ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ভারতকে ‘হিন্দু পাকিস্তান’ হতে দেবেন না বলে শপথ করেছিলেন। ১৯৪৭ সালে তিনি রাজ্য মুখ্যমন্ত্রীদেরকে লিখেছিলেন: “আমাদের মধ্যে একটি মুসলিম সংখ্যালঘু রয়েছে যারা সংখ্যায় এত বড় যে তারা চাইলেও অন্য কোথাও যেতে পারবে না। তাদের ভারতেই থাকতে হবে। এটি একটি মৌলিক সত্য যা সম্পর্কে কোনও যুক্তি থাকতে পারে না। পাকিস্তানের যতই উস্কানিই হোক না কেন এবং সেখানে অমুসলিমদের উপর যত রকমের অশান্তি ও ভয়াবহতা ঘটুক না কেন, আমাদের এই সংখ্যালঘু বিষয়টিকে সভ্য পদ্ধতিতে মোকাবেলা করতে হবে। আমাদের অবশ্যই তাদের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সুরক্ষা এবং নাগরিক অধিকার দিতে হবে।”
Advertisement
স্বাধীনতার সাথে সাথে ভারত মুসলিম ও খ্রিস্টান এবং শিখ এবং পার্সীদের সমান অধিকারের আশ্বাস দেয়। নেহরু বেঁচে থাকা পর্যন্ত ধর্মীয় কোন্দল খুব কম ছিল। তবে ১৯৬৪ সালে তার মৃত্যুর পরে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ক্ষণে ক্ষণের দাঙ্গাটা শুরু হয়েছিল। কেন্দ্রে এবং বেশিরভাগ প্রধান রাজ্যে বিজেপি এখন ক্ষমতায়। বিজেপির অনেক নেতাকর্মী, কার্যত তার সমস্ত ক্যাডারই সংখ্যাগুরুর দাপট মনোভাবাপন্ন। ১৯৪৭ সাল থেকে যে কোনও সময়ের চেয়ে ভারত এখন ‘হিন্দু পাকিস্তান’ হওয়ার কাছাকাছি।
পরিস্থিতি যখন এমন, শেষ পর্যন্ত রাহুল গান্ধী কংগ্রেসের সভাপতি থাকতে সম্মত হলেন না। অবশেষে গত ১২ই আগস্ট সোমবার কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি সোনিয়া গান্ধীকে অস্থায়ীভাবে পার্টির সভাপতির পদ গ্রহণের জন্য অনুরোধ করলে তিনি তাতে সম্মত হয়েছেন। এখন কংগ্রেসের সভাপতি সোনিয়া গান্ধী। তিনি অসুস্থ। দূরারোগ্য রোগে ভুগছেন। গত নির্বাচনে সভা সমাবেশে যোগদান করেননি। তার নির্বাচনী কেন্দ্র রায়বেরেলিতে তার কন্যা প্রিয়াংকা বরাবরের মতো নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়েছেন। সোনিয়া জিতেছেনও।
কংগ্রেসে ভাঙ্গনের সুর আরম্ভ হয়েছিল লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যুর পর। ইন্দিরা গান্ধী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর মন্ত্রিসভার তথ্য ও বেতার দপ্তরের মন্ত্রী ছিলেন। আর মোরারজি দেশাই ছিলেন অর্থ দপ্তরের মন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী ঠিক করতে গিয়ে প্রবীণ কংগ্রেস নেতারা, যাকে তখন ওল্ড সিন্ডিকেট বলা হত, ঠিক করলেন মোরারজি দেশাইকে। আর তরুণ তুর্কিরা ঠিক করেছিলেন ইন্দিরা গান্ধীকে। পার্লামেন্টারি পার্টির ভোটাভুটিতে কিন্তু ওল্ড সিন্ডিকেটের প্রার্থী পরাজিত হলেন আর শেষ পর্যন্ত ইন্দিরা গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হলেন।
Advertisement
অবশ্য মোরারজি দেশাই ইন্দিরা মন্ত্রিসভায় অর্থমন্ত্রী হতে কোনো সংকোচবোধ করেননি। এই সময় ভারতের রাষ্ট্রপতি ছিলেন ড. জাকির হুসেইন এবং উপ-রাষ্ট্রপতি ছিলেন ভি ভি গিরি। ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল ছিলেন লর্ড মাউন্টব্যাটেন। তিনি আট মাস গভর্নর জেনারেল হিসেবে ছিলেন। তারপর ব্রিটেনে চলে যান এবং গভর্নর জেনারেল হন রাজাগোপালাচারী। শাসনতন্ত্র গৃহিত হওয়ার পর রাজেন্দ্র প্রসাদ ভারতের রাষ্ট্রপতি হন আর উপরাষ্ট্রপতি ছিলেন সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ। রাজেন্দ্র প্রসাদ দুই দফা রাষ্ট্রপতি ছিলেন তারপর রাষ্ট্রপতি হন উপরাষ্ট্রপতি সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন। তার উপ-রাষ্ট্রপতি ছিলেন ডক্টর জাকির হুসেইন।
রাধাকৃষ্ণন এর মেয়াদ উত্তীর্ণ হলে ডক্টর জাকির হুসেইন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। ডক্টর জাকির হুসেইন মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার আগেই মৃত্যুবরণ করেছিলেন। কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি যখন রাষ্ট্রপতি পদে নীলম সঞ্জীব রেড্ডিকে মনোনয়ন প্রদানের জন্য নাম প্রস্তাব করেন তখন ইন্দিরা গান্ধী ভি ভি গিরিকে রাষ্ট্রপতি পদে মনোনয়ন প্রদান করে পূর্বের ধারাবাহিকতা রক্ষার অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু ওল্ড সিন্ডিকেটের সদস্যরা সে কথা শুনেননি। ভি ভি গিরি ছিলেন শ্রমিক নেতা। প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গির মানুষ। ভি ভি গিরি রাষ্ট্রপতি হলে ইন্দিরাকে আটকানো যাবে না তাই তারা সঞ্জীব রেড্ডির ব্যাপারে দৃঢ ছিলেন।
ইন্দিরা গান্ধী যদিওবা প্রার্থীতার ব্যাপারে কোনো উচ্চবাচ্য না করে ওয়ার্কিং কমিটির মিটিং থেকে বের হয়ে গিয়েছিলেন কিন্তু তিনি ভি ভি গিরিকে ইন্ডিপেন্ডেন্ট প্রার্থী হতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। ভি ভি গিরি তখন ৬০ কোটি ভারতবাসীর উদ্দেশ্যে পদত্যাগ পত্র লিখে রাষ্ট্রপতির টেবিলে রেখে রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে বের হয়ে ইন্ডিপেন্ডেন্ট প্রার্থী হিসেবে রাষ্ট্রপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন।
লোকসভা, রাজ্যসভা ও বিধানসভার সদস্যরা হচ্ছেন রাষ্ট্রপতির ইলেক্টোরাল কলেজ। ইন্দিরা গান্ধীর ভি ভি গিরির পক্ষে ভোট প্রার্থনা করেছিলেন শুধু টেলিফোনে আর ওল্ড সিন্ডিকেট সদস্যরা সঞ্জীব রেড্ডির প্রচারণা চালিয়েছিলেন প্রকাশ্যে। শেষ পর্যন্ত ভি ভি গিরি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। এর পরেই কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি কংগ্রেস থেকে ইন্দিরা গান্ধীকে বহিস্কার করে দেয়। তখনই প্রথমবারের মতো কংগ্রেস দ্বিধা বিভক্ত হয়। নাম হয় আদি কংগ্রেস এবং ইন্দিরা কংগ্রেস। ইন্দিরা কংগ্রেসের সভাপতি হন ইন্দিরা গান্ধী আর কার্যকরী সভাপতি হন কমলাপাতি ত্রিপাঠি।
Advertisement
সেই থেকে কংগ্রেস দল গান্ধী পরিবারকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। নেতৃত্ব সহজে গান্ধী পরিবারের বাইরে যায়নি। রাজীব গান্ধীর মৃত্যুর পরে নরসিমা রাও প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন গান্ধী পরিবারের কোনো বয়স্ক লোক ছিল না বলে। আর সোনিয়া গান্ধী তখন প্রধানমন্ত্রী হতে সম্মত ছিলেন না।
কংগ্রেস ভারতের প্রাচীনতম দল। তার বয়স এখন ১৩৪ বছর। ইংরেজরা নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির সূচনা করতে কংগ্রেসের জন্ম দিয়েছিল। কংগ্রেসের হাতেই ভারত স্বাধীন হয়। দীর্ঘদিন কংগ্রেস ক্ষমতায় ছিল তখন তার প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো দল ছিল না। ১৯২৫ সালে যদিওবা হিন্দু মহাসভা এবং ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির জন্ম হয়েছিল তখন তারাও সর্বভারতীয় দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। এখন হিন্দু মহাসভা বিজেপি নামে ভারতীয় রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত দল। সংঘ পরিবার তার নেপথ্যে কাজ করে। হিন্দু মৌলবাদই তাদের রাজনীতির মূল এজেন্ডা।
গত ২০ বছরে কংগ্রেস বিজেপি সাথে খুবই কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বীতার সম্মুখীন হয়েছে। বিজেপি এবং সংঘ পরিবারের সম্মিলিত শক্তি এখন প্রায় অপরাজেয় অবস্থায় রয়েছে। সর্বোপরি তাদের এজেন্ডা হচ্ছে হিন্দুত্ববাদ। ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ ভাষাভিত্তিক, অঞ্চলভিত্তিক জাতীয়তাবাদের চেয়ে সাধারণত শক্তিশালী হয়। দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর বিজেপি এবং সংঘ পরিবার তাদের পালে হাওয়া লাগাতে পেরেছে।
ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ কার্যকর ভূমিকায় আসতে একটা প্রতিপক্ষ সাব্যস্ত করতে হয়। বিজেপি তার প্রতিপক্ষ সাব্যস্ত করেছে ভারতের মুসলিম জনগোষ্ঠীকে। মুসলমানেরা ভারত শাসন করেছে প্রায় সাত শত বছর। সুতরাং হিন্দুদের মনে তো বহু দুঃখ বেদনা আছে। মুসলমানেরা ভারত বিজয় করে চলে যায়নি বরঞ্চ হিন্দুদেরকে মুসলমান করে ভিত্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছে। এখন ভারতে মুসলমানের সংখ্যা বিশ কোটির বেশি। বিজেপির উত্থানের পর পরিস্থিতি কঠিন রূপ নিয়েছে। সর্বশেষ মুসলিম অধ্যুষিত জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের স্বতন্ত্রতা বজায় রাখার ৩৭০ এবং ৩৫এ ধারা বিজেপি বাতিল করে দিয়েছে। কাশ্মীরে ভয়াবহ অবস্থা চলছে। মন বন্দিদশা কাশ্মীর আগে কখনও দেখেনি।
গত ১৬ই আগস্ট বিজেপি ঘেষা ইন্ডিয়া টুডে পত্রিকা এক জনমত জরিপের ফলাফল প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে নরেন্দ্র মোদীই সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় নেতা। অর্থাৎ তার কর্মকাণ্ডকে ভারতীয় মানুষ সমর্থন করছে। এমন এক কঠিন সময়ে সোনিয়া গান্ধী কংগ্রেসের সভাপতি হলেন যে কাশ্মীর সম্পর্কে ৩৭০ ধারা বাতিল করার পর নাগাল্যান্ড, মিজোরাম এবং মেঘালয় অর্থাৎ মনে করছে যে তাদেরকে ৩৭১ ধারায় যে মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে তাও অচিরেই বাতিল করা হবে। সুতরাং তারা গত ১৫ই আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবসের দিন তাদের নিজস্ব পতাকা নিয়ে মিছিল করেছে। জাতীয় সংহতিকে শুদ্ধ করতে গিয়ে নরেন্দ্র মোদী যে পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছেন তাতে মনে হচ্ছে যে ভারত গর্বাচেভের সোভিয়েরে অবস্থার সম্মুখীন হবে।
এখন প্রাচীন ও সর্বভারতীয় দল হিসেবে কংগ্রেসকে খুব সঠিক এবং সুদৃঢ় অবস্থান নিতে হবে। না হয় ভারতের সংহতি বিপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেবে। বৈচিত্রের মাঝে ঐক্য ছাড়া ভারত টিকতে পারেনা। সে জন্যই ভারতের স্থপতিরা লুজ ফেডারেশন গঠন করেছিলেন। নরেন্দ্র মোদী ফেডারেশনকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে শক্তিশালী করার যে উদ্যোগ নিয়েছেন তা সফল হবে বলে মনে হয় না। নেহরু-ইন্দিরা-রাজীব-সোনিয়ার কংগ্রেস ভারতকে ‘হিন্দু পাকিস্তান’ হওয়া থেকে কতটা ঠেকাতে পারে সেটা আরও দুশ্চিন্তার।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।anisalamgir@gmail.com
এইচআর/জেআইএম