আকস্মিক ভয়াবহ আগুনে পুড়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে রূপনগরের চলন্তিকা বস্তি। পুড়ে ছাই হওয়া শেষ আশ্রয়স্থলে অবশিষ্টের খোঁজে ক্ষতিগ্রস্ত বস্তিবাসী এখন আগুনের ধ্বংসস্তূপে। কেউ পোড়া খাট, টিভি, হাড়ি-পাতিল, কাপড়-চোপড়, চুলা উদ্ধারের চেষ্টা করছেন।
Advertisement
শনিবার দুপুরে রাজধানীর মিরপুর সেকশন-৭ এ চলন্তিকা মোড়ের চলন্তিকা বস্তিতে দেখা যায় এ চিত্র।
অগ্নিকাণ্ডে চলন্তিকাসহ আরও ৩-৪টি বস্তির প্রায় সাড়ে ৫০০ থেকে ৬০০ ঘর পুড়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় তিন হাজার পরিবার। আগুনের ঘটনায় কেউ নিখোঁজ কিংবা চাপা পড়ে রয়েছে কি- না তা তল্লাশি করছে ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিট।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বস্তিটিতে বরিশাল, ভোলাসহ বেশ কটি জেলার ছিন্নমূল মানুষের বসবাস ছিল। গত ৪০-৫০ বছর ধরে অনেকেই বসবাস করে আসছিলেন। এবারই প্রথম আগুনে এত বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হলেন তারা।
Advertisement
শনিবার দুপুরে সরেজমিন দেখা যায়, ঝিলের ওপর বাঁশ আর কাঠের গাঁথুনিতে তৈরি শত শত ঘরের শেষ চিহ্ন বলতে দেখা যায় পোড়া টিন, বাঁশের পুড়ে যাওয়া খুঁটির অবশিষ্টাংশ। ক্ষতিগ্রস্ত বস্তিবাসী কেউ গালে হাত দিয়ে অসহায়ত্ব নিয়ে ঠায় বসে। কেউ বা উদ্ধার করার চেষ্টায় অবশিষ্টাংশ।
গত রাতের আকস্মিক আগুনের সময় বস্তির অধিকাংশের উপস্থিতি ছিল না। কারণ ঈদের ছুটিতে বেশিরভাগ বস্তির বাসিন্দা গ্রামের বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলেন।
এমনই একজন রিও গার্মেন্টের কর্মী আকলিমা আক্তার। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ঈদের কারণে গ্রামের বাড়ি ভোলায় গিয়েছিলাম স্বামী সন্তানের সাথে। আগুনের খবর শুনে রাতেই গাড়িতে উঠে ঢাকা আসি। কিন্তু এসে দেখি আমার ঘর কোনটা বোঝা বড় দায়। পুড়ে সব ছাই। এর মধ্যে পুড়ে যাওয়া লোহার খাট, ইস্টিলের আলমারি, হাড়ি-পাতিল যা কিছুটা ব্যবহার করার মতো তাই উদ্ধারের চেষ্টা করছি।
তিনি কান্না করে বলেন, অনেক দিনের কষ্টের টাকায় গুছিয়েছিলাম সংসার। হঠাৎ আগুনে এভাবে সব পুড়ে ছাই হবে ভাবতে পারিনি।
Advertisement
আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত বস্তির ভেতরে ঢোকার মুখেই ধ্বংসস্তূপ থেকে অবশিষ্ট অংশটুকু ভ্যানে নিয়ে গলিতে দাঁড়িয়েছেন বরিশাল মেহেন্দিগঞ্জের আলমগীর মিয়া। পেশায় সুইপার আলমগীর কান্নাকাটি করে বলেন, ‘সন্ধ্যায় কামে গেছি। আগুনে পুড়ছে সব খবরটাও পাই নাই। আইসা দেখি সব পুড়ে শেষ। ৩০ বছর ধরে এই বস্তিতে থাকছি। কখনো এমন করে আগুনে পুড়ে সব হারাই নাই।’
পুড়ে যাওয়া স্তূপের মধ্যে হাত লাগিয়ে একটার পর একটা টিন টেনে টেনে অবশিষ্টের খোঁজ করছেন পেশায় অটোরিকশা চালক সোহেল মিয়া।
তিনি বলেন, ‘রাত থেকে পেটে খাবার জোটেনি। সারা দিন পরিশ্রম করে যা ইনকাম তাতে খেয়ে থেকে চলে যেতে। কিন্তু আগুনে হারালো আশ্রয়, নেই খাবারের বন্দোবস্ত। এখন কোথায় থাকবো কোথায় খাবো জানি না। আমগো তো ঘরহারা, সহায়-সম্বলহীন মানুষের এ বস্তির ঘরই ছিল শেষ আশ্রয়। তাও শেষ।’
বস্তির সাতটি ঘরের মালিক দুর্ঘটনায় পা হারানো শফিকুল ইসলাম বলেন, ১৫ বছর আগে এখানে এসে ঘর তৈরি করে বসবাস শুরু করি। ১৫শ টাকা করে সাতটি ঘর ভাড়া দিয়েই আমার নিজের সংসার চলে। কিন্তু এই আগুনে ভাড়াটিয়াদের সাথে নিজেরও কিছু নেই, সব পুড়ে শেষ।
শুক্রবার সন্ধ্যায় বস্তিতে লাগা ভয়াবহ আগুন সাড়ে তিন ঘণ্টা পর ফায়ার সার্ভিসের ২৪টি ইউনিটের চেষ্টায় রাত সাড়ে ১০টার দিকে নিয়ন্ত্রণে আনে। তবে পুরোপুরি নির্বাপিত হয় রাত দেড়টার দিকে। বস্তির অধিকাংশ ঘর টিনশেড কাঁচাঘর হওয়ায় আগুন নিয়ন্ত্রণে বেগ পেতে হয়। এখন পর্যন্ত আগুনে আহত চারজন। তারা হলেন- কবির (৩৫), হাবিব (১৯), রফিক ও শরিফ।
তাদের স্থানীয় হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। তবে কেউই দগ্ধ কিংবা গুরুতর আহত হননি।
এর আগে রাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব অরুণ কান্তি শিকদার বলেছেন, আপনারা জানেন ৭টা ২২ মিনিটে আগুন লাগে। ৭টা ২৮ মিনিটে ফায়ার সার্ভিস আসছে। আগুনের ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠনের কথাও জানান তিনি।
রাতে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, মিরপুরের রূপনগরের অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের সুচিকিৎসা, আহার ও বাসস্থানসহ সবধরনের সহযোগিতা দেয়া হবে। এ মুহূর্তে প্রথম কাজ আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা এবং আহতদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা।
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নাশকতা কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আপাতদৃষ্টিতে কেউ আগুন লাগিয়ে নাশকতা করেছে, এমনটা মনে হচ্ছে না।
মেয়র বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতোমধ্যে এ বস্তিবাসীর জন্য বাউনিয়া বাঁধে ফ্ল্যাট নির্মাণ করেছেন। তাদের সেখানে যাওয়ার কথা।
তিনি বলেন, এই মুহূর্তে যারা আহত হয়েছেন, তাদের সুচিকিৎসা প্রদান করা অন্যতম কাজ। তাছাড়া যাদের ঘর-বাড়ি পুড়ে গেছে, তারা জানেন না এখন বা আগামীকাল তারা কি খাবেন, কোথায় থাকবেন। ক্ষতিগ্রস্ত বস্তিবাসীর জন্য চিকিৎসা, আহার, বাসস্থান সব ধরনের সহযোগিতা করবে সিটি কর্পোরেশন।
জেইউ/এসএইচএস/এমএস