২২ মাস বয়সী আমরীন। চার-পাঁচদিন ধরে জ্বরে ভোগা এই শিশুর ডেঙ্গু জ্বর হয়েছে কি-না, তা নিশ্চিত হতে আইজিএম, আইজিজি পরীক্ষা করতে দেয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে।
Advertisement
গতকাল রোববার (১৮ আগস্ট) পরীক্ষা করতে দেয়া হয় এবং তার রিপোর্ট (প্রতিবেদন) আনতে আজ সোমবার ঢামেকের ডেঙ্গু সেলে যায় তার পরিবার। আইজিএম ও আইজিজি পরীক্ষা দিলেও ডেঙ্গু সেল থেকে তাদের দেয়া হয় এনএস-১ পরীক্ষার প্রতিবেদন!
ঢামেকে ডেঙ্গু রিপোর্টের অপেক্ষায় রোগীর স্বজনরা
হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত ভর্তি রোগীর সংখ্যা কমেছে। আশা করছি, এ সংখ্যা আর বাড়বে না- স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে এমন আশাবাদ ব্যক্ত করা হলেও আতঙ্ক যেন কমছে না। ঢামেকের ডেঙ্গু সেল থেকে ওলটপালট প্রতিবেদন দেয়ায় রোগীর স্বজনদের মধ্যে আতঙ্ক যেন আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
Advertisement
সোমবার বেলা ১১টার দিকে এমন ওলটপালট প্রতিবেদন দেয়া হয় ঢামেক থেকে। শুধু তাই নয়, রোগীর নাম, বয়স, লিঙ্গ, তারিখ– কোনো কিছুই উল্লেখ নেই ডেঙ্গু পরীক্ষার এ প্রতিবেদনে।
ডেঙ্গু রোগী চিহ্নিত করার পরিচয়হীন এই প্রতিবেদনে সই করেছেন ঢামেক হাসপাতালের ল্যাবরেটরি মেডিসিন বিভাগের মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ও ক্লিনিক্যাল প্যাথলোজিস্ট।
ঢামেকে ডেঙ্গু রিপোর্টের অপেক্ষায় রোগীর স্বজনরা
শিশু আমরীনের বাবার নাম মো. মামুন। তারা থাকেন রাজধানীর শনির আখড়ায়। ভিড়ের কারণে ডেঙ্গু রিপোর্ট প্রদানকারীদের সঙ্গে কথা বলতে না পেরে বিষয়টি ডেঙ্গু সেলের এক নার্সকে দেখান মামুন।
Advertisement
ওই নার্স জানান, হয়তো ভুলে এ প্রতিবেদন আমরীনকে দেয়া হয়েছে।
সোমবার সকালে আমরীন ছাড়াও ডেঙ্গু জ্বর চিহ্নিত করার প্রতিবেদনে রোগীর নাম, বয়স, লিঙ্গ, তারিখ– এসব উল্লেখ না করেই এভাবে আরও কয়েকটি প্রতিবেদন প্রদান করতে দেখা যায় ঢামেক হাসপাতালের মেডিকেল সেল থেকে।
হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাসির উদ্দিন
ভিড়ের কারণে ডেঙ্গু সেলে দায়িত্বরতদের সঙ্গে কথাও বলতে পারছিলেন না রোগীর স্বজনরা। তবে অনেকে ডেঙ্গু চিহ্নিতকরণ প্রতিবেদন যথাযথ পরিচয়ে ঠিকঠাক পাচ্ছেন। অন্যদিকে যারা পরিচয়বিহীন প্রতিবেদন পাচ্ছেন, তারা পড়ছেন বিপাকে।
রামপুরার তিন বছর বয়সী হুমায়রাও একই ধরনের ঘটনার শিকার। তার বাবা ইউনুস খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘গতকালও (রোববার) নাম, বয়স, লিঙ্গ, তারিখ ছাড়া রিপোর্ট দিয়েছিল। কীভাবে বুঝব, এটা আমার মেয়ের ডেঙ্গুর রিপোর্ট। তাই নেইনি। রাগে ছিড়ে ফেলছিলাম। আজ আবার নাম-পরিচয়হীন বেওয়ারিশ রিপোর্ট দিল!’
শ্রেয়ার ডেঙ্গুর রিপোর্টেও পরিচয় নেই। বাবা সিদ্ধেশ্বরীর বাসিন্দা আসাদুল্লাহ জাগো নিউজকে বলেন, ‘নাম-পরিচয় কিছুই নেই। অন্যজনের রিপোর্ট দিয়ে দিলে কিছুই করার নাই।’
ঢামেকে ডেঙ্গুর প্যাথলজিক্যাল রিপোর্ট
পরিচয়হীন ওই তিনটি ডেঙ্গু চিহ্নিতকরণ প্রতিবেদনে সই রয়েছে ঢামেকের ল্যাবরেটরি মেডিসিন বিভাগের মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ও ক্লিনিক্যাল প্যাথলজিস্টের। এ বিষয়ে ঢামেকের ক্লিনিক্যাল প্যাথলজি বিভাগের প্রধান ডা. আজিজ আহমেদ খান কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
তবে ঢামেকের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন এ বিষয়ে কথা বলতে সম্মত হন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘নাম না থাকলে তো সে (রোগী) নেবে না। ডেঙ্গু রিপোর্ট আপনি পেলেন, ওখানে নাম নেই। তাহলে সেটা আমরা কাকে দেব? তাই যেটা হয়, অনেক রিপোর্ট আমরা রিপিট (পুনরায় করা) করে দেই। আপনি নিশ্চয়ই ওই জায়গাটা দেখেছেন, কী পরিমাণ রাশ (ভিড়, ব্যস্ত) ওই জায়গাটা। এই ব্যস্ততার মধ্যে, সামর্থ্যের মধ্যে সবাইকে আমরা সাপোর্ট দেয়ার চেষ্টা করছি। যেহেতু বিনামূল্যে করছি, কোনো কেস মিস হলে আবার নতুন করে আমরা করে দেই। রোগীর হয়তো একটু কষ্ট হচ্ছে কিন্তু লস (ক্ষতি) হচ্ছে না।’
স্বাস্থ্য অধিদফতরের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকার হাসপাতালে মোট রোগীর সংখ্যা ৭ শতাংশ ও ঢাকার বাইরে রোগীর সংখ্যা ৫ শতাংশ কমেছে। আক্রান্তদের সংখ্যার সূচক নিম্নগতি। এই নিম্নগতি অব্যাহত থাকবে।
ঢামেকে ডেঙ্গুর প্যাথলজিক্যাল রিপোর্ট
গতকাল (১৮ আগস্ট) সকাল ৮টা থেকে সোমবার সকাল ৮টা পর্যন্ত সারাদেশে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা এক হাজার ৬১৫। তাদের মধ্যে ঢাকায় ৭৫৭ ও ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে ৮৫৮ জন ভর্তি। এর পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় ঢাকায় ভর্তি রোগীর সংখ্যা ছিল ৭৩৪ এবং ঢাকার বাইরে ৯৭২।
চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে আজ (১৯ আগস্ট) পর্যন্ত সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ৫৪ হাজার ৭৯৮। হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের মধ্যে ৮৪ শতাংশ ডেঙ্গু রোগী ইতোমধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন।
ডেঙ্গু পরীক্ষা : বর্তমান প্রেক্ষাপটে জ্বর হলে প্রথম কাজ হবে ‘সিবিসি (কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট)’ পরীক্ষা করানো। এখানে দেখা হয় ‘হিমোগ্লোবিন’, ‘টোটাল কাউন্ট’, ‘প্লাটিলেট’ এবং ‘হেমাটোকিট’ বা ‘প্যাকডসেল’ (পিসিভি)।
জ্বরের প্রাথমিক অবস্থায় রোগীর অবস্থা কেমন ছিল সেটা যাচাই করা হয় এই পরীক্ষা থেকে। এ পরীক্ষায় ‘প্লাটিলেট’র সংখ্যা কমতে দেখা গেলে ডেঙ্গুর প্রাথমিক সন্দেহ শুরু হয়। সেক্ষেত্রে পরামর্শ দেয়া হয় ডেঙ্গু ‘এনএসওয়ান অ্যান্টিজেন’ পরীক্ষা।
ঢামেকে ডেঙ্গুর প্যাথলজিক্যাল রিপোর্ট
এই পরীক্ষায় ‘আইজিজি’ এবং ‘আইজিএম’ অ্যান্টিবডি পর্যবেক্ষণ করেন চিকিৎসকরা। যদি আইজিএম পজিটিভ এবং আইজিজি নেগেটিভ হয় তবে বুঝতে হবে রোগী সম্প্রতি প্রথমবার ডেঙ্গুর জীবাণুর আক্রমণের শিকার হয়েছেন, অর্থাৎ তার ডেঙ্গু হয়েছে।
দুটিই পজিটিভ হলে বুঝতে হবে আগে রোগী ডেঙ্গুর চার ধরনের জীবাণুর মধ্যে একটিতে আক্রান্ত হয়েছিল। এবার সে অন্য ধরনের জীবাণুর আক্রমণে আবার ডেঙ্গুর শিকার হয়েছেন। এই পরিস্থিতে ধরা হয় এবার রোগীর রোগের তীব্রতা বেশি হবে। এই অ্যান্টিবডি তৈরি হতে সাধারণত পাঁচ-সাতদিন সময় লাগে। এ সময়ের পর পরীক্ষা করানো হলে সঠিক ফলাফল পাওয়া যাবে।
পিডি/জেডএ/এমএআর/এমএস