চলতি বছরের জুন থেকে হংকংয়ে প্রত্যর্পণ বিল নিয়ে লাখো মানুষ বিক্ষোভ করছে। বিতর্কিত এ বিল বাতিলের দাবিতে শুরু হওয়া বিক্ষোভ ক্রমশই সহিংস আর স্বাধীনতার দাবিতে উত্তাল হয়ে উঠেছে।
Advertisement
প্রায় তিনমাস ধরে হংকংয়ে চলা গণতন্ত্রপন্থী এই আন্দোলন দমনের জন্য চীনের হস্তক্ষেপ নিয়ে আশঙ্কা ক্রমশ বাড়ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, আন্দোলন দমনের পদক্ষেপ নিলে তা চীনের জন্য বড় ধরনের ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
বিবিসির চীন বিভাগের সম্পাদক হাওয়ার্ড ঝ্যাং বলছেন, হংকং সংকট মোকাবিলায় হস্তক্ষেপের জন্য চীন যে প্রস্তুতি নিচ্ছে, তার ইঙ্গিত পাওয়া মিলছে। চীন গত কয়েকদিনে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান শক্ত করেছে। তাদের বিরুদ্ধে তীক্ষ্ম ভাষায় মন্তব্য করেছে। সেই সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের ‘সন্ত্রাসী’ আখ্যা দিয়েছে।
হংকংবাসীদের উদ্বেগের কারণ হলো, এগারো সপ্তাহ ধরে চলা বিক্ষোভের প্রভাব হংকংয়ের অর্থনীতিতে পড়তে শুরু করেছে। সেখানকার অর্থনীতির প্রায় ২০ শতাংশ পর্যটন এবং খুচরা ব্যবসার ওপর নির্ভরশীল। এই বিক্ষোভের ফলে এ দুটি খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
Advertisement
বাংলাদেশি সৈয়দ ইকরাম ইলাহী হংকংয়ের বড় একজন ব্যবসায়ী। হংকংয়ে ২৪ বছর ধরে বসবাস করে আসছেন তিনি। বিবিসি বাংলাকে বলেন, বিক্ষোভের কারণে তার ব্যবসার অনেক ক্ষতি হয়েছে। ব্যবসার কেন্দ্র হিসাবে হংকংয়ের যে সুনাম ছিল, তা অনেকটাই খর্ব হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ব্যক্তিগতভাবে আমার ব্যবসার অনেক ক্ষতি হয়েছে। আমাদের বায়াররা স্কেয়ারড (ভীত)। তারা আমাদের ব্যবসা দিতে একটু ভয় পাচ্ছে। তারা দেখেছে, আমাদের এখানে এ রকম সমস্যা চলছে। আমমা মালপত্র ঠিকমতো রফতানি করতে পারব কি-না, সে ব্যাপারে তারা চিন্তিত।
ব্যবসায়ীরা যে প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলবেন, এই মুহূর্তে তার কোনো সুযোগ নেই বলে জানান সৈয়দ ইকরাম ইলাহী। কারণ এখন পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। তার মতে, বিক্ষোভ দমনে পুলিশ বা হংকং সরকার কোনো কিছুই করতে পারছে না।
তিনি বলেন, সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সবাই এই আন্দোলনে সায় দিয়েছে। অনেকে প্রতিবাদে নেমেছে। যতদিন পরিস্থিতি শান্ত না হবে, ব্যবসা-বাণিজ্য খারাপ থাকবে। শেয়ার সূচকও পড়তির দিকে, যা আমাদের ব্যবসায়ীদের জন্য বড় ধরনের উদ্বেগের কারণ।
Advertisement
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হংকংয়ের আর্থিক খাতের কর্মকর্তা, বিমানবন্দরের কর্মী এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সরকারি কর্মচারীরা এই বিক্ষোভকে সমর্থন করছেন। বিক্ষোভ ও হরতালে যোগ দিয়েছেন তারা। ফলে এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ এই বাণিজ্য নগরীর ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে।
বিবিসির চীন বিভাগের সম্পাদক বলছেন, চীন যদি হংকংয়ে হস্তক্ষেপ করে, বিক্ষোভকারীদের দমনে সেখানে সেনাবাহিনী নামায়, তাহলে তার জন্য চীনকে কঠিন মূল্য দিতে হবে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র এবং মুক্ত বন্দর এলাকা বলে হংকংয়ের যে বিশেষ মর্যাদা রয়েছে, তা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সেই সঙ্গে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে।
তিনি আরও বলেন, চীনকে আন্তর্জাতিক স্তরে বড় ধরনের সমালোচনার মুখে পড়তে হবে। পশ্চিমা দেশগুলো চীনের সঙ্গে তাদের যোগাযোগের বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাববে এবং বিশ্বে চীনের অবস্থান ও দেশটির অর্থনীতি ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হবে।
হংকংয়ে বাংলাদেশের ব্যবসায়ী সৈয়দ ইকরাম ইলাহীরও ধারণা, চীন কঠোর হাতে এই সমস্যা মোকাবিলার জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রাখলেও তারা এ ধরনের পদক্ষেপ নেবে না।
বাংলাদেশি গৃহবধূ ফাহমিদা মজুমদার। পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে হংকংয়ে থাকেন। তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, হংকং ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য তো বটেই, এমনকি বসবাসের জন্যেও শান্তির ও নিরাপদ শহর ছিল। কিন্তু বেশ কয়েকদিন ধরে চলা এই বিক্ষোভ তাকে এবং তার মতো সেখানে বসবাসরত অসংখ্য বাংলাদেশি পরিবারের জন্য উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
ফাহমিদা মজুমদার বলেন হংকংয়ের এই বিক্ষোভের পরিণতি কী হয়, পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেয় তা নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন। মা হিসেবে আমার সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন। বর্তমানে আমরা এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।
তিনি আরও বলেন, আমার সন্তানদের অনেক বন্ধুবান্ধব হংকংয়ের বাসিন্দা। তারা বিক্ষোভে অংশ নিচ্ছে। আমার ছেলেমেয়েরা এই বিক্ষোভে জড়িয়ে পড়বে কি-না সেটা নিয়ে অবশ্যই উদ্বেগ আছে। চীন যদি হস্তক্ষেপ করে, হংকংয়ের প্রশাসন যদি চীনের হাতে চলে যায়, আমাদের ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ কী দাঁড়াবে এসব নিয়ে অনিশ্চয়তা আর আশঙ্কায় দিন কাটছে।
ফাহমিদা মজুমদার বলছেন, হংকংয়ে বাংলাদেশিদের একটা বড় অংশ নানা ধরনের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এই বিক্ষোভ দীর্ঘায়িত হলে এবং তা অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেললে সেটা বাংলাদেশিদের জন্য চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
সূত্র : বিবিসি বাংলা
এমএসএইচ