এবারের ঈদযাত্রায় নজিরবিহীন ভোগান্তির কথা সবার জানা। এজন্য মন্ত্রী থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট অনেকে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন, আশ্বাস দিয়েছিলেন ফিরতি পথে এতোটা ভোগান্তি হবে না। কিন্তু সেই উজির নাজিরদের কথা। দিন যায়, মাস যায়। সময় বদলায় না। কেউ কথা রাখে না। কোনো নজরদারি হয় না। সে কারণে এবারের ফিরতি ঈদযাত্রাও হয়ে উঠেছিল ভয়ংকর। বিশেষ করে ট্রেনে।
Advertisement
সড়কপথে ফিরতি যাত্রায় কিছুটা যানজটে পড়তে হলেও মোটামুটি স্বস্তির ছিল। কিন্তু সেই স্বস্তি কেড়ে নিয়েছিল দুর্ঘটনায় প্রাণহানি। সারি সারি লাশ যেন মনে করিয়ে দিচ্ছিল এই পথে গাড়ির চালকদের তদারকি করার কেউ নেই। না গাড়ির মালিক, না আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা। যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাব মতে ঈদের আগে পরে মিলিয়ে দু’সপ্তাহে সড়কপথে প্রাণ গেছে ২২৪ জনের।
ঈদযাত্রায় ট্রেনের দেরিতে আসা যাওয়া হার মানিয়েছিল। দেরি হতে হতে এমন হয়েছিল আজকের ট্রেন কালকে ছেড়েছে আর শেষ মুহূর্তে বাতিল করতে হয়েছে ট্রেনযাত্রা। ঈদের দিন কোনো বিশেষ ট্রেন চলেনি। আশা ছিল ফিরতি পথে যেহেতু লোকজনের চাপ কম থাকে। ধীরে ধীরে কর্মস্থলে ফিরে লোকজন সে কারণে হয়তো অতোটা ভোগান্তি হবে না। কিন্তু সে গুড়েবালি। ফিরতি পথে উত্তরবঙ্গ ফেরত সব ট্রেন এসেছে পাঁচ থেকে ছয়ঘণ্টা দেরিতে। বলতেই হয় আকাশ ও নৌপথে ছিল অনেকটাই স্বস্তি।
কিন্তু সড়কপথে কান্নায় ভারী হয়ে উঠে পরিবেশ। বিশেষ করে ঈদের ছুটিতে আনন্দ করতে গিয়ে যারা আর ফেরেনি প্রিয়জনের কাছে তাদের জন্য কতেটা কষ্টের সেটা অনুভবের বিষয়। কুমিল্লার লালমাই উপজেলায় বাস ও অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষে একই পরিবারের পাঁচজনসহ সাতজন নিহত হয়েছেন। ময়মনসিংহের গৌরীপুরে বাসের চাপায় মারা গেছেন প্রাইভেটকারে থাকা একই পরিবারের পাঁচজন। এদের মধ্যে বেঁচে আছে শুধু পরিবারের একমাত্র শিশু।
Advertisement
সিরাজগঞ্জের বেলকুচিতে বাসের ধাক্কায় অটোরিক্সার ১১ যাত্রী হতাহত হন। যাদের মধ্যে একই পরিবারের রয়েছেন দশ জন। যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে, কোরবানির ঈদের আগে-পরের ১২ দিনে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ২২৪ জন নিহতের এবং ৮৬৬ জন আহত হয়েছেন। আর সড়ক নৌ ও রেলপথ সম্মিলিতভাবে ২৪৪টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২৫৩জন।
নিহতদের ‘অর্ধেকের বেশি’ পথচারী এবং তারা গাড়িচাপায় প্রাণ হারিয়েছেন বলে জানিয়েছে যাত্রী কল্যাণ সমিতি। এর মধ্যে ৬৭টি ঘটেছে মোটরসাইকেলের সঙ্গে অন্যান্য যানবাহনের সংঘর্ষে। ঈদের আগে পরে সড়ক দুর্ঘটনা যে কতোটা ভয়ংকর সেটি গেলো কয়েকবছর ধরে বেশ আলোচনায় আসছে। এসব নিয়ে নানা মহলে লেখালেখি ও সুপারিশমালা দেয়া হলেও বিস্ময়করভাবে প্রতিরোধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। বা হলেও সেটি কার্যকর নয়।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট (এআরআই) গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে যে গবেষণা করেছে তাতেও বলা হয়েছে, ঈদের ফিরতি যাত্রার সময় প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে সড়ক। ঈদের দিন থেকে পরবর্তী এক সপ্তাহ দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি দুটিই বেড়ে যায়। ঈদের সময় সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনার শিকার হন পথচারীরা। আবার বাস ও মোটরসাইকেলে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে। যে কোনো জরিপেই সড়ক পথে দুর্ঘটনার জন্য যে বিষয়টি দায়ী করা হয় একইসঙ্গে দুর্ঘটনার শিকার বা প্রত্যক্ষদর্শীরা যেটি জানায়, তা হলো যানবাহনের বেপরোয়া গতি।
ঈদের আগে যানজটের কারণে সড়ক-মহাসড়কে যানবাহন খুব বেশি গতিতে চালানো যায় না। তাছাড়া সরকারি কর্তৃপক্ষও থাকে সরব। সে কারণে যাত্রী বেশি নেয়া হলেও দুর্ঘটনা অনেকটা কম হয়। কিন্তু ঈদের ফিরতি যাত্রার চিত্র পুরোটাই উল্টো। গাড়ি থাকে কম, সড়ক অনেকটাই ফাঁকা, চালকও থাকে বেশিরভাগ অদক্ষ সে কারণে ইচ্ছেমতো গাড়ির গতি ওঠে। দ্রুত যাত্রী নামিয়ে ফের যাত্রী তোলার জন্য ছুটে গাড়ি।
Advertisement
এ সময় ক্লান্তও থাকেন চালক। নিয়মানুযায়ী একটানা পাঁচঘণ্টার বেশি গাড়ি চালানো উচিত নয়। সাধারণ সময়ে মানা হয় না, ঈদের আগে পড়ে তো গাড়ি চালান বিশ্রাম ছাড়াই। চালক-মালিক দুই পক্ষই বাড়তি আয়ের আশায় ঈদের আগে-পরে ১৫ দিন বিরামহীন বাস চালিয়ে থাকেন। ১৯৯৮ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনার কারণ নিয়ে এআরআই একটি গবেষণা করেছে। এই গবেষণার তথ্য বলছে, দেশে ৫৩ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোর জন্য। আর চালকদের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে দুর্ঘটনা ঘটে ৩৭ শতাংশ। পরিবেশ-পরিস্থিতিসহ অন্য কারণে দুর্ঘটনার পরিমাণ ১০ শতাংশ। আবার এ সময়ে ফিটনেসবিহীন যান, মহাসড়কে চলাচল অনুপযোগী যান, পণ্যবাহী যানবাহনে যাত্রী বহনতো রয়েছেই।
এছাড়া ঈদের পর সবার মধ্যে কেমন একটা গা ছাড়া ভাব কাজ করে। সে কারণে জোরদার মনিটরিং বলতে যেটা বোঝায় সেটা হয় না। আড্ডাপ্রিয় বাঙালি জাতি, রাস্তায় থাকা ট্রাফিকও মেতে উঠেন খোশগল্পে। চালকের প্রশিক্ষণ রয়েছে কিনা, লক্করঝক্কর ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহন বন্ধ করা, চালক- হেলপারের কর্মঘণ্টা মনিটরিং, পর্যাপ্ত বিশ্রাম, যানবাহনের ক্রটি দেখা এসব বিষয়ে সারাবছর যতোটুকু মনযোগ থাকে ঈদের পরে সেটা থাকে না বললেই চলে। সে বিষয়টি শুধুমাত্র টেলিভিশনের পর্দায় মন্ত্রীরা উপস্থাপন না করে কাজের ওপরেই জোর দিতে হবে। সেটি হলেই আনন্দের যাত্রায় কোনো স্বজন হারাবে না তার প্রিয়জনকে।
কোনো শিশু পিতা-মাতার আদরের আশায় অনন্তকাল বসে থাকবে না প্রিয় খেলনা সাজিয়ে। কিংবা বাবা মায়ের সন্তান হারানোর আর্তনাদ টিভি পর্দা ভেদ করে বাজবে না আবেগী মানুষের হৃদয়ে। আইনের কঠোর প্রয়োগই পারে একটি দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না ঠেকাতে।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক।
এইচআর/এমকেএইচ