এবারের ডেঙ্গু মৌসুম শুরু হওয়ার পর থেকে এই নিয়ে লেখা ও বলার অনুরোধ পেয়েছি অল্প-বিস্তর। স্বযত্নে এড়িয়ে গেছি। আমার মনে হয়েছে দেশ-জাতি-স্থান-কাল-পাত্র ইত্যাদি অনেক বিষয়ই আমি অনেক কিছু বলি। কিছু কিছু লিখি আর এটা-সেটা করার চেষ্টা করি ঠিকই কিন্তু আমার মনে হয় একজন লিভার বিশেষজ্ঞ হিসেবে স্বাস্থ্যবিষয়ক কিছু বলার বা করার সময় আমার নিজেকে লিভার বিষয়ই সীমাবদ্ধ রাখা উচিত। কাজেই সম্প্রীতি বাংলাদেশের হয়ে একটা অসম্প্রদায়িক বাংলাদেশের প্রত্যাশায় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছুটাছুটিতে আমার আগ্রহ নিরন্তর। যেমন আগ্রহের শেষ নেই নির্মূল কমিটির হয়ে আজ রাজশাহী, কাল চট্রগ্রামে একটি রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশের জন্য ছুটতেও। কিন্তু লিভারের ব্যাপারে আমি খুবই কনজুস। লিভারের বাইরে একদমই না। তারপরও হঠাৎই ডেঙ্গু নিয়ে লেখা, কারণ মনে হচ্ছিল এবারের ডেঙ্গুর বহুমাত্রিকতা আলোচনায় আসতেই পারে।
Advertisement
একজন চিকিৎসক যখন ডেঙ্গু নিয়ে লিখছেন তখন এর প্রতিকার, প্রতিরোধ আর চিকিৎসা আলোচনায় উঠে আসবে পাঠকের প্রত্যাশা তেমনটা হওয়াটাই যুক্তিযুক্ত। আমি দুঃখিত এই লেখাটা সম্ভবত পাঠকের সেই প্রত্যাশা পূরণের কাজে আসবে না। আমার মনে হয় ডেঙ্গুর এই দিকগুলো নিয়ে ঢের লেখালেখি হয়েছে। কারও মনে হয় আর জানতে বাকি নেই যে, স্ত্রী এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গু ছড়ায়। এটি কামড়ায় সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি। হাটে-মাঠে, বনে-বাজারে এই মশা হারিকেন জ্বালিয়ে খুঁজে পাওয়া যাবে না। ডেঙ্গু মশার ছানা-পোনা মানে লার্ভার দেখা পাবেন আপনার আশেপাশে, ফুলদানিতে, ফ্রিজের তলায় আর এসি বা পুরাতন টায়ারে জমে থাকা তিন থেকে চার দিনের পুরাতন পানিতে। অতঃএব এডিস মশা থেকে বাচতে হলে নজর রাখতে হবে এসব জায়গায়। ডেঙ্গু জ্বর ১০৫ ডিগ্রি পর্যন্ত উঠতে পারে আর ডেঙ্গুর ঝামেলাগুলো সাধারণত দেখা দেয় জ্বরটা ভালো হওয়ার দু-একদিনের মধ্যে। তবে এবারের ডেঙ্গুর চেহারা একেবারে অন্যরকম। অনেকটা ২০১৩ সালের নির্বাচনের সময়কালীন মারদাঙ্গা বিরোধী দলের মত। জ্বর ভালো হতে না হতে অনেকেরই দেখা দিচ্ছে পেটে বা ফুসফুসে পানি আসা, কিডনি ফেইলিউর, শক্ আর এমনকি মাল্টি-অর্গান ফেইলিউরও। অতঃএব আর আগের মতো তিন-চারদিনের জ্বরের পরে না বরং দু-একদিনের জ্বরের পরেও ঘটছে অঘটন। কাজেই প্লাটিলেট কাউন্ট করে ডেঙ্গু চিকিৎসা করার দিন শেষ হয়ে গেছে। তবে আমার ধারণা এসব তথ্য এই শহরের বাসিন্দারা এখন ভালোই জানেন। বরং বলা যায় সচেতনতার মাত্রাটা কোনো কোনো ক্ষেত্রে একটু বেশি বলেই মনে হয়। যে কারণে মানুষের সচেতনতা এখন আতঙ্কে গিয়ে পৌঁছেছে।
তবে যেমনটি বলছিলাম এবারের ডেঙ্গুর একটি অন্যতম বৈশিষ্ট হচ্ছে এর বহুমাত্রিকতা। ডেঙ্গু মৌসুমের শুরুতে সরকারি প্রশাসনযন্ত্রের উদ্যোগ ও সমন্বয়হীনতা যথেষ্ট প্রশ্নের জন্ম দিয়েছিল। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে মনে হচ্ছে প্রশাসন ক্রমেই ধাতস্থ হয়ে আসছে। ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন আর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্তারা এখন এক হয়ে এক ভাষায় কথা বলছেন। আমার কাছে মনে হয় প্রথমদিককার সমন্বয়হীনতার পর এখন একসঙ্গে কাজ করায় যে পারদর্শিতা আমাদের প্রশাসন ইদানীং দেখাচ্ছে তা ভবিষ্যতে যেকোনো দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের প্রস্তুতিটা যে ঝালিয়ে নেয়ার একটা ভালো মক ট্রায়াল। এটিতো ডেঙ্গু না হয়ে ভূমিকম্প হতে পারতো। তা হলে শুরুর দিকটার এ সমন্বয়হীনতার পরিণতি যে কতটা ভয়াবহ হতে পারতো তা চিন্তারও বাইরে। ডেঙ্গুর ধাক্কা সামলানোর অভিজ্ঞতা ভবিষ্যতে এর চেয়ে বড় কোনো ধাক্কা সামলানোয় আমাদের ভালোই কাজে আসবে। আমার সহকর্মী ডা. ডিউ তার ফেসবুক ওয়ালে একটি প্রস্তাব দিয়েছেন। ডেঙ্গু রোগীর ভারে ভারাক্রান্ত সরকারি হাসপাতালগুলোর বারান্দা ও সিঁড়িগুলোতে শুয়ে থাকা রোগীদের বড় মাঠ বা স্টেডিয়ামে ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপন করে সেখানে সরিয়ে নেয়ার প্রস্তাব তার। প্রস্তাবটা আমার কাছে মন্দ লাগেনি। কারণ তেমনটি করা গেলে তাতে বরং ভবিষ্যতে আর কোনো দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের প্রস্তুতিটা আরও বেশি ঝালাই করা হয়ে যেত।
এবারের ডেঙ্গুর আরেকটি দিক হলো আমাদের রাজনীতিবিদদের রাজনৈতিক কালচারের পজেটিভ পরিবর্তন। ডেঙ্গুর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রাজনীতিকরা শুরুর দিকে গুজব-আজব ইত্যাদি অনেক আজগুবি কথাবার্তা বললেও তারা এখন সেই সেলফ ডিনাইয়ের জায়গা থেকে সরে এসেছেন। ঢাকা উত্তরের মাননীয় মেয়রতো স্বীকারই করেছেন যে তার সততা আর উদ্যোগ থাকলেও ছিল অভিজ্ঞতার অভাব। তিনি এখন শিখছেন এবং লক্ষণীয় এই যে মানুষ কিন্তু তার এই পজেটিভ অ্যাটিচিউড পজেটিভভাবে নিচ্ছে। ডেঙ্গুর কারণে আমাদের স্বাস্থ্য প্রশাসন আর স্বাস্থ্যসেবা গ্রহীতাদের আমার মতো স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের ওপর আস্থা ফিরে আসছে সেটাও এবারের ডেঙ্গু থেকে এদেশের চিকিৎসকদের একটা বড় পাওয়া। এবার আর কোনো ভিনদেশি চিকিৎসকদের সার্টিফিকেটের প্রয়োজন পরেনি। মাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ার্ডে শুয়ে থাকা ডেঙ্গু রোগী প্রত্যেকেই ধন্যবাদ জানিয়েছেন দেশের চিকিৎসকদের সাধ্যের ঊর্ধ্বে উঠে সাধ্যমতো দেশের মানুষদের স্বাস্থ্য রক্ষকের ভূমিকাটা সুষ্ঠুভাবে পালনের জন্য।
Advertisement
পাশাপাশি এবারের ডেঙ্গু আমাদের কিছু কিছু লোককে নতুন করে চিনতে যেমন শিখিয়েছে তেমনি আমরা আমাদের আস্থার জায়গাগুলোর ওপর আরও বেশি আস্থাশীল হওয়ার আস্থাটুকুও পেয়েছি। এবারের ডেঙ্গুর কারণে কিছু কিছু ব্যক্তিকে বিনোদনের কারণ হতে দেখেছি যাদের আমরা অন্যভাবে চিনতাম, শ্রদ্ধাও করতাম। তারা এখন আমাদের সামনে অন্য ভূমিকায় আর অন্য পরিচয়ে পরিচিত হচ্ছেন। পাশাপাশি উল্টোটাও কিন্তু সত্যি। কেউ কেউ এই সংকটকালে তাদের ভূমিকার কারণেই আমাদের কাছে হয়ে উঠছেন আস্থার প্রতীক যেমন আমাদের মাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জনাব জাহিদ মালেক এমপি। এই তালিকায় আছেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসাপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়াও। দিনে-রাতে বিরামহীন ছুটাছুটি তাদের ডেঙ্গু নিয়ে। কখনও পজেটিভ টকশো কিংবা প্রেসমিটে তো পর মুহূর্তেই হাসপাতালের করিডোরে। প্রশাসনের গণ্ডি পেরিয়ে তারা এখন আমাদের সবার কাছে ডেঙ্গুর কাউন্টার ফেস।
তবে এবারের ডেঙ্গু থেকে জাতি হিসেবে আমাদের যা সবচাইতে বড় প্রাপ্তি, আমার কাছে তা হলো আমরা আরেকবার বুঝতে পারলাম আমাদের সিদ্ধান্ত নেয়ায় কোনো ভুল ছিল না। ডেঙ্গুর মহামারির শুরুতে চারদিকে যখন সবার একটা হত্চকিত দশা, উদ্যোগ আছে কিন্তু উদ্যম নাই, আবার উদ্যম থাকলেও নেই কোনো রকম সমন্বয়, মানুষ যখন ছোট এডিসের ধাক্কায় চোখের সামনে দেখছে লাল-নীল-হলুদ বাতি, তখন আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় দলের সাধারণ সম্পাদকের মোবাইলে বিদেশ থেকে আসা একটি ফোনকল আর কিছু দিক-নির্দেশনা সবকিছুকে কীভাবে যেন একটা বিনিসুতার মালায় গাঁথলো। পরদিন থেকে ডেঙ্গু জয়ে চারদিকে সাজ-সাজ রব আর সবার সমন্বিত উদ্যোগ। দেখে ভালো লাগছে এক মাসের মধ্যে ডেঙ্গু বিদায় হোক চাই নাই হোক, বছরের শুরুতে সিদ্ধান্ত নেয়ায় বাঙালি কোনো ভুল করেনি।
লেখক : চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।
বিএ
Advertisement