খেলাধুলা

অভাবে অন্যের ক্ষেতে কাজ করা কিশোরীকে স্বপ্ন দেখাচ্ছে হ্যান্ডবল

নওগাঁর বদলগাছীর মো. আকরাম হোসেন দিনমজুর। স্ত্রী আফরোজা বেগম এবং দুই কন্যা সুমী ও সুবর্না আক্তার স্বর্নাকে নিয়ে সংসার চালাতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয় আকরাম হোসেনকে। বড় মেয়ে সুমীর বিয়ে দেয়ায় এখন তিনজনের সংসার। তারপরও যাকে বলে ‘নুন আনতে পানতা ফুরায়’-একবেলা খাবার জোটে তো আরেক বেলা উপোস।

Advertisement

অভাবের সেই সংসারে বাবার হাড়ভাঙ্গা খাটুনি সহ্য করতে না পেরে স্বর্নাও কাজে হাত লাগান। কাজ করেন অন্যের জমিতে। পাট কাটা, ধান কাট, পাট ছাড়ানো, ধোয়া কিংবা শুকানো-কোন কাজটি পারেন না স্বর্না? অভাবের তাড়না সবকিছুই শিখিয়ে দিয়েছে তাকে। তার মধ্যেও এই কিশোরীর লেখাপড়া থেমে থাকেনি। স্বর্না বদলগাছী লাবণ্য প্রভা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী।

পড়তে গেলে খরচ। বই, খাতা-কলম কেনার সামর্থ্য নেই। প্রাইভেট পড়া তো স্বপ্নের মতো। সে স্বপ্ন অপূর্ণ রাখেননি স্বর্ণা। পাশের বাড়ির এক আপার কাছে প্রাইভেট পড়েন। মায়না দিতে পারেন না বলে তার ঘরের কাজ করে দেন। তারপর খাওয়ার চিন্তা তো আছেই।

স্বর্নার এক চাচা মোটামুটি স্বচ্ছল। তাদের জমিতে কাজ করেন স্বর্নার বাবা, করেন আরো অনেকের নানা ধরনের কাজ। সব কাজের সঙ্গে মেয়ে স্বর্নাকে পান আকরাম হোসেন। সকালের সূর্য মাথার ওপর উঠে যখন, দুপুরের খাওয়ার সময় হয়ে যায়, তখন একবেলা পেট ভরতে অন্যের জমিতে কাজ করতে নেমে যান বদলগাছী লাবণ্য প্রভা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। দুপুরের খাওয়ার পর আবার রাতের চিন্তা।

Advertisement

এভাবেই জীবনযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া নওগাঁ’র এই কিশোরী এখন নতুন স্বপ্নে বিভোর। হাতে তুলে নিয়েছেন বল। হ্যান্ডবল খেলেই বদলে দিতে চান নিজেকে। বদলে দিতে চান পরিবারের অবস্থা। হাসি ফোটাতে চান তারা দু:খী বাবা-মা’র মুখে। জাতীয় যুব নারী হ্যান্ডবল দলের সদস্য এই স্বর্না। যাচ্ছেন ভারতের জয়পুরে। লাল-সবুজ জার্সি গায়ে দেশের প্রতিনিধিত্ব করবেন নওগাঁ থেকে ২ হাজার কিলোমিটারেরও বেশি দূরে ভারতের রাজস্থানে। সোমবার যুব নারী হ্যান্ডবল দলের সদস্য হয়ে তিনি যাচ্ছেন ভারতে।

ক্ষেতে কাজ করার সময় ওপর দিয়ে বিমান উড়ে যেতে দেখেছেন। মাঝেমধ্যে বিমান চোখের আড়াল হওয়া পর্যন্ত তাকিয়ে থাকতেন আকাশে। সেটা এমনিতেই। বিমানে চড়ার স্বপ্ন নিয়ে নয়। অথচ সেই বিমানই এখন স্বর্নাকে উড়িয়ে নেবে হাজার হাজার কিলোমিটার দূরের এক শহরে। যা নওগাঁর এ কিশোরীর স্বপ্নের সীমানারও বাইরে।

পল্টন ময়দানের হ্যান্ডবল স্টেডিয়ামে বসে স্বর্না তার জীবনের কাহিনী বলেছেন জাগো নিউজকে। কিভাবে পেটের দায়ে অন্যের ক্ষেতে কাজ করা মেয়েটি এখন দেশের একজন প্রতিনিধি হয়ে গেলেন, সেই গল্প শোনানোর সময় তার চোখে ছিল দ্বীপ্ত আলো, তার স্বপ্নের সীমানা যেন আরও অনেক দূর।

কাজ, লেখা পড়া-এ দুইয়ের মধ্যেই থেমে নেই স্বর্নার জীবন। নিজেকে জড়িয়ে রেখেছিলেন খেলাধুলার সঙ্গেও। দৌড়-ঝাপ, ছোটাছুটি তার প্রিয়। তাই তো স্কুলে খেলাধুলাটা নিয়মিতই করতেন। স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে গোলক নিক্ষেপ আর দৌড়ে প্রথম হতেন নিয়মিত। প্রথম হয়েছেন জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ের দৌড় প্রতিযোগিতায়ও।

Advertisement

যে হ্যান্ডবল তার জীবনের গল্পটাকে নিয়ে গেছে নতুন বাঁকে, সেই খেলায় কিভাবে আসলেন স্বর্না? জানা যাক নওগাঁর বদলগাছীর এ কিশোরীর কাছেই-‘স্কুলের খেলাধুলা থেকে আমার এক স্যার খলিলুর রহমান খুব প্রশংসা করতেন। প্রধান শিক্ষকও করতেন। তারা বলতেন খেলাধুলা চালিয়ে যাও। আমি বাবা আর মাকে বলেছি খেলতে চাই। বাবা-মা বলেছিলেন পারলে খেলো। ২০১৪ সালে ইন্টার স্কুল হ্যান্ডবল। সুলতান কবীর নামের একজন হ্যান্ডবল কোচ দিনাজপুর থেকে আমাদের এখানে এসে শেখাতেন। আমি তখন বল ধরতেই পারতাম না। তারপরও ওই ইন্টার স্কুল দিয়ে আমার হ্যান্ডবল শুরু’-বলছিলেন সুবর্না আক্তার স্বর্না।

জাতীয় যুব নারী হ্যান্ডবল চ্যাম্পিয়নশিপের মাধ্যমে প্রথম বড় আসরে খেলা। স্বর্নার অভিষেক আসরেই নওগাঁ চ্যাম্পিয়ন। ওই টুর্নামেন্ট থেকে বাংলাদেশ হ্যান্ডবল ফেডারেশন কিছু প্রতিভাবান খেলোয়াড় বাছাই করেন। স্বর্না টিকে যান সেই বাছাইয়ে। তারপর নওগাঁর জেলা দলে সুযোগ পান। স্বর্নারা জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে হন তৃতীয়।

প্রতিভা থাকলে তা সুযোগ পেলেই সৌরভ ছড়ায়। জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে ভালো খেলায় স্বর্নাকে ঢাকার লিগে নিয়ে নেয় আরএন স্পোর্টস হোম নামের একটি দল। লিগে স্বর্নার দল ভালো কিছু করতে না পারলেও তিনি নিজে পারফরম্যান্স দিয়ে জায়গা করে নেন জাতীয় যুব দলে।

লিগে খেলে ২ হাজার টাকা পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন স্বর্ন। পাশাপাশি পেয়েছিলেন জার্সি, ট্র্যাকস্যুট ও কেডস। ইচ্ছে ছিল সেই টাকা তুলে দেবেন বাবা-মায়ের হাতে। পারেননি। কারণ, এসএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য ওই টাকা দিয়ে কিনেছেন টেস্ট পেপার।

বিদেশে যাবেন খেলতে। দুই মাস আগে পাসপোর্ট করেছেন। লেগেছে সাড়ে ৭ হাজার টাকা। স্কুলের দুইজন শিক্ষক, এলাকার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং তার কোচ সুলতান কবীর মিলে পাসপোর্টের টাকা জোগাড় করে দিয়েছেন।

১৪ বছর বয়সী স্বর্নার মুখে হাসি। খুশি তার বাবা-মা। আশ-পাশের বাড়ীর মানুষ যখন শুনেছেন স্বর্না বিমানে চড়ে বিদেশে যাচ্ছেন যখন তাদের মুখেও হাসি। ‘আমি কোনো দিন চিন্তাও করিনি বিমানে উঠতে পারবো। তাই এটাকে আমি স্বপ্ন পূরণ বলবো না। কারণ, আমি কখনো স্বপ্ন দেখিনি প্লেনে চড়ে কোথাও যাবো’-বলছিলেন স্বর্ণা।

এখন কোনো স্বপ্ন দেখেন? স্বর্নার জবাব, ‘হ্যাঁ। এখন আমি স্বপ্ন দেখা শুরু করেছি। সে স্বপ্ন হ্যান্ডবলে বড় খেলোয়াড় হওয়া, জাতীয় দলে খেলা। হ্যান্ডবল খেলে আমি বাবা-মার মুখে হাসি ফোটাতে চাই। তাদের পরিচিত করতে চাই।’

এই যুগে মোবাইল ফোন না থাকা মানুষের সংখ্যা কম। সেই কমের একজন স্বর্না। তার এখনো মোবাইল ফোন কেনার সামর্থ্য হয়নি। বাড়িতে তার বাবা-মা দুইজনের মিলে একটি মোবাইল আছে। হ্যান্ডবল ক্যাম্পে নওগাঁর আরেক মেয়ে আছেন। তার মোবাইল দিয়ে প্রয়োজনে বাবা-মা’র সঙ্গে কথা বলেন স্বর্না।

হ্যান্ডবলে মন-প্রাণ সপে দেয়া স্বর্না নিজের বাল্য বিয়ে ঠেকিয়ে দিয়েছেন। সে ঘটনা নিয়ে বলেন, ‘গত বছর আমাকে বিয়ে দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন বাবা-মা। প্রস্তাবও এসেছি। পাত্রপক্ষ আমাকে দেখতেও এসেছিল। কিন্তু আমি রাজি হয়নি। দেখাও দেইনি। আমার বিয়ের বয়স হয়নি। এখন আমার শুধু পড়া আর খেলার সময়।’

আরআই/এমএমআর/জেআইএম