সাহিত্য

সোনাবউয়ের চিঠি

আজ শুক্রবার। সকালে দেরি করেই ঘুম ভাঙল অনন্তের। ভাঙল বলতে, ইচ্ছা করেই দেরি করে উঠল। সপ্তাহে এই একদিনই দেরি করে ওঠে সে।

Advertisement

বৃহস্পতিবার রাত জেগে সিনেমা দেখে এবং মদ খায়। মদ খেলেও ধূমপানের মতো বদ অভ্যাস নেই তার। সেটা গর্বের সঙ্গেই সবাইকে বলে। আর মদ যে খায়, তা অনন্ত ছাড়া আর কেউ জানে না। গভীর রাতে একাকী বাসায় বসেই খায়।

শুক্রবার ইচ্ছামতো ঘুমায় অনন্ত। কারণ শুক্রবার বলে অফিস নেই তার। বুয়া বোধ হয় আসেনি। কারণ ভোরে দরজা খুলতে হয়নি। বেচারিরও তো সপ্তাহে একদিন ছুটি দরকার। যদিও মাঝে মাঝে বিনা নোটিশেই তিনি আসেন না। আড়মোড়া ভেঙে বিছানা থেকে নামে অনন্ত।

ব্রাশ হাতে নিয়ে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকায়। যদিও আজকাল দেয়াল ঘড়ির প্রয়োজন পড়ে না। তবুও দেয়ালে একটি ঘড়ি ঝুলিয়ে রাখাটা আভিজাত্যের মধ্যে পড়ে বলে রেখেছে। তাকিয়ে দেখে সাড়ে এগারোটা বাজে।

Advertisement

ফ্রেশ হয়ে ফ্রিজ খুলল অনন্ত। রাতে ভাত-তরকারি বেঁচে গিয়েছিল। বের করে ডাইনিং টেবিলে রাখল। এত ঠান্ডা খাবার মুখে দেওয়া যাবে না। গরম করে দুপুরের দিকে খেয়ে নেবে। দুপুরের জন্য রান্না করার ইচ্ছা নেই।

খাবার নামাতে গিয়ে মদের অবশিষ্ট চোখে পড়ে। বোতলে অর্ধেকটা রয়ে গেছে। মদ খেলেও ঘর অগোছালো হয় না অনন্তের। মদ খাওয়া শেষে সব গুছিয়ে রাখে। অবশ্য অতিরিক্ত মদ পানের অভ্যাস তার নেই।

বাসায় অনন্ত একাই থাকে। তা-ও প্রায় একযুগ। বয়স কত আর হবে? সাতচল্লিশ হবে আগামী ফেব্রুয়ারিতে। প্রথম দিকে অনন্তের সঙ্গে এক সহকর্মী থাকতো। মাঝেমধ্যে বান্ধবী বা যে কাউকে নিয়ে আসার অভ্যাস ছিল তার। বিষয়টি অনন্তের ভালো লাগেনি। নারীর প্রতি কোন টান তার নেই। ফলে বলে-কয়ে সে আপদ বিদায় করেছে। এরপর থেকে একা থাকার সিদ্ধান্ত নেয়।

এখন ডিসেম্বর। শহরে ভালোই শীত পড়েছে। আলনা থেকে শাল চাদরটা টেনে নিল। চাদরটি ময়লা হয়ে গেছে। বয়স তো কম হলো না চাদরের। অনন্ত এক মেয়েকে আবৃত্তি শেখাতো। খুশি হয়ে মেয়ের বাবা চাদরটি তাকে উপহার দিয়েছিল। চাদর গায়ে দিতে দিতে অতীতের কিছু স্মৃতি নাড়া দেয়। মুচকি হাসে সে। সেসব কেবলই স্মৃতি।

Advertisement

হালকা রোদ উঠেছে আজ। জানালাটা খুলে দিল। গলির রাস্তায় শিশুরা ক্রিকেট খেলছে। সপ্তাহে এই একটি দিনই ওরা মহল্লাটা মাতিয়ে রাখে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে ওদের খেলা দেখে। অনন্তের ভালো লাগে বাচ্চাদের ছুটোছুটি দেখতে। মনে মনে ভাবে, ওই দলে আজ তারও একটি ছেলে থাকতো। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে।

ছুটির দিনে সময় যেন কাটে না। তাই সময় কাটাতে অনন্ত বই পড়ে, লেখালেখি করে কিংবা পুরনো কাগজপত্রের ফাইল ঘেটে স্মৃতি রোমন্থন করে। নিঃসঙ্গতার এই একটা খারাপ দিক, মাঝে মাঝে কিছুই ভালো লাগে না। তেমনি আজও কিছুই ভালো লাগছে না। তবুও পুরনো কলেজ ফাইলটা বের করল।

অনন্তের আলাদা আলাদা কিছু ফাইল আছে। কোনটা মাধ্যমিক, কোনটা উচ্চমাধ্যমিক, কোনটা কলেজ জীবনের। আবার পুরস্কার বা সনদের আলাদা ফাইল আছে। হাতে লেখা চিঠির ফাইলও আছে একটি।

অনন্ত আজ যাবতীয় শিক্ষা সনদ, বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় পাওয়া সনদ, বিভিন্ন জনের পাঠানো চিঠি খুলে বসল। তখনো মুঠোফোন আসেনি হাতে হাতে। চিঠিই ছিল ভরসা। কী প্রেম, কী বন্ধুত্ব বা পারিবারিক যোগাযোগ—সব কাজেই চিঠি ছিল একমাত্র মাধ্যম।

পুরনো চিঠি ঘাটতে ঘাটতে একটি চিঠি সামনে আসে অনন্তের। সোনাবউয়ের চিঠি। অনন্তের কাছে লেখা। বুকের ভেতরটা কেমন খচখচ করে ওঠে। চিঠিটা মেলে ধরে চোখের সামনে। শব্দগুলো এখনো যেন জ্বলজ্বল করছে। মনে হয়, এই তো সেদিনের চিঠি। অথচ পেরিয়ে গেছে একযুগ। অনন্ত পড়া শুরু করে—‘প্রিয় অনন্ত,তুমি কেমন আছো? জানি, তুমি ভালো নেই। তুমি ভালো নেই, আমি কি ভালো আছি? আমিও ভালো নেই। বিশ্বাস করো, ওইদিন আমি তোমার কোন দোষ দেইনি।

আপুর কাছে বলেছি একটা, ও আম্মু-আব্বুর কাছে বলেছে আরেকটা। পরে তোমাকে কল করে অনেক কিছু বলেছে। এরজন্য সরি। তুমি আমাকে ভুল বুঝ না।

আমি আব্বু-আম্মু, ভাইয়া, আপু সবার কাছে তোমার-আমার ব্যাপারটা সব খুলে বলেছি। তারা আমাকে তারপর আর কিছু বলেনি।

তুমি আমাকে কোন দোষ দিও না। আর শোন, তুমি একটু শরীরের প্রতি যত্ন নিও। ঠিকমত নামাজ পড়। সকাল বেলা ঠিক সময়মতো খাবার খাবে। সকাল বেলা একটা করে ডিম খাবে। আর দাড়ি ফালাবে না। ছোট ছোট করে কেটে রাখবা। নখ কাটবা। চুল ছোট করে কাটবা।

জরুরি কথা হচ্ছে—১৬ ডিসেম্বর মাঠে থাকবে। সেখানে হয়তো তোমার সাথে দেখা হতে পারে।

আমার পরিবারের জন্য তোমার কাছে আবারও সরি বললাম। তুমি আমাকে ক্ষমা করবে না? সকাল বেলা দেখলাম তোমাকে। তুমি আমার দিকে তাকাও কি তাকাও না।

সেদিন রাতে ভাইয়া আমাকে ঝাড়ু দিয়ে পিটিয়েছে। তাতে আমি কষ্ট পাইনি। আমি শুধু ভেবেছি, ভাইয়া যেন তোমাকে কিছু না বলে।

আচ্ছা, বাবা-মাদের কি কোন সেন্স নেই? সেদিন তোমার সাথে ভালোভাবে কথাও বলতে পারলাম না। তোমাকে একটু আদরও করতে পারলাম না। এত কষ্টের মধ্যে যদি আরও কষ্ট দেয়। তাহলে সেই মেয়ে বাঁচে? কিন্তু আমি বাঁচব। এতে কোন সন্দেহ নেই। কারণ আমি যে সুখের অধিকারীনি, সেই সুখ আমি নিয়েই ছাড়ব।

শুধু একটা কথা, তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যেও না। যেখানেই থাকি—তুমি মনে করবা, আমি তোমার পাশে আছি। আর কিছু লিখলাম না। ভালো থাকো। ইতি, তোমার সোনাবউ।

বি. দ্র. তোমাকে আপু যে কথা বলেছে, সব বানানো। এরজন্য আমি সবার সাথে রাগারাগি করেছি। এমনকী রাতে ভাতও খাইনি। সরি। রাগ করো না সোনা। রাগ করে আবার ভুলে যেও না যে, ২৭ ডিসেম্বর আমার জন্মদিন। আমি কিন্তু ভুলিনি, তোমার জন্মদিন পহেলা ফেব্রুয়ারি।’

চিঠি পড়া শেষ হতেই উচ্চস্বরে হাসে অনন্ত। কী সহজ-সরল ভাষা। সাবলীল ভঙ্গি। সাহিত্যের মারপ্যাচ নেই। আবেগের আতিশয্য নেই। অথচ সবটুকু আবেগ যেন উপচে পড়ছে। দরদমাখা এই চিঠির মানুষটি আজ পাশে নেই। হৃদয়ের সবটুকু ভালোবাসা দিয়েও সোনাবউ পায়নি অনন্তকে।

তখন বাস্তবতার কাছে হেরে যায় ভালোবাসা। প্রতিষ্ঠা নামক কালো ছায়া তাদের বিচ্ছিন্ন করে দেয় একমুহূর্তেই। সোনাবউকে কখনোই দোষ দেয় না অনন্ত। তবে ভুলে থাকার চেষ্টা করে। তা-ও পারে না। শুধু সোনাবউয়ের জন্যই আজ তার এ বৈরাগ্য, নিঃসঙ্গ, একাকী জীবন। সোনাবউ তা কি জানে না?

এ সময় মনে পড়ে তারই লেখা একটি গান। টেবিলে রাখা ডায়েরিটা বের করে। ধুলো জমে গেছে। রুমাল দিয়ে মুছে নেয়। ডায়েরির মতো গানটিও পুরনো। তবে গানটি এখনো সুর করা হয়নি। সুর করার জন্য কাউকে দিয়ে দেবে ভাবছে। গানের কথাগুলো এক নিমিষেই মনে পড়ে—‘তুমি চাইলে মন্দ আমি ভালো হতে পারি,তুমি চাইলে ভালো আমি মন্দ হতে পারি।।তুমি চাইলে এপার ছেড়ে ওপারে দেই পাড়ি,তুমি চাইলে তোমার হুকুম মাথায় তুলে ধরি।। ঐ

তুমি চাইলে এক নিমিষে হয়ে যাই চুপচাপ,তুমি চাইলে তপ্ত রোদেও বৃষ্টি টিপটাপ।তুমি চাইলেই বিনামেঘে হয় যে বজ্রপাততুমি চাইলেই যখন-তখন হয় অপঘাত।। ঐ

তুমি চাইলে একমুহূর্তে প্রেমে মজে যাই,তুমি চাইলে এই আছি, এই আমি নাই।তুমি চাইলে একটি গল্প লিখে যেতে চাই,তুমি চাইলে একাই নেব পুরো নোবেলটাই।। ঐ

তুমি চাইলে অন্ধ আমি দু’চোখে পাই আলো,তুমি চাইলে সর্বহারা দুঃখেও থাকি ভালো।তুমি চাইলে আমার আমি আমাকে খুঁজে পাই,তুমি চাইলে আমার ভুবনে অন্য কেউ তো নাই।। ঐ’

গানে গানে মনে পড়ে অতীতের কত কথা। অথচ সোনাবউয়ের কোন কথাই সে রাখতে পারেনি। মাথার চুলগুলো কাঁধ ছুঁয়েছে। আঙুলের নখগুলো বড় হয়ে গেছে। কাটা হয় না বহুদিন। ডিম খাওয়া একেবারেই বন্ধ করে দিয়েছে। দাড়ি ফালায় না ঠিক, তবে তা রবীন্দ্রনাথের দাড়িকেও ছাড়িয়ে গেছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিল্প নির্দেশক অনন্তের বেশভুষা অফিসের কারো ভালো লাগে না। সে কথা অনন্ত জানে। তবুও বসের একান্ত প্রিয়ভাজন বলে কেউ কিছু বলে না।

সেসব ভাবার সময় নেই অনন্তের। তবে চিঠির শেষে হঠাৎ মনে পড়ে, আজই তো ২৭ ডিসেম্বর। এই দিনটিতে শুভ কামনা জানাতে কখনোই কার্পণ্য করেনি অনন্ত। যদিও বিচ্ছেদের পর অনেক ২৭ ডিসেম্বর চলে গেছে। মনে পড়েনি অনন্তের। কিন্তু আজ কেন পুরনো চিঠি স্মরণ করিয়ে দিল দিনটিকে?

অনন্ত অবাক হয়। অনেকটা কাকতালীয় মনে হয়। কেমন আছে সোনাবউ? জানতে খুব ইচ্ছে হয়। পুরনো ফোনটি হাতে নেয়। সেভ করা নম্বরের ভেতর থেকে বের করে আনে সোনাবউয়ের ফোন নম্বর। সেই পুরনো নম্বর।

সোনাবউয়ের বিয়ের পর আর যোগাযোগ হয়নি এ নম্বরে। বিয়ের এক সপ্তাহ আগে ফোন করে খুব কেঁদেছিল সোনাবউ। অনন্ত অসহায়ের মতো শুনেছে। কিছুই বলতে পারেনি। বলার মতো ক্ষমতাও ছিল না তার। আবেগের বশে কোন সিদ্ধান্তও নেয়নি। সোনাবউ শুধু অনন্তের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় ছিল।

অনন্তের চোখের কোণে পানি। নিজেই টের পায়। আজ এতদিন পর এতো কান্না কোথা থেকে আসে? নম্বরে ডায়াল করে। ‘দুঃখিত, আপনি যে নম্বরে ডায়াল করেছেন, তা এই মুহূর্তে বন্ধ আছে’। শোনার পরেও তিনবার ডায়াল করে।

এসইউ/পিআর