আবর্জনার স্তুপে আগুন জ্বালিয়ে পাশের একটি পাথরের স্তুপের কাছে বসে আছেন একদল তরুণ। মসজিদের মাইকে ভেসে আসছে স্বাধীনতার স্লোগান। ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু-কাশ্মীরের অবরুদ্ধ একটি গ্রাম সৌরা; যা ‘কাশ্মীরি গাজা’ হিসেবে পরিচিত। এই গ্রামের প্রবেশ পথে বসে পাহারা দিচ্ছেন তরুণরা। গ্রামে ভারতীয় নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যদের প্রবেশ ঠেকাতে তারা প্রবেশ পথে নিয়ম করে পাহারা বসিয়েছেন।
Advertisement
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এই অঞ্চলের স্বায়ত্ত্বশাসন বাতিলে নয়াদিল্লির নেয়া বিতর্কিত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কাশ্মীরিদের প্রকাশ্য অবাধ্যতার নজির এটি। কাশ্মীরের প্রধান শহর শ্রীনগরের কাছে ‘সৌরা’র অবস্থান। এই এলাকাটিই কাশ্মীরি গাজা নামে পরিচিত। নিরাপত্তাবাহিনীর কোনো সদস্যই গ্রামটিতে প্রবেশ করতে পারে না।
কাশ্মীরির বিশেষ মর্যাদা বাতিলের পর আগস্টের শুরু থেকেই এখানকার বাসন্দিারা টিনের পাত, কাঠের গুঁড়ি, তেলের ট্যাঙ্ক, কংক্রিটের পিলার ও মাটি খুঁড়ে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছেন। ভারতের বিরুদ্ধে প্রতিদিনের তীব্র বিক্ষোভ-প্রতিবাদের পাশাপাশি তারা এসব করেছেন সেনা সদস্যদের গ্রামে প্রবেশ ঠেকাতে।
রাতের বেলা গ্রামের প্রবেশ পথে যে যুবকরা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে পাহারা দেন, তাদের একজন মুফিদ। ফরাসী বার্তাসংস্থা এএফপিকে তিনি বলেন, ‘তারা শুধুমাত্র আমাদের লাশের ওপর দিয়ে সৌরায় ঢুকতে পারে। আমরা ভারতকে আমাদের এক ইঞ্চি মাটিও দেব না।’
Advertisement
‘গাজায় যেভাবে ইসরায়েলকে প্রতিরোধ করা হচ্ছে, আমরা সেভাবেই আমাদের মাতৃভূমির জন্য সর্ব শক্তি দিয়ে লড়াই করবো।’
ভারত শাসনের বিরুদ্ধে কাশ্মীরে তিন দশকের বেশি সময় ধরে সশস্ত্র বিদ্রোহ চলছে। নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে; যাদের অধিকাংশই বেসামরিক।
কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের আগেই ভূস্বর্গখ্যাত এই উপত্যকায় হাজার হাজার অতিরিক্ত সেনাসদস্য মোতায়েন করে ভারত। তার আগে থেকেই কাশ্মীরে ৫ লাখের বেশি সেনা মোতায়েন রয়েছে। কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা যাতে ছড়াতে না পারে সেজন্য সব ধরনের যোগাযোগব্যবস্থা বন্ধ রাখা হয়েছে।
কিন্তু তারপরও প্রতিবাদ-বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। নিম্ন মধ্যবিত্ত সৌরা এলাকা এই বিক্ষোভে নেতৃত্ব দিচ্ছে। গত ৯ আগস্ট এখানে কমপক্ষে ১৫ হাজার মানুষ বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন, এখন পর্যন্ত এটিই কাশ্মীরের সবচেয়ে বড় বিক্ষোভ। বিক্ষোভ ছত্রভঙ্গ করতে নিরাপত্তা বাহিনী তাজা গুলি, টিয়ার গ্যাস ও পেলেট গান নিক্ষেপ করেছে। এতে দুই ডজনের বেশি মানুষ আহত হয়েছেন।
Advertisement
ভারত ফিরে যা
লেকের পাশে অবস্থিত সৌরায় দুই হাজারের বেশি মানুষের বসবাস। এই এলাকাটি তিন দিক থেকে ঘিরে রেখেছে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী। এই বসতির বিক্ষোভের প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠেছে ‘জেনাব সায়েব’ নামের বিখ্যাত একটি মসজিদ।
সরু পথ ধরে প্রত্যেক রাতে এখানকার বাসিন্দারা গ্রামে মিছিল করেন। তাদের হাতে থাকে টর্চ লাইট। টর্চের আলোতে প্রাচীরে লেখা গ্রাফিতি ‘কাশ্মীরের স্বাধীনতা’, ‘ভারত যা, ফিরে যা’ ভেসে ওঠে। সৌরার আশপাশে মহাসড়কে পুলিশের কোনো ধরনের উপস্থিতি টের পেলে স্থানীয়রা গ্রামে টহলরত তরুণদের কাছে খবর পৌঁছে দেন।
সৌরায় পুলিশ ড্রোন এবং হেলিকপ্টার মোতায়েন করেছে। এই গ্রামের ভেতরে প্রায় তিনবার ড্রোন ও হেলিকপ্টার প্রবেশের চেষ্টা করলেও সৌরার তরুণরা পাথর নিক্ষেপ করে সেগুলো ফেরত যেতে বাধ্য করেছে। অনেক তরুণের কাছে কুঠার এবং হারপুন রয়েছে।
পুলিশ জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে মরিচের গুঁড়া ও টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে। এর ঝাঁঝ থেকে বাঁচতে তরুণরা লবনযুক্ত পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে ফেলেন। পুলিশের ছোড়া পেলেট গানের আঘাত থেকে বাঁচতে তারা হেলমেট, চশমা পড়েন। তবে এই এলাকা থেকে বাইরে বের হওয়ায় সেখানকার তিন তরুণ গ্রেফতার হয়েছেন। কাশ্মীরে এখন পর্যন্ত ছয় হাজারের বেশি মানুষকে গ্রেফতার করেছে দেশটির আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী।
নাহিদা নামের এক তরুণী বলেন, ‘তারা আমাদের স্থিতিস্থাপকতার পরীক্ষা নিচ্ছে এবং নিশ্চিতভাবেই তারা এতে ব্যর্থ হবে। শেষে আমরা তাদের পরাজিত করবো। এমনকি এই পরিস্থিতি যদি বছরের পর বছর ধরেও চলতে থাকে, আমরা ছাড় দেব না।’
সৌরার এই প্রতিবাদ-বিক্ষোভ সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষ জোর দিয়ে বলছে যে, অচলাবস্থা শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত অনেকাংশেই শান্ত রয়েছে কাশ্মীর।
ঐতিহাসিক ভুলের সংশোধনের শুরু
ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান-ভারত বিভক্ত হয়। তখন থেকেই কাশ্মীরের ইতিহাসের অংশ সৌরা। কাশ্মীরের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেইখ আব্দুল্লাহর জন্ম এখানে; যিনি স্বায়ত্ত্বশাসনের শর্তে কাশ্মীরকে ভারতের সঙ্গে যুক্ত করতে সম্মত হয়েছিলেন।
ভারত শাসনের অধীনে আসার পর তার নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল কনফারেন্স পার্টি অধিক স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবিতে লড়াই করেছে। শেইখ আব্দুল্লাহর ছেলে ফারুক আব্দুল্লাহ ও নাতি ওমর আব্দুল্লাহ তিন দশকের বেশি সময় ধরে কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় ছিলেন।
সাম্প্রতিক অচলাবস্থা শুরু হওয়ার পর কাশ্মীরের সাবেক এ দুই মুখ্যমন্ত্রীকে আটক করে নয়াদিল্লি। গত কয়েক বছর ধরে এখানকার বাসিন্দারা অতিমাত্রায় ভারত-বিরোধী হয়ে উঠেছেন। ২০১৬ সালে কাশ্মীরের রাস্তায় ব্যাপক গণবিক্ষোভ শুরু হয় জনপ্রিয় এক মিলিট্যান্ট কমান্ডার নিহত হওয়ার পর। ওই সময় সৌরায় সরকারি বাহিনীর সঙ্গে কয়েক ডজন সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
সৌরার বাসিন্দা রফিক মনসুর শাহ বলেছেন, ‘ভারতের সঙ্গে যুক্ত হতে আব্দুল্লাহর সিদ্ধান্তে অনেকেই আশাহত।’
গত ৫ আগস্ট বিশেষ মর্যাদা বাতিলে ভারতের নেয়া সিদ্ধান্তের পর দেশটির অন্য প্রান্তের বাসিন্দারা এখন কাশ্মীরের সরকারি চাকরি ও সম্পত্তি কেনার আবেদন করতে পারবেন। কিন্তু মনসুর শাহর মতো অনেক কাশ্মীরির বিশ্বাস, ‘আমাদের ভূখণ্ড ছিনিয়ে নেয়ার জন্য নয়াদিল্লির অসৎ পরিকল্পনা রয়েছে।’
তিনি বলেন, আব্দুল্লাহর পরিবারের ক্ষমতার লোভের কারণে...আমরা ভারতের দাসে পরিণত হয়েছি। আমরা ঐতিহাসিক এই ভুল সংশোধনের চেষ্টা করছি। আমরা পুরো কাশ্মীরকে অনুপ্রাণিত এবং নেতৃত্ব দেয়ার চেষ্টা করছি।
সূত্র : এএফপি।
এসআইএস/জেআইএম