বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরের পর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সরব হয়েছে মিয়ানমার সরকার। এরই বহিঃপ্রকাশ আগামী ২২ আগস্ট তিন হাজার ৪৫০ জন রোহিঙ্গাকে ফেরত নিতে রাজি হওয়া। এটি বাস্তবায়নে দুই দেশের মাঝে চলছে তোড়জোড়ও। এসব কারণে সম্মানজনক প্রত্যাবসনে আশাবাদী হয়ে উঠছেন রোহিঙ্গারা।
Advertisement
গত মাসে কুতুপালং ক্যাম্প পরিদর্শনে আসা মিয়ানমার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী সচিব ইউ মিন্ট থুর নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ের ডেলিগেশন টিম রোহিঙ্গারা ফিরে গেলে তাদের জীবন-জীবিকা কীভাবে নির্বাহ হবে এবং যোগাযোগ, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ সরকারের পক্ষ থেকে গৃহীত পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেন। কিন্তু নাগরিকত্বের বিষয়ে কোনো কথা না বলায় রোহিঙ্গাদের মাঝে শঙ্কাও ভর করছে বলে ক্যাম্পের নেতারা জানিয়েছেন।
তবে বাংলাদেশ সম্প্রতি চীনের সহযোগিতার যে আশ্বাস পেয়েছে সেই সহযোগিতা আদায় করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখলে রোহিঙ্গারা নাগরিকত্ব পাবেন বলে আশাবাদী রোহিঙ্গা নেতারা।
১৯৯১ সালের পর আসা রেজিস্টার রোহিঙ্গা ক্যাম্পের চেয়ারম্যান রশিদ মাঝি বলেন, মিয়ানমার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী সচিব ইউ মিন্ট থুর নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ের ডেলিগেশন টিমের রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক চীন সফরের পর রোহিঙ্গাদের ভাগ্য ফেরার লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি। মানবতার মা হিসেবে স্বীকৃত শেখ হাসিনা চীনের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখতে পারলে রোহিঙ্গারা নাগরিকত্বসহ সকল মৌলিক অধিকার ফিরে পাবে বলে আমাদের সবার বিশ্বাস।
Advertisement
রোহিঙ্গা ক্যাম্প ২৬ এর মাঝি বজরুস আলম বলেন, সোমবার সকাল থেকে শালবাগান ক্যাম্প হল রুমে ইউএনএইচসিআর প্রতিনিধি ও ক্যাম্পভিত্তিক রোহিঙ্গা নেতাদের সঙ্গে প্রত্যাবাসন বিষয়ে বৈঠক হয়েছে। এতে মিয়ানমার কর্তৃক ক্লিয়ারেন্স দেয়া তালিকা অনুসারে ক্যাম্প ২৪, ২৫, ২৬ ও ২৭-এ বসবাসকারী রোহিঙ্গা রয়েছে। মিটিংয়ের পর সারাদিন এদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে মঙ্গলবার সকালে ২৬ নম্বর ক্যাম্পের হল রুমে বাড়ির কর্তাদের মিটিংয়ে আসার জন্য বলা হয়েছে। সেখানে তাদের জানানো হবে, জোর করে প্রত্যাবাসন হবে না, মিয়ানমার সরকারের প্রতিশ্রুতি অনুসারে প্রত্যাবাসিত রোহিঙ্গাদের সকল সুযোগ সুবিধা দেয়া হবে। তাই মিয়ানমারের ইচ্ছায় চলে গেলে রোহিঙ্গাদের উপকারই হবে।
কুতুপালং ক্যাম্প ম্যানেজমেন্ট কমিটির সেক্রেটারি মুহাম্মদ নূর বলেন, কালক্রমে ধারাবাহিক নির্যাতনের শিকার হয়ে নব্বই দশকের আগে থেকে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসা শুরু করে। ২০১২ সালে এক সঙ্গে অর্ধলাখ রোহিঙ্গা এসে আশ্রয় নেয় কুতুপালং ক্যাম্প এলাকায়। এরপর ২০১৭ সালে আসে বিশাল সংখ্যক নির্যাতিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। সবাইকে এক জায়গায় করে নানা সহযোগিতা দেয়া হলেও এসব চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। পলিথিনের ১০ বাই ১২ বা ১৫ বাই ২০ সাইজের একটি ঘরে ৫-১০ জন লোক গাদাগাদি বাস করা কত কষ্টের তা এক মাত্র ভুক্তভোগীই জানেন। তাই মৌলিক অধিকারটুকু পেলে আমরা স্বউদ্যোগে মিয়ানমার ফিরে যাব।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের বিষয়ে প্রথম যৌথভাবে কাজ করছে। ২২ আগস্ট তিন হাজার ৪৫০ জনকে ফেরত নিতে কাজ চলছে। এরপরও প্রক্রিয়া শেষ পর্যন্ত সফল হবে কি-না এ নিয়ে কিছুটা শঙ্কা রয়েছে। যাই ঘটুক প্রত্যাবাসনের জন্য মাঠপর্যায়ে সবধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে বাংলাদেশ।
কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মো. আবুল কালাম বলেন, দুই দফায় ২২ হাজার ৪৩২ এবং ২৫ হাজার সাতজন রোহিঙ্গার তালিকা মিয়ানমারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এদের মধ্য থেকে প্রাথমিকভাবে তিন হাজার ৪৫০ জন রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার ক্লিয়ারেন্স দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত যাই হোক, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন শুরু হতে যাওয়াটা ইতিবাচক। আমরা শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চাই। আমরা মাঠপর্যায়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বাস্তবায়নে সব ধরনের প্রস্তুত নিয়েছি। এ লক্ষ্যেই রোববার বৈঠকে বসেছিলেন টাস্কফোর্সের সদস্যরা।
Advertisement
রোববার পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেন, যেকোনো সময়ে প্রত্যাবাসন শুরু হবে। পর্দার অন্তরালে অনেক কিছুর চেষ্টা হচ্ছে। তবে সব চেষ্টা সফল হবে এমন নয়। আমরা রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরে যেতে উৎসাহিত করছি। প্রত্যাবাসন রোহিঙ্গাদেরও প্রধান উদ্দেশ্য। তারা সেখানে না ফিরলে সেখানকার সব অধিকার হারাবে।
উল্লেখ্য, গত বছরের নভেম্বরে মিয়ানমার ও বাংলাদেশ দুই হাজার রোহিঙ্গা রাখাইনে প্রত্যাবাসনে সম্মত হয়। কিন্তু নাগরিকত্ব ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা না পাওয়ায় রোহিঙ্গারা ফিরতে অস্বীকৃতি জানালে পুরো প্রক্রিয়া থমকে যায়।
গত ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর থেকে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা। এর আগে বিভিন্ন সময়ে আরও প্রায় পাঁচ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় আশ্রয় নেয়। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা রোহিঙ্গাদের উখিয়া-টেকনাফের ৩১টি ক্যাম্পে জড়ো করে আশ্রয় দেয়া হয়েছে। এরপর কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় তাদের প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়া চালানো হয়। কিন্তু দফায় দফায় চেষ্টা করেও প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হয়নি। গত বছরের শেষ সময়ে এবং চলতি বছরের শুরুতে প্রত্যাবাসন শুরুর কথা দিয়েও সে কথা রাখেনি মিয়ানমার। মিয়ানমার সরকার ১৩৫টি জাতিগোষ্ঠীকে সংখ্যালঘু জাতি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। রোহিঙ্গারা এ তালিকার অন্তর্ভুক্ত নয়।
গত মাসে দুই দেশের প্রতিনিধি দলের বৈঠকে প্রত্যাবাসন চুক্তির অংশ হিসেবে যাচাই-বাছাইয়ের জন্য মিয়ানমারের হাতে যে ২৫ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা বাংলাদেশ দিয়েছিল। সেখান থেকেই ৩ হাজার ৫৪০ জনকে নেয়ার বিষয়ে ছাড়পত্র মেলার কথা জানিয়েছিলেন মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মিন্ট থু।
সায়ীদ আলমগীর/আরএআর/এমএস