের এক স্বর্ণ ব্যবসায়ী কেনার সময় অন্তত ৬১০ কেজি সোনা জালিয়াতির মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছেন; যার বাজারমূল্য ১৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এসব সোনা ২০১৫ এবং ২০১৮ সালের মাঝে আদিবাসীদের ভূমি থেকে উত্তোলন করা হয়েছিল।
প্রসিকিউটর বোয়াভেন্তুরা বলেন, এই অনুসন্ধান দেখিয়েছে যে, ব্রাজিলে সোনা বেচাকেনার নিয়ন্ত্রণ নেই। চলতি বছরের শুরু থেকে ব্রাজিলের পরিবেশবিষয়ক সংস্থাগুলো তাদের অভিযান বন্ধ রেখেছে। গত এক দশকের মধ্যে পরিবেশ বিষয়ক অপরাধের কারণে পরিবেশ সংস্থার জরিমানার পরিমাণ সর্বনিম্নে নেমে এসেছে বলে দেশটির দৈনিক এস্তাদো দে এস পাওলো জানিয়েছে।
গত কয়েকদিনের টানা অগ্নিকাণ্ডে ব্রাজিলে আমাজনের জঙ্গলে হাজার হাজার জায়গায় এখনো আগুন জ্বলছে। গত এক দশকে এত ব্যাপক মাত্রায় সেখানে দাবানল কখনো সৃষ্টি হতে দেখা যায়নি। ব্রাজিল কোনো কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়ায় ফ্রান্স ও আয়ারল্যান্ড দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোর সঙ্গে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি অনুমোদন না করার হুমকি দিয়েছে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে আমাজনের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে দেশটির সেনাবাহিনীর সদস্যদের মোতায়েনের ঘোষণা দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট বোলসোনারো।
এসআইএস/এমএস