উপমহাদেশের বাম রাজনীতির অন্যতম পুরোধা, মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলীর মধ্যে বেঁচে থাকা সর্বশেষ সদস্য ও বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ -মোজাফফর) প্রধান অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ আর নেই (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিউন)। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯৭ বছর।
Advertisement
শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টা ৪৯ মিনিটে রাজধানীর অ্যাপোলো হাসপাতালের চিকিৎকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত শারীরিক নানা সমস্যায় ভুগছিলেন। এরই মধ্যে তাকে একাধিকবার আইসিইউতে নেয়া হয়। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি এক কন্যা সন্তানের জনক। তার স্ত্রী আমিনা আহমদ বর্তমানে ন্যাপের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং বাংলাদেশ নারী সমিতিতে সভানেত্রী হিসেবে আছেন।
অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের মৃত্যুর খবরে জন্মস্থান কুমিল্লার দেবিদ্বারে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। মোজাফফর আহমদের একমাত্র মেয়ে আইভী আহমেদ জানান, বাবার শারীরিক অবস্থার গুরুতর অবনতি ঘটায় গত ১৪ আগস্ট এ্যাপোলো হাসপাতালের আইসিইউতে নেয়া হয়েছিল। জানাজা ও দাফনের বিষয়ে পার্টি ও পারিবারিকভাবে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি।
তবে দেবিদ্বারের গ্রামের বাড়ি এলাহাবাদে তাকে দাফন করা হবে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।
Advertisement
মোজাফফর আহমদের জন্ম ও শিক্ষাজীবন
অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ ১৯২২ সালের ১৪ এপ্রিল কুমিল্লা জেলার দেবিদ্বার উপজেলার এলাহাবাদ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম আলহাজ্ব কেয়াম উদ্দিন ভূইয়া, মায়ের নাম আফজারুন্নেছা। বাবা ছিলেন একজন স্কুলশিক্ষক। মোজাফফর আহমদ স্থানীয় হোসেনতলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথিমিক, জাফরগঞ্জ রাজ ইনস্টিটিউশন ও দেবিদ্বার রেয়াজউদ্দিন পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে মাধ্যমিক এবং ভিক্টোরিয়া কলেজে উচ্চমাধ্যমিক পড়াশোনা করেন।
পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে সম্মানসহ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি গ্রহণ করেন এবং ইউনেস্কো থেকে ডিপ্লোমা লাভ করেন।
কর্মজীবন ও রাজনীতিতে যোগদান
Advertisement
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্র মোজাফফর দীর্ঘদিন বিভিন্ন কলেজে শিক্ষকতা করেন। সর্বশেষ তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপনা করেন ১৯৫২ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত। তার রাজনৈতিক জীবন অত্যন্ত বর্ণিল। রাজনীতি অঙ্গনে তার শুভসূচনা হয় ১৯৩৭ সালের দিকে। তিনি ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপনা ছেড়ে দিয়ে সম্পূর্ণভাবে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের (শেরে বাংলা-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দী) প্রার্থী হিসেবে নিজের এলাকা কুমিল্লার দেবিদ্বার থেকে প্রভাবশালী মুসলিম লীগ প্রার্থী ও তদানীন্তন শিক্ষামন্ত্রী মফিজউদ্দিনকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে তাক লাগিয়ে দেন।
আওয়ামী লীগের বিরোধিতা সত্ত্বেও ১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক পরিষদে ন্যাপ’র প্রতিনিধি নেতা হিসেবে অধ্যাপক মোজাফফর আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন। সামরিক শাসক আইয়ুব সরকার তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা ও হুলিয়া জারি করে ১৯৫৮ সালের দিকে। তাকে ধরিয়ে দিলে পুরস্কার প্রাপ্তির ঘোষণা পর্যন্ত করা হয়। আত্মগোপন থাকা অবস্থায় তিনি আইয়ুব সরকার শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন সুসংগঠিত করেন। দীর্ঘ আট বছরব্যাপী আত্মগোপনে থাকার পর ১৯৬৬ সালে তিনি প্রকাশ্য রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন করেন।
১৯৬৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান ন্যাপের সভাপতি নির্বাচিত হন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। অবিভক্ত পাকিস্তান ন্যাপের যুগ্ম সম্পাদকও ছিলেন তিনি। ১৯৬৯ সালে আইয়ুব সরকারবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি কারাবরণও করেছেন।
মুক্তিযুদ্ধে অবদান
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার তথা মুজিবনগর সরকার ছয় সদস্যের যে উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করেছিল তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ এবং সেই ৬ জনের মাঝে তিনিই এ যাবৎ একমাত্র জীবিত উপদেষ্টা ছিলেন। তিনি স্বাধীনতার পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সফর করেন। সে সময় তিনি জাতিসংঘে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ন্যাপ, সিপিবি ও ছাত্র ইউনিয়ন থেকে নিজস্ব উনিশ হাজার মুক্তিযোদ্ধা সংগঠনে অধ্যাপক আহমদের ভূমিকা অবিস্মরণীয়।
স্বাধীন বাংলার রাজনীতিতে পদচারণ
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ১৯৭৯ সালে অধ্যাপক মোজাফফর সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরে ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কুমিল্লার দেবিদ্বার আসন থেকে কুঁড়েঘর প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নেন। স্বৈরাচারী শাসক এরশাদবিরোধী আন্দোলনের শুরুতে তিনি কারারুদ্ধ হন। রাজনৈতিক জীবনে তিনি যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, সোভিয়েত ইউনিয়ন, বুলগেরিয়া, অস্ট্রিয়া, দক্ষিণ ইয়েমেন, লিবিয়া, আফগানিস্তান, ভারত, মধ্যপ্রাচ্যসহ পূর্ব ও পশ্চিম ইউরোপের নানান দেশে সফর করেন।
সরকার ২০১৫ সালে অন্যদের সঙ্গে তাকেও স্বাধীনতা পদক দেয়ার ঘোষণা দিলে তিনি সবিনয়ে তা নিতে অস্বীকার করেন। তার মতে ‘রাজনীতির অর্থ দেশসেবা, মানুষের সেবা। পদ বা পদবির জন্য কখনো রাজনীতি করিনি। পদক দিলে বা নিলেই সম্মানিত হয়, এই দৃষ্টিভঙ্গিতে আমি বিশ্বাসী নই।’
কামাল উদ্দিন/এফএ/জেআইএম