ইকবাল হাবিব। পড়াশোনা করেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) স্থাপত্যবিদ্যায়। স্থাপত্য নকশার জন্য বহুবার পুরস্কৃতও হয়েছেন তিনি। পরিবেশবাদী আন্দোলনের সঙ্গেও নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত এ নগর পরিকল্পনাবিদ।
Advertisement
ডেঙ্গু পরিস্থিতির ভয়াবহতা নিয়ে সম্প্রতি মুখোমুখি হন জাগো নিউজ'র। আলোচনায় গুরুত্ব পায় নগর উন্নয়ন ও জনপ্রতিনিধিদের দায় নিয়েও।
জাগো নিউজ : নগরের উন্নয়নের জন্য ঢাকা সিটি কর্পোরেশন ভাগ হলো। অথচ মশার কামড় থেকেই রক্ষা পাচ্ছে না নগরবাসী…
ইকবাল হাবিব : জনদায় যদি না থাকে, তাহলে একটি নগরের পরিবেশ-পরিস্থিতি নিয়ে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হবে- এটা খুবই স্বাভাবিক।
Advertisement
মনে রাখতে হবে, পরিচ্ছন্নতা ও মশক নিধনের কাজ নিয়েই সিটি কর্পোরেশনের যাত্রা শুরু। যদিও সিটি কর্পোরেশনের আরও ১৪টি কাজ আছে। কিন্তু কর্পোরেশন মনে করে অন্য কারও মুখাপেক্ষী না হয়ে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও মশক নিধনের কাজ দুটি নিজেদের। অন্য কাজগুলো অন্যান্য প্রতিষ্ঠান বা অধিদফতরের সঙ্গে যুক্ত বলে এককভাবে করতে পারে না। বছরের পর বছর আমরা এমন কথাই শুনে আসছি।
কিন্তু যে দুটি কাজ নিজেদের বলে দাবি করে, সে দুটি কাজও যে করছে না তার প্রমাণ হচ্ছে আজকের ডেঙ্গু পরিস্থিতি। সত্যিকার কাজের পরিবর্তে হুমকি-ধামকি দিয়ে যে আসলে জনদায় এড়ানো যায় না, এখন আমরা তাই দেখছি।
জাগো নিউজ : আসলে সংকট কোথায়? এভাবে ঠেকতে হলো কেন?
ইকবাল হাবিব : দায়িত্ববোধ না থাকা। পরিস্থিতি বেসামাল, অথচ মেয়রদ্বয় তা আমলে না নিয়ে যখন জনগণের ওপর দায় চাপিয়ে দেন, তখন বুঝতে হবে তারা সমস্যাটা আমলেই নেননি। বহু বছর ধরে এডিস মশা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। এ মশা থেকে মারাত্মক পাঁচটি রোগের বিস্তার ঘটছে। কীভাবে এ মশার প্রাদুর্ভাব ঘটছে, তাও সবার জানা। অথচ এতদিনেও এ মশা নিধন করা সম্ভব হলো না। অর্থাৎ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দায় এড়ানোর মানসিকতা থেকে দুর্ভোগ বাড়ানো হচ্ছে।
Advertisement
জাগো নিউজ : দায় তো জনগণেরও?
ইকবাল হাবিব : অবশ্যই। কিন্তু জনগণও সেই দায়িত্ব আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিয়েছে যেন! একটি সমাজের সার্বিক অবনতির প্রকাশ এটা।
লোকবলের অভাবের কথা বলেন মেয়ররা। এটা তাদের মুখে মানায় না। কারণ, ঢাকা শহরে কোনো সভা-সমাবেশ হলে মেয়র ও কাউন্সিলররা সেখানে হাজার হাজার মানুষের জোগান দিয়ে থাকেন। অথচ তারা মানুষকে সচেতন করে তোলার দায়িত্বটা নিতে পারেন না। একই সঙ্গে উদ্যোগ নেয়ার দায়িত্বটাও সিটি মেয়রদের।
জাগো নিউজ : মেয়রদের নিয়ে আলোচনা হয়। কাউন্সিলররা আলোচনার বাইরে থাকছেন…
ইকবাল হাবিব : বাংলাদেশ সরকার ব্যবস্থার মতো সিটি কর্পোরেশনের মেয়ররাও কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা প্রয়োগ করছেন। সবকিছুই মেয়রকেন্দ্রিক। কাউন্সিলরদের নিয়ে ওয়ার্ডভিত্তিক উদ্যোগ গ্রহণ করার কথা থাকলেও এটা আর মেয়ররা মানতে চান না। বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা আছে কি-না, তা যাচাই করার জন্য মেয়ররা কোনো লোক পান না। অথচ ভোটের সময় একজনকে একটি মার্কার স্লিপ দেয়ার জন্য পাঁচজন ব্যক্তি ঘুর ঘুর করেন। এটা জনগণের সঙ্গে চরম প্রহসন।
সিঙ্গাপুরের মানুষ আমাদের থেকে আলাদা নয়। আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও প্রতিনিধিদের দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে সিঙ্গাপুর ঝকঝকে নগরী। মানুষ যা খুশি করতে পারবে- এমন নীতি থাকলে তো সরকার ব্যবস্থার কোনো দরকার নেই। কাউন্সিলরদের যদি কাজ না দেয়া হয়, তাহলে এত আয়োজনের নির্বাচন করে কী লাভ?
এককভাবে চিন্তা না করে গোষ্ঠীগত চিন্তা করা এখন সময়ের দাবি। আমি পরিষ্কার থাকলেই মশা আমার বাড়িতে আসবে না, এটা অবাস্তব। মশার নির্দিষ্ট কোনো ঠিকানা থাকে না। কাজ না করে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে মশা নিধন করা সম্ভব হলে এতদিনে একটি মশাও থাকত না।
জাগো নিউজ : আমাদের তো এগিয়ে যাওয়ার কথা। এ পরিস্থিতিতে পড়তে হলো কেন?
ইকবাল হাবিব : জনভোটের গুরুত্ব থাকলে এতদিনে সমাধানের পথ বের হতো। ভোট, নির্বাচন সব কাঠামোই তো ভেঙ্গে পড়েছে। এটা তো আজ প্রমাণিত। প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ ছাড়া কোনো সমস্যার সমাধান হয় না। তাহলে অন্য প্রতিনিধিদের কাজটা কী? সভ্যতার এমন সময়ে মশার কামড়ে প্রতি বছর মানুষকে মরতে হচ্ছে। এর চেয়ে অবাক করার ঘটনা আর কী হতে পারে!
জাগো নিউজ : জনগণও সব মেনে নিচ্ছে…
ইকবাল হাবিব : কষ্টটা ঠিক এখানেই। মানুষ দরজা বন্ধ করে ডুকরে কাঁদছে। অথচ নিজের অধিকারের জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করছে না। পাশের বাড়িতে ডেঙ্গুর লার্ভা। অথচ বলার সাহস পায় না। সবাই যেন নিষ্ক্রিয় হয়ে যাচ্ছে। এটা একটি রাষ্ট্র বা সমাজের জন্য চরম অবনতি। বাঙালি মুক্তিযুদ্ধ করে জিতেছে, অথচ মশার কামড়ে এখন মরছে!
অপরিকল্পিতভাবে নগর হচ্ছে, উন্নয়ন হচ্ছে। কেউ কথা বলছি না। সুশীলরাও আলোচনায় নেই। ঢাকায় অনেকগুলো এমপি। অথচ মশার এমন মহামারি রোধে তাদের কোনো ভূমিকা নেই। কোথায় তারা? জনবিচ্ছিন্ন প্রতিনিধি নাগরিক অধিকার রক্ষা করতে পারে না।
জাগো নিউজ : নগরের উন্নয়নও তো হচ্ছে। এটি তো অস্বীকার করা যায় না…
ইকবাল হাবিব : অবশ্যই উন্নয়ন হচ্ছে। আরও উন্নয়ন হবে। কিন্তু সে উন্নয়ন যদি জনজীবনের মান না বাড়ায় তাহলে লাভ কী?
শুধু টাকার অংকে উন্নয়ন করে সার্বিক পরিস্থিতির পরিবর্তন আনা যায় না। সামাজিক ও মানসিক পরিবর্তনও জরুরি। সবকিছু নিয়ে এগোতে না পারলে উন্নয়ন টেকসই হবে না।
এএসএস/এনডিএস/এমএআর/পিআর