মতামত

বিজ্ঞান অনুষদে শিক্ষার মান উন্নয়নের রূপরেখা

আমাদের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার কারণে বিজ্ঞান অনুষদের ছাত্র-শিক্ষকদের প্রতিনিয়ত কিছু না কিছু সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। আমি এখানে সেই সমস্যাগুলো তুলে ধরতে চেয়েছি এবং বিজ্ঞান অনুষদে শিক্ষার মান উন্নয়নে কিছু সমাধান দেয়ার চেষ্টা করেছি।

Advertisement

১. উন্নত দেশগুলোর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের উপস্থিতি নেয়া হয় না। ছাত্রছাত্রীরা যদি মনে করে তাদের ক্লাস করার প্রয়োজন আছে তাহলে তারা এমনিতেই ক্লাসে আসবে। ক্লাসে উপস্থিতি নেয়া একটা হাস্যকর ব্যবস্থা। প্রথমেই ক্লাসে উপস্থিতি নেয়া এবং উপস্থিতির জন্য যে নম্বর দেয়ার ব্যবস্থা আছে সেটা তুলে দেয়া উচিত।

২. বিজ্ঞান অনুষদে পরীক্ষা পদ্ধতিতে ৩০ নম্বর রাখা হয়েছে উপস্থিতি এবং ধারাবাহিক মূল্যায়নের জন্য। বাকি ৭০ নম্বর রাখা হয়েছে চূঁড়ান্ত মূল্যায়নের জন্য। আমাদের অধিকাংশ পরীক্ষার প্রশ্ন এমনভাবে করা হয় যেন একজন ছাত্র শুধু মুখস্থ করেই “এ” গ্রেড পেতে পারে। আমরা শিক্ষকরা যদি প্রশ্নপত্র এমনভাবে নির্বাচন করি যাতে করে ছাত্র-ছাত্রীরা মুখস্ত করে উত্তর লেখার বদলে জানার দিকে মনোযোগী হবে, তাহলে ছাত্র-ছাত্রীরা ক্লাসে আসবে এবং জানার ব্যাপারে আগ্রহী হবে।

৩. ছাত্র-ছাত্রীদের জানার আগ্রহ তৈরির জন্য তাদেরকে ক্লাসে বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত রাখতে হবে। সেটা হতে পারে অ্যাসাইনমেন্ট, কুইজ, বা কোনো বিষয়ের ওপর প্রেজেন্টেশন ও লেকচার দেয়া। আমাদের পরীক্ষার পূর্ণ নম্বর হচ্ছে ১০০। আমরা একে দুইটি ভাগে ভাগ করতে পারি, প্রথমত আমরা ৬০ নম্বর রেখে দিতে পারি ইনকোর্স, অ্যাসাইনমেন্ট, কুইজ, গ্রুপ প্রেজেন্টেশনে। দ্বিতীয়ত বাকি ৪০ নম্বরের জন্য তারা পরীক্ষার হলে যাবে এবং পরীক্ষা দেবে। এতে করে পরীক্ষার আগে পড়ার চাপও কমে যাবে এবং পড়ালেখার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠবে। এছাড়া প্রথম বর্ষ থেকে পেশাগত দক্ষতা অর্জনের দিকে নজর দিতে হবে এবং প্রতিটি বিভাগে ইনকোর্সগুলো নেয়ার জন্য ইনকোর্স সপ্তাহ চালু করা উচিত।

Advertisement

৪. আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মান উন্নয়নে দরকার একটু সুনির্দিষ্ট একাডেমিক প্ল্যান। একজন শিক্ষককে অবশ্যই কোর্সের শুরুতে কোর্সের ডেডলাইন, ইনকোর্স, কুইজ এবং বার্ষিক পরীক্ষার তারিখ নির্দিষ্ট করে বলে দিতে হবে। একজন শিক্ষককে প্রতিটা কোর্স শুরু করার আগে কোর্সের প্রয়োজনীয়তা, কোর্সের বাস্তব জীবনে প্রয়োগ, ক্লাসের মাঝে কোর্সের আকর্ষণীয় বিষয়গুলো তুলে ধরা, জটিল বিষয়বস্তু পড়ানোর আগে সেটি সম্পর্কে একটু প্রস্তুতিমূলক ধারণা দেয়া, সামান্য ইতিহাস বলা, বিষয়টি কেন পড়ানো হচ্ছে এবং সে বিষয়ে বর্তমানে কী ধরনের গবেষণা হচ্ছে তা ছাত্র-ছাত্রীদেরকে জানানো উচিত। একই সঙ্গে প্রত্যেক শিক্ষককে একাডেমিক কাউন্সেলিংয়ের জন্য ছাত্র-ছাত্রীদেরকে সপ্তাহে দুই ঘণ্টা করে সময় দেয়া উচিত।

৫. আমাদের অনেক বিভাগে বিভিন্ন বর্ষে ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যা ৭০ থেকে ১৫০ এর মতো। এই বিশাল ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে ৩নং এ উল্লিখিত প্ল্যান কার্যকর করা এক কথায় অসম্ভব। একজন শিক্ষকের পক্ষে কখনোই এতগুলো ছাত্র-ছাত্রীর জন্য অ্যাসাইনমেন্ট তৈরি করা, কুইজ নেয়া, ইনকোর্স এবং বার্ষিক পরীক্ষার খাতা দেখা এবং গ্রেডিং করা, ঠিক সময়ে পরীক্ষার ফলাফল দেয়া সম্ভব নয়। এ জন্য আমাদের অবশ্যই শিক্ষক সহকারী নিয়োগ করতে হবে। একই সঙ্গে বিভাগে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য একটি ডিসকাশন ফোরাম ল্যাব থাকবে যেখানে প্রথম বর্ষ থেকে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের কোর্স বিষয়ক যেকোনো সমস্যা নিয়ে যেতে পারবে এবং যারা শিক্ষক সহকারী থাকবে তারা তাদেরকে সাহায্য করবে।

৬. পৃথিবীর সব বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন শিক্ষক ক্লাসে কেমন পড়ালেন সে বিষয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে মতামত নেয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদে শিক্ষকরা ক্লাস রুমে পড়ান কিন্তু ছাত্র-ছাত্রীরা সেই শিক্ষক কেমন পড়ালেন এ বিষয়ে তাদের মতামত দেয়ার অধিকার নেই। অন্তত তাদের মতামত দেয়ার যদি সুযোগ থাকতো এবং সেটা যদি শুধুমাত্র সেই শিক্ষকও জানতেন তাহলে হয়তো উনি পরবর্তীতে তাদের মতামত দেখে আরও ভালোভাবে কোর্সটাকে উপস্থাপন করতে পারতেন।

৭. আমার জানি জ্ঞানের উৎস হলো বই এবং সেই বইগুলোকে সংরক্ষণ করার জন্য দরকার লাইব্রেরি। প্রতিটা বিভাগে বিভাগ ভিত্তিক ই-লাইব্রেরি চালু করা দরকার। একজন স্টুডেন্ট বাংলাদেশের যেকোনো জায়গা থেকেই তার লাইব্রেরি যেন অ্যাকসেস করতে পারে সেই সুবিধা থাকা উচিত। একই সঙ্গে লাইব্রেরি তে ই-বুক রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।

Advertisement

৮. ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা কার্যক্রমে অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তাদের রেজাল্ট সময়মতো জানিয়ে দেয়া। প্রতি বিভাগের ওয়েবসাইটে যদি প্রথম থেকে তৃতীয় বর্ষের রেজাল্ট অনলাইনে পাবলিশ করে দেয়া হতো তাহলে কাজটা খুব সহজ হতো। প্রতি শিক্ষকের কাছে অনলাইন অ্যাকসেস থাকবে এবং সহজেই একজন শিক্ষক রেজাল্ট আপলোড করে দিতে পারবে। অনেক কম সময়ে একজন ছাত্র-ছাত্রী জেনে যাবে তার রেজাল্ট। শুধু রেজাল্ট জানতে না পারার জন্য তাদের প্রতিটি বর্ষে অনেকটা সময় নষ্ট হয়, তারা বুঝে উঠতে পারে না, তাদের এখন কোন বর্ষে ক্লাস করা উচিত। পুনঃভর্তিকৃত ছাত্রছাত্রীদের ভর্তিতে দুর্ভোগ যাতে কম হয় সেদিকেও নজর দেয়া দরকার। একই সঙ্গে ইনকোর্স এবং কুইজ পরীক্ষার ফলাফল পরীক্ষা হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে প্রকাশ করার বাধ্যবাধকতা থাকতে হবে।

৯. আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো, বিভাগের সব কার্যক্রম ডিজিটাল করা। শিক্ষকদের যেমন নিজস্ব পোর্টাল আছে এবং তাদের অ্যাকসেস আছে, একই সঙ্গে ছাত্র-ছাত্রীদেরও স্টুডেন্ট অ্যাকাউন্ট থাকার ব্যবস্থা করা উচিত। সেখানে স্টুডেন্টদের ছাত্রত্ব থাকাকালীন অবস্থায় সকল তথ্য সংরক্ষিত থাকবে উপরের উল্লিখিত ডিজিটাল প্ল্যানগুলো কার্যকর করার জন্য আমাদের দরকার গ্রুপ অব আইটি প্রফেশনালস যারা এই সিস্টেমটাকে রক্ষণাবেক্ষণ করবে।

১০. মাস্টার্স প্রোগ্রামে এখন ছাত্র-ছাত্রীরা থিসিস এবং নন-থিসিস, এই দুই ধরনের প্রোগ্রামে ভর্তি হয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে এই প্রোগ্রামগুলো রিসার্চ মাস্টার্স এবং টট মাস্টার্স প্রোগ্রামে ভাগ করা দরকার। (ক) রিসার্চ মাস্টার্স কী? এই প্রোগ্রামে শুধু তারাই ভর্তি হবে যাদের ভবিষ্যতে গবেষক এবং শিক্ষক হওয়ার ইচ্ছে আছে। এটা হবে দুই বছর মেয়াদি প্রোগ্রাম যেখানে একজন স্টুডেন্ট অন্তত দুই বছর একজন তত্ত্বাবধায়কের অধীনে গবেষণা করার সুযোগ পাবে। এই প্রোগ্রাম চলাকালীন তাকে যদি গবেষণা করার জন্য কোনো বিষয় জানতে হয় তাহলে সে সেটা করবে কিন্তু তার জন্য তাকে কোনো পরীক্ষায় বসতে হবে না। এই প্রোগ্রাম শেষে তাকে একটি মাস্টার্স থিসিস জমা দিতে হবে এবং থিসিস কমিটি সেটা মূল্যায়ন করবে। (খ) টট মাস্টার্স কী? এটা হবে এক বছর মেয়াদি মাস্টার্স প্রোগ্রাম। এই প্রোগ্রামে একজন স্টুডেন্ট নির্দিষ্ট সংখ্যক বিষয় নিয়ে পড়বে এবং নির্দিষ্ট সংখ্যক ক্রেডিট শেষ করবে। এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচলিত নন-থিসিস মাস্টার্স প্রোগ্রামের রূপরেখাতেই চলবে।

১১. বিজ্ঞান অনুষদের ছাত্র-ছাত্রীদের মানসিক স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখার জন্য অবশ্যই বিজ্ঞান অনুষদে আলাদা মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র খোলা দরকার, বিজ্ঞান অনুষদে ছাত্র-ছাত্রীদের খাবার জন্য ভালো এবং মানসম্মত কোনো ক্যান্টিন নেই, সে ব্যাপারেও নজর দেয়া দরকার। শিক্ষকদের সন্তানদের জন্য একটি ডে-কেয়ার সেন্টার খোলারও ব্যবস্থা নেয়া উচিত। পড়াশুনার পাশাপাশি আইটি সেক্টরে ছাত্র-ছাত্রীরা যেন ভালো করতে পারে সে জন্য আলাদা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেয়া দরকার। এছাড়া প্রতিটা বিভাগে নিয়মিত সেমিনার, অলিম্পিয়াড এবং কনফারেন্সের আয়োজন করা এবং তাতে ছাত্র-ছাত্রীদের অংশগ্রহণের জন্য উৎসাহিত করা দরকার।

সমস্যা হয়তো আরও আছে কিন্তু উপরের সমস্যাগুলো সমাধান করা হলে আমরা খুব দ্রুত একটা ভালো অবস্থানে চলে আসতে পারব। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদ শিক্ষা আর গবেষণায় দেশের সেরা হয়ে উঠুক এই আশা আর স্বপ্ন পূরণের স্বপ্ন নিয়েই হোক আমাদের আগামীর পথচলা।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, গণিত বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

এইচআর/বিএ/পিআর