দেশজুড়ে

এতিম মেয়ের রাজকীয় বিয়ে

চারটি পাড়া নিয়ে সুলতানপুর মহল্লা। সেই গ্রামজুড়ে উৎসবের আমেজ। এক বিয়ে ঘিরেই এত উৎসব। আয়োজনও ব্যাপক। গরু জবাই করে আপ্যায়ন করা হয় বরযাত্রী আর নিমন্ত্রিতদের। পাড়াজুড়ে করা হয় আলোকসজ্জা, পাড়ার দু’মাথায় দুটি তোরণ নির্মাণ করা হয়েছে নিমন্ত্রিতদের স্বাগত জানানোর জন্য। এতসব আয়োজন সুলতানপুর মহল্লার এক এতিম মেয়ের বিয়ের। আর এতিম মেয়েটির এমন বিয়ের আয়োজন করেন বগুড়ার শিবগঞ্জ পৌর মেয়র।

Advertisement

এমন আয়োজন দেখে অনেকের মুখেই রটে গেছে যে, মেয়রের মেয়ের বিয়ে হচ্ছে। ফলে সাধারণ মানুষের মাঝে যেন আগ্রহ আরও বেশি।

শুক্রবার এ বিয়ের আয়োজন করা হয়। কনে রাজিয়া সুলতানা (১৯) স্থানীয় কলেজ থেকে এবার এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছেন।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, রাজিয়া সুলতানার বাবা আব্দুর রাজ্জক ২০১৬ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তারও দুই বছর আগে দুই ছেলে ও এক মেয়েকে রেখে সংসার ছেড়ে চলে যান রাজিয়ার মা গোলাপী বেগম। দুই ছেলের মধ্যে বড়জন শারীরিক প্রতিবন্ধী। রাজিয়াই তার পরিবারের বড় মেয়ে। যখন বাবা মারা যায় তখন সবেমাত্র নবম শ্রেণির ছাত্রী। পরিবারের হাল ধরার যেমন কেউ নেই, তেমনি এতিম এই তিন সন্তানকে প্রতিপালন করারও সামর্থ নেই তার চাচাদের।

Advertisement

রাজ্জাকের জানাজার নামাজে অংশ নিতে গিয়ে বিষয়টি জানার পর শিবগঞ্জ পৌর মেয়র ওই পরিবারের দায়িত্ব নেয়ার ঘোষণা দেন। কিছুদিন পরই রাজিয়ার ছোটভাই সিয়ামকে ভর্তি করে দেন একটি আবাসিক হাফেজিয়া মাদরাসায়। আর প্রতিবন্ধী মোহসীন আলীর নামে ভাতার ব্যবস্থা করেন।

অনেকের ধারণা ছিল এটা করেই হয়তো দায়িত্ব শেষ করবেন মেয়র। কিন্তু তিনি তা করেননি। রাজিয়ার লেখাপড়ার সমস্ত খরচই বহন করেছেন। এসএসসি পাস করার পর তাকে ভর্তি করে দেন শিবগঞ্জ সরকারি এমএইচ কলেজে। এবার সেখান থেকেই এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে রাজিয়া।

এরই মাঝে মেয়েটির পাত্র খুঁজতে শুরু করেন মেয়র। এতিম মেয়েকে বিয়ে করবে এমন পাত্র পেতে খুব বেগ পেতে হয়নি। একই এলাকার নয়াপাড়ার বাসিন্দা আজাদুল ইসলাম (২২) বিয়েতে সম্মত হন। পেশায় নির্মাণ শ্রমিকের হেড মিস্ত্রি আজাদুলকে দেখে পছন্দ করে মেয়েও। ফলে সেখানেই বিয়ের আয়োজন করা হয়। বিয়ের কথা পাকাপাকি হওয়ার পরই আজাদুলের বাড়ির ঘর-দরজা ও শৌচাগার নির্মাণ করে দেন মেয়র।

এরপর চলে বিয়ের আয়োজন। বর-কনের জন্য দুই ভরি ওজনের স্বর্ণালঙ্কার থেকে শুরু করে খাট, ফ্রিজ, শোকেস, ডাইনিং টেবিলসহ যাবতীয় আসবাবপত্র কেনার উদ্যোগ নেন তিনি। এতিম মেয়ের বিয়ের খবরে এলাকার হিতৈষী ব্যক্তিরাও এগিয়ে আসেন। তারাও নানা উপহার সামগ্রী কিনে দেন বিয়েতে।

Advertisement

পুরো বিয়েকে স্মরণীয় করতে পাড়াজুড়ে করা হয় আলোকসজ্জা। নৃত্য-গীতের জন্য শহর থেকে নিয়ে যাওয়া হয় গায়েন। মহল্লার নারী-পুরুষ বিয়ের আগের রাতে আনন্দ-উল্লাসে মেতে ওঠেন।

কনে রাজিয়া সুলতানা বলেন, বাবা-মা যে নেই, সেটা বুঝতেই পারছি না। তারা থাকলেও হয়তো এতো ভালো আয়োজন করতে পারত না। তিনি নতুন সংসারের জন্য সকলের দোয়া চান।

বর আজাদুল ইসলাম বলেন, কনে পাশের পাড়ার হওয়ায় তার সম্পর্কে আগে থেকেই সব জানতাম। এমন একটি মেয়েকেই বিয়ের ইচ্ছা ছিল যার কেউ নেই। এরই মাঝে মেয়র সাহেবের পক্ষ থেকে বিয়ের প্রস্তাব এলে আমার পরিবারও রাজি হয়। আমাদের বিয়েতে যে এত আয়োজন হবে তা ভাবতেই পারিনি।

পৌর মেয়র তৌহিদুর রহমান মানিক জানান, বিয়েতে চার পাড়ার সকল পরিবারকে আমন্ত্রণ জানানোর পাশাপাশি পৌর এলাকার অনেককেই নিমন্ত্রণ করা হয়। বিয়েতে শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহীকর্মকর্তা আলমগীর কবির, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মিজানুর রহমান, উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান রাজ্জাকুল ইসলাম রাজুসহ অনেকেই এসে নবদম্পতিকে আশীর্বাদ করে গেছেন।

তিনি বলেন, আমার নিজের একটি ছেলে ছাড়া কোনো মেয়ে নেই। যেহেতু রাজিয়ার বাবা-মা কেউ নেই, এ কারণে আমিই তার অভিভাবকত্ব করার ঘোষণা দিয়েছিলাম। আমার স্ত্রীও তাকে মেয়ের মতোই মনে করে। এ কারণে আমরা বিয়েটিকে মোটামুটি উৎসবমুখর করার চেষ্টা করেছি।

লিমন বাসার/এফএ/জেআইএম