জাতীয়

স্কুলে স্যারের বেতের বাড়ি খাওয়ার বর্ণনা দিলেন তথ্যমন্ত্রী

‘পৃথিবীতে সবচেয়ে মূল্যবান অনুষঙ্গ হচ্ছে সময়। সময় যেটি বয়ে যায়, সেটি কখনও ফেরত পাওয়া যায় না। কারণ, কারও যদি স্বাস্থ্যহানি হয়, সেই স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার করা যায়, কারও যদি ব্যবসায় লোকসান হয়, সেই লোকসানও পুষিয়ে নেয়া যায়। কিন্তু বয়ে যাওয়া সময় ফেরত আনা যায় না। সেই সময়ের মধ্যে মূল্যবান সময় হচ্ছে ছাত্রজীবন,’- শিক্ষার্থীদের প্রতি পরামর্শ দিয়ে কথাগুলো বলেছেন তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ।

Advertisement

শুক্রবার (২৩ আগস্ট) রাতে এক অনুষ্ঠানে স্কুলজীবনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তথ্যমন্ত্রী এসব কথা বলেন। মুসলিম হাইস্কুল প্রাক্তন ছাত্র সমিতি উদ্যোগে ঈদ পুনর্মিলনী ও কৃতি ছাত্র সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এ স্কুলটির প্রাক্তন ছাত্র।

ড. হাছান মাহমুদ বলেন, মুসলিম হাইস্কুলের আঙিনায় বহু বছর কেটেছে। এই স্কুলের শিক্ষা না পেলে আমি কখনোই আজকের এই পর্যায়ে আসতে পারতাম না।

তিনি বলেন, আমার মনে আছে, ১৯৭৩ সালে আমি মুসলিম হাইস্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হই। একই বছর স্কুলের মিলনায়তনে স্বাধীনতা দিবসের আলোচনা সভা হয়। সভার শুরুতে, নাম চাওয়া হলো যারা বক্তৃতা দেবে তাদের। দুটি গ্রুপ। একটি হচ্ছে সিনিয়র গ্রুপ, নবম-দশম। আরেকটি হচ্ছে জুনিয়র গ্রুপ- ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণি।

Advertisement

‘আমি দর্শক সারিতে বসে আছি। আমার একটা বন্ধু ছিল, পাড়ার বন্ধু। নাম অনুপম বড়ুয়া। সে স্কুলের ছাত্র না, সে এমনি আমার সঙ্গে স্কুলে এসেছিল স্বাধীনতা দিবসের আলোচনা সভায়। যখন নাম আহ্বান করলো অনুপম বললো, তুই নাম দে। আমি একটু দ্বিধাগ্রস্ত হলে সে বলে, তুই এমনি ফটর ফটর করছ, এখন নাম দে। তারপর আমি নাম দিলাম।’

ড. হাছান মাহমুদ বলেন, বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় যখন ফলাফল ঘোষণা করা হয়, তখন দেখি আমি প্রথম হলাম। এই যে আমার জীবনের প্রথম বক্তৃতায় আমি প্রথম হলাম এবং সেটা আমাকে বহুদূর এগিয়ে নিয়ে গেছে। আমি স্কুলের সব বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতাম, যতবার অংশগ্রহণ করেছি, দ্বিতীয় দুয়েকবার হয়েছি, কিন্তু তৃতীয় কোনোসময় হয়েছি বলে আমার মনে পড়ে না।

‘তখন জাতীয় টেলিভিশনে বিতর্ক প্রতিযোগিতা হতো। সেই বিতর্ক প্রতিযোগিতায় আমি টিম লিডার হিসেবে অংশ নিতাম। যখন কলেজে ভর্তি হই তখন আমাকে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক করা হয়। সেটি করার পেছনে বড় বিবেচনা ছিল যে, আমি ভালো করে বক্তৃতা দিতে পারি। যারা করেছিল, তারা কিন্তু এখনও বেঁচে আছে। এখনও রাজনীতি করেন। অর্থাৎ এই স্কুলের শিক্ষা আমাকে আজকের জায়গায় দাঁড় করানোর ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা পালন করেছে,’- যোগ করেন তথ্যমন্ত্রী।

তিনি বলেন, আমার মনে আছে, সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় আমি একবার হাইবেঞ্চের ওপর বসে বক্তৃতা দিচ্ছিলাম। আমার সামনে বন্ধুরা বসা ছিল। তারা হঠাৎ আমার দিকে একটু অন্যভাবে তাকাচ্ছিল। আমি মনে করেছি, এমনিতে তাকাচ্ছে। পেছনে যে স্যার এসেছেন, তারা আমাকে বলেনি। তারা ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গেছে। আমাকে কিছু বলতে পারছে না। হঠাৎ পেছনে বেতের বাড়ি, কিছু বুঝে উঠার আগে। নুরুল ইসলাম স্যার মেরেছিলেন, স্যার এখন বেঁচে নেই। তিনি বিজ্ঞান পড়াতেন। সেই থেকে আজ পর্যন্ত আমি হাইবেঞ্চে বসিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে দূরের কথা জীবনে আর কোনোদিন আমি হাইবেঞ্চে বসিনি।

Advertisement

স্কুলে পড়াকালীন বয় স্কাউটের দলনেতা, জুনিয়র রেডক্রস টিমের সদস্য ও জাতীয় টেলিভিশন বিতর্ক প্রতিযোগিতায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সোহরাওয়ার্দী হল বিতর্ক দলের দলনেতা ছিলেন বলেও জানান তথ্যমন্ত্রী।

তিনি বলেন, নেতৃত্ব দেয়ার এসব কাজ করতে গিয়ে পড়াশোনায় অমনোযোগী হয়ে পড়েছিলাম। ইসহাক স্যার (মুসলিম হাই স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষক) এখানে আছেন। তিনি একবার আমার বাবাকে গিয়ে বললেন যে, আপনার ছেলে তো এখন নেতাগিরি করা শুরু করেছে, কিছু করেন। আবার বাবা একটু মেজাজি মানুষ ছিলেন, বাবা আমাকে কষে একটা পিটানো দিয়েছিলেন। আমার এখনও মনে আছে। স্যারের সঙ্গে কয়েকদিন আগে দেখা করতে গিয়েছিলাম, সেই স্মৃতিটা স্যারকে আমি বলেছিলাম। এই স্কুলের বহু স্মৃতি।

‘আমাদের ব্যাচের ছাত্র ছিল আইয়ুব বাচ্চু। সে দেশের অন্যতম সেরা গিটারিস্ট ছিল। স্কুলের বর্ষপূতি অনুষ্ঠানে আইয়ুব বাচ্চু এসেছিলেন। আজকে এখানে এসে মনে হচ্ছে, আবার ছেলেবেলায় ফিরে যাই। বন্ধুদের অনেকে এখানে আছে। আসলে ছোটবেলায় ফিরে যাওয়ার তো সুযোগ নেই। আর এখানে এসে আমার মনে হচ্ছে, আমার শিক্ষক-অভিভাবকরা আমাকে যেভাবে পরামর্শ দিয়েছিলেন, সেগুলো যদি পরিপূর্ণভাবে অনুসরণ করতাম, জীবন চলার পথে আরও বহুদুর এগিয়ে যেতে পারতাম। মন্ত্রী হওয়া, মন্ত্রীর আসনে বসা একমাত্র জীবন চলার পথে বহুদুর এগিয়ে যাওয়া নয়। বহুদুর এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে আরও বহু অনুসঙ্গ আছে,’- বলেন তথ্যমন্ত্রী।

তিনি বলেন, ছাত্রজীবনের সময়টি যে ভালোভাবে ব্যবহার করতে পারবে, সে জীবনে উন্নতি লাভ করবে। জীবন চলার পথে দেখেছি, অনেক মেধাবী ছাত্র পরবর্তীতে সেই ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারেনি এবং হারিয়ে গেছে। তাই যারা জিপিএ-৫ পেয়েছো, তাদের অনুরোধ জানাবো এই ভালো ফলাফলটা ভবিষ্যতে আরও যাতে ভালো করতে পারো, তোমাদের সেই প্রচেষ্টা চালাতে হবে। আর যারা পাওনি, তাদের অনুরোধ জানাব, হতাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই। কারণ, বিল গেটস, আজকে পৃথিবীকে বদলে দিয়েছেন মাইক্রোসফটের মাধ্যমে।

‘বিল গেটস কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেল করার কারণে পরপর দুবার বহিষ্কৃত হয়েছিল। যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিল গেটস বহিষ্কৃত হয়েছিল, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে বিল গেটসকে নিয়ে গবেষণা হয়। তার অর্থায়নে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক প্রকল্প পরিচালিত হয়। সুতরাং ফলাফল খারাপ হলে হতাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই। এরকম অনেক মানুষ পৃথিবীতে আছেন যারা ফলাফল ভালো করেনি, কিন্তু জীবন চলার পথে অনেককে ছাড়িয়ে গেছেন। তাই যারা সাফল্য অর্জন করোনি, তারা যারা সাফল্য অর্জন করেছে তাদের ছাড়িয়ে যাওয়ার সংকল্প নিয়ে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাও।’

শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে তথ্যমন্ত্রী বলেন, আমি যখন বিদেশে পড়তে যাই, আমার এক বন্ধুর সঙ্গে একটা রুম শেয়ার করতাম। প্রায় সময় তাকে শুধু পড়াশোনা করতে দেখতাম, তার নাম ছিল সঞ্জয় লাহিরি। আমি তাকে বলতাম, সঞ্জয় বাবু আপনি তো সময়কে ওষুধের মতো ব্যবহার করছেন। তখন সে বললো যে, জীবনে বহু সময় পার করে এসেছি, এখন সময়কে ওষুধের মতো ব্যবহার করা ছাড়া উপায় নেই। আমি তোমাদের বলব, সময়ের সৎ ব্যবহার করার জন্য।

আবু আজাদ/জেডএ/জেআইএম