পঞ্চগড়ে কারা হেফাজতে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যাওয়া আইনজীবী পলাশ রায় (৩৬) নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে ‘আত্মহত্যা’ করেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। বুধবার হাইকোর্টের বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি মো. বদরুজ্জামানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়।
Advertisement
আদালতে এদিন প্রতিবেদনের অংশবিশেষ পড়ে শোনান রিট আবেদনকারী ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। শুনানিতে আদালত বলেন, ‘অ্যাপারেন্টলি দিস ইজ দ্য কেস অব সুইসাইড’ (আপাতত এটি আত্মহত্যার ঘটনা বলে ধারণা করা হচ্ছে)।
আদালত আইনজীবী পলাশ কুমার রায়ের মৃত্যুর ঘটনা ও কারাগারের অব্যবস্থাপনার বিষয়ে স্বরাষ্ট্র সচিব ও আইজি প্রিজনকে ব্যাখ্যা দেয়ার নির্দেশ দেন আদালত। আগামী ১৫ অক্টোবরের মধ্যে বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি মোহাম্মদ বদরুজ্জামানের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
পরে রিটকারী আইনজীবী সুমন সাংবাদিকদের জানান, হাইকোর্টের নির্দেশে বিচারিক কোর্টের ম্যাজিস্ট্রেটের তদন্তে আইনজীবী পলাশ কুমার রায়ের মৃত্যু আত্মহত্যা বলে তথ্য উঠে এসেছে। তিনি জানান, প্রতিবেদনে পলাশ কুমার রায় আত্মহত্যা করেছেন, এমনটি বলা হয়েছে। কিন্তু ২৪ ঘণ্টা লেগেছে তার ট্রিটমেন্ট (চিকিৎসা) করতে। ট্রিটমেন্টের জন্য এই কারাগার থেকে ওই কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।
Advertisement
‘শুধু প্রক্রিয়া ও প্রসিডিউর মেন্টেইন করতে, দাপ্তরিক কার্যক্রম শেষ করতে ২৪ ঘণ্টা লেগেছে। আদালত বলেছেন যে, যদি ২৪ ঘণ্টার কমে তার চিকিৎসা শুরু করা যেত, আমরা জানি না সে বাঁচত কি-না, কিন্তু উচিত ছিল আগুনে পোড়ার সাথে সাথে যে জায়গায় চিকিৎসা করানোর দরকার ছিল, আগে চিকিৎসার পর দাপ্তরিক কাজ সম্পন্ন করা।’
তিনি বলেন, ওই প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে স্বরাষ্ট্র সচিব ও আইজি প্রিজন্সকে এ প্রতিবেদনের রিপ্লাই দিতে বলা হয়েছে। কারাগারের অব্যবস্থাপনা ও চিকিৎসার বিষয়ে ওনাদের লিখিত জবাব দেয়ার জন্য। আগামী ১৫ আগস্ট পরবর্তী আদেশের দিন ঠিক করেছেন হাইকোর্টের বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি মো. বদরুজ্জামানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ।’
পলাশের চিকিৎসায় গাফিলতি এবং কারাগারে আগুন বা দিয়াশলাই কীভাবে অবাধে ঢুকছে- এ বিষয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেন হাইকোর্ট। আদালত বলেন, আইনজীবী পলাশ রায়ের গায়ে আগুন ধরার পর যদি তাৎক্ষণিক চিকিৎসা দেয়া যেত হয়তো তাকে বাঁচানো সম্ভব ছিল। আমরা বলব না বাঁচত, কিন্ত চেষ্টা করলে হয়তো বাঁচানো যেত।
প্রতিবেদনে বলা হয়, পঞ্চগড় আদালতের ভেতরে কোনো সিসি ক্যামেরা নাই, ভেতরে ঢোকার জন্য কোনো আর্চওয়ে নাই, কারা ক্যান্টিনে গ্যাস ম্যাচ দিয়ে অবাধে আগুন ধরানো হয় এবং ধূমপান চলে। চাল-ডালের গাড়ি কারাগারের ভেতরে ঢোকার সময় হুক ঢুকিয়ে দিয়ে তা পরীক্ষা করা হয়। এছাড়া সেখানে ভারপ্রাপ্ত জেলার দায়িত্ব পালন করেন।
Advertisement
পঞ্চগড় কারা হাসপাতালে কোনো চিকিৎসক নেই। একজন ডিপ্লোমা নার্স সার্বক্ষণিক থাকেন। এ ছাড়া যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত এক আসামি সার্জিক্যাল বিভাগের চিকিৎসকের সরঞ্জামের সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে আছেন। তিনি চাইলেই যে কোনো ছুরি বা কাঁচি অন্যদের হাতে তুলে দিতে পারেন। এছাড়া আইনজীবী পলাশ রায়ের গায়ে আগুন লাগার পর দাপ্তরিক কাগজপত্র ঠিক করতেই অনেক সময় ব্যয় করা হয়েছে, এরপর চিকিৎসার জন্য এই হাসপাতালে, ওই হাসাপাতাল নেয়া হয়। এরপর তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। দাপ্তরিক জটিলতায় চিকিৎসা দিতে দেরি হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
এ সময় প্রতিবেদনে তথ্যের প্রসঙ্গ টেনে আদালত বলেন, কারাগারে চিকিৎসা ‘মুন্নাভাই এমবিবিএস’ এর অবস্থা হয়েছে আর-কি! যে ডাক্তার দেখানোর আগে ফরম পূরণ করতে হবে। একজন মানুষ দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার পর তাকে চিকিৎসা দেয়া দরকার, দাপ্তরিক কাজের জন্য কারও চিকিৎসা আটকে থাকা উচিত নয়।
পঞ্চগড় জেলা কারাগারের টয়লেটে অগ্নিদগ্ধ পলাশ মারা যান গত ৩০ এপ্রিল। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে তিনি চিকিৎসাধীন ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে কটূক্তি করার অভিযোগে গত ২৫ মার্চ তাকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়।
গত ২৬ এপ্রিল কারাগারের অভ্যন্তরে পলাশ কুমার রায়কে অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করে প্রথমে পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতাল এবং পরে তাকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।
আইনজীবী পলাশ রায় মারা যাওয়ার ঘটনায় ব্যারিস্টার সুমন রিট আবেদন করেন। ওই রিটের শুনানি নিয়ে গত ৮ মে পঞ্চগড়ের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের তত্ত্বাবধানে বিচারিক তদন্ত করার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। সঙ্গে সঙ্গে রুলও জারি করেন আদালত।
জারি করা রুলে কারাগারে কারাবন্দিকে যথাযথ নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থতা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চান হাইকোর্ট। ওই আদেশ অনুযায়ী বিচারিক তদন্তের পর হাইকোর্টে প্রতিবেদন দাখিল করা হয় আজ।
বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের তালিকাভুক্ত আইনজীবী পলাশ জেলার আটোয়ারী উপজেলার আলোয়াখোয়া ইউনিয়নের বড়সিংগিয়া গ্রামের প্রণব কুমার রায়ের ছেলে। তার বিরুদ্ধে একটি প্রতিষ্ঠানের করা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে গত ২৫ মার্চ দুপুরে মানববন্ধন করার সময় প্রধানমন্ত্রীর নামে পলাশ কটূক্তি করেন বলে অভিযোগ ওঠে। রাজীব রানা নামে এক তরুণ তার বিরুদ্ধে সদর থানায় মামলা করেন।
এফএইচ/এমএআর/জেআইএম