মতামত

বিষাদ আর আতঙ্কের চাদরে ঢাকা ঈদ

মুসলমানদের দুই উৎসব, দুই ঈদ। তবে এ দুটি উৎসবেও স্বাধীনভাবে আনন্দটা আসে না, নিয়ন্ত্রিত আনন্দ। জগতে আসলে অবাধ বলে কিছু নেই। সবকিছুরই একটা নিয়ম, শৃঙ্খলা, জবাবদিহিতা আছে। স্বাধীনতা মানেও কিন্তু স্ব মানে নিজের অধীনতা। যাক বলছিলাম ঈদের আনন্দের কথা। ঈদুল ফিতরের আনন্দ আসে সংযমের হাত ধরে। মানে এক মাস সংযমের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারলেই কেবল ঈদুল ফিতরের আনন্দ করার ধর্মীয় অধিকার জন্মায়।

Advertisement

তেমনি ঈদুল আজহা আসে ত্যাগের মহিমায়। তাই বলে ভাববেন না, একটি পশু জবাই দিতে না পারলে আপনার আনন্দ করার অধিকার খারিজ হয়ে যাবে। কারণ পশু কোরবানিটা প্রতীকী এবং সামর্থ্যবানদের জন্য। কোরবানির ধারণাটা এসেছে ত্যাগ থেকে। স্রষ্টার জন্য নিজের সর্বোচ্চ ত্যাগ, সবচেয়ে প্রিয় জিনিসকে কোরবানি দেয়া। প্রেমে পড়লে মানুষ যেমন প্রেমিকার জন্য সবকিছু করতে পারে, এও তেমন বৃহত্তর প্রেম। স্রষ্টার সঙ্গে তার সৃষ্টির প্রেম, আর প্রেমের জন্য সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটাকেই উৎসর্গ করা।

হজরত ইবরাহিম (আ.) আল্লাহর জন্য তার সবচেয়ে প্রিয় সন্তান হজরত ইসমাইল (আ.) কেই উৎসর্গ করতে তৈরি ছিলেন। স্রষ্টার প্রতি প্রেমের পরীক্ষায় তিনি উত্তীর্ণ হন। আল্লাহও তার ত্যাগকে গ্রহণ করেন এবং হজরত ইবরাহিমের ছুরির নিচে থাকলেও হজরত ইসমাইলের পরিবর্তে একটি দুম্বা জবাই হয়। সেই প্রতীকী পশু কোরবানির রেওয়াজ চালু হয়েছে। পরে হজরত মোহাম্মদ (সা.) ইসলাম ধর্ম প্রবর্তনের পর কোরবানি ধর্মীয় বিধানে পরিণত হয়।

কিন্তু কোরবানির চেতনার সঙ্গে যে ত্যাগের মহিমা জড়িত, আজকের বাংলাদেশে কোরবানির ধরন দেখলে বোঝা যায়; আমরা তা থেকে ১৫০০ বছর দূরে সরে গেছি। আজকের বাংলাদেশে কোরবানি মানেই বাণিজ্য- গরুর হাট থেকে শুরু করে চামড়া পর্যন্ত পদে পদে বাণিজ্য, চাঁদাবাজি।

Advertisement

সেদিন কোনো এক পত্রিকায় দেখলাম এবার কোরবানির ঈদে ৪৫ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হবে। উৎকট বাণিজ্যের নিচে চাপা পড়ে গেছে ত্যাগের মহিমা। ত্যাগ নয় ভোগটাই আসল হয়ে গেছে। কার গরুর দাম কত বেশি, কার গরু দেখতে কত সুন্দর, কার গরুর মাংসটা খেতে মজা হবে, কে গরুর বাজারে জিতলেন- সব আলোচনা এখানেই। এ যেন গরুর মাংসের বাৎসরিক নিলাম। এমনিতে বাজারে গরুর মাংসের দাম ৫০০ টাকার ওপরে। কোরবানিতে দাম অনেক কম পড়ে। ধর্মও হলো, মাংসও হলো- মন্দ নয়। তবে আমি এ কদিনের আলোচনায় কোথায় স্রষ্টার প্রতি সৃষ্টির আনুগত্য, প্রেমের জন্য সব ত্যাগ করতে পারার যে আকাঙ্ক্ষা; তা কোত্থাও পাইনি।

তবে বাংলাদেশে ঈদ এসে আতঙ্ক আর বিষাদের চাদরে মুড়িয়ে। দেশজুড়ে ডেঙ্গু জ্বরের আতঙ্ক। তবে এ আতঙ্ক নিছক আতঙ্ক নয়, সত্যিকারের বিপদ। কখন যে কে বিপাকে পড়বে বোঝা মুশকিল। ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা অনেক আগেই রেকর্ড ছাড়িয়েছে। একশরও বেশি মানুষের পরিবারে এবার ঈদ আসেনি। একবিংশ শতাব্দীতে, ডিজিটাল বায়লাদেশে, সবচেয়ে আধুনিক হাসপাতালে দুদিনের জ্বরে সন্তানের মরে যাওয়া দেখে আর কোন বাবা-মা ঈদ করতে পারে।

তবে যারা মারা গেছে, শুধু তাদের পরিবারে নয়; আতঙ্ক ঘরে ঘরে। ঈদুল আজহার মশার বিস্তার বাড়ার একটা আশঙ্কা থাকে। কিন্তু ত্যাগের মহিমায় উজ্জীবিত হয়ে আমরা যদি এবার সবাই মিলে ঈদের বর্জ্য পরিষ্কার করি, দ্রুততম সময়ে যদি আমরা চারপাশ নিরাপদ রাখি তাহলেই শুধু মশার বিস্তার রোধ সম্ভব। নইলে আতঙ্ক আরও ছড়াবে, ঈদহারা পরিবার আরও বাড়বে।

তেমন সময় না আসুক। প্রত্যেক ঘরে ঈদ আসুক আনন্দের বারতা নিয়ে, ত্যাগের মহিমা নিয়ে।

Advertisement

বিএ/এমএস