খেলাধুলা

আইসক্রিমের লোভে লাফানো মেয়েটিই হয়েছিলেন দশবার দেশসেরা

দুরন্তপনার সঙ্গেই বেশি সখ্যতা ছিল তার। সারাবাড়ি দৌড়ানো, লাফালাফি। নিজেদের দেয়াল থেকে পাশের বাড়ির ঘরের চালে লাফ দিয়ে ব্যাথা পাওয়ার ঘটনাও কম ছিল না। তারপরও এমন দুরন্ত মেয়েকে থামায় সাধ্য কার?

Advertisement

মেয়ের এই চঞ্চলতা দেখে আমির উল হক বিরক্ত না হয়ে বরং নিজেও মজা নিতেন। নিজেদের উঠানে রশির একপাশ কিছুর সঙ্গে বেঁধে আরেক পাশ ধরে মেয়েকে বলতেন লাফিয়ে পার হও দেখি! আমির উল হকের তিন সন্তানের (২ পুত্র ও ৩ কন্যা) সবার ছোট ফিরোজা খাতুন লাফিয়ে বাবার দেয়া টার্গেট পার হতেন।

বাবা আরেকটু উঁচু করে রশি ধরে বলতেন এবার পার হতে পারলে আইসক্রিম দেবো। ফিরোজা বেশি বেশি আইসক্রিম পাওয়ার লোভে বেশি বেশি লাফ দিতেন। আইসক্রিমের লোভে বাড়ির উঠানে লাফানো সেই ফিরোজা বাংলাদেশের অ্যাথলেটিক্সে অনন্য এক নাম। টগবগে ক্যারিয়ারে দশবার হয়েছিলেন দেশসেরা।

না। ফিরোজা কিন্তু লাফিয়ে দেশসেরা হননি। হয়েছিলেন স্প্রিন্টে। ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ইভেন্ট ১০০ মিটার স্প্রিন্টে স্বর্ণ জিতেছেন ১০ বার। ১৯৮৭ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ১০ বার দেশের দ্রুততম মানবী হয়ে নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য এক উচ্চতায়।

Advertisement

ময়মনসিংহ শহরের বুড়াপীরের মাজার গলির ফিরোজাদের বাড়িতে তখন উঠান ছিল। এখন নেই। সেই গল্প বলতে গিয়ে ফিরোজা খাতুন ফিরে গেলেন সেই দুরন্তপনা শৈশবে, ‘আমি তখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ বা পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ি। ছোটকাল থেকেই আমি ছিলাম চঞ্চল প্রকৃতির। ওই সময় একা একা সাইকেল চালাতাম। প্রতিদিন দুপুরে মা কখন ঘুমোবেন অপেক্ষায় থাকতাম। মা ঘুমালেই ঘর থেকে বের হয়ে সাইকেল চালাতাম, দৌড়-ঝাঁপ দিতাম। সন্ধ্যা হলে চোরের মতো ঘরে ঢুকতাম। তারপরও বহুবার মার খেতে হয়েছিল মায়ের হাতে।’

পরিবারের অন্য কেউ খেলাধুলায় সম্পৃক্ত ছিলেন না। তাই তো ছোট মেয়ের খেলার আগ্রহটা শাসন করে হলেও মেনে নিয়েছিলেন বাবা-মা। এক সময়ে উৎসাহও দিয়েছেন। সেই মেয়েই বড় হয়ে উজ্জ্বল করেছেন বাবা-মা’র মুখ। লাফিয়ে লাফিয়ে খেলায় ঢুকলেও ফিরোজা খাতুন ক্যারিয়ারে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন দৌড়ে।

হাই জাম্পার থেকে স্প্রিন্টার হলেন কিভাবে? গল্পটা ফিরোজা খাতুনের কাছেই শোনা যাক। ‘আমি ১৯৮৪-৮৫ সালে ময়মনসিংহ জুট মিলের হয়ে উচ্চ লম্ফ করতাম। এরপরই একটা ঘটনায় বদলে যায় আমার ইভেন্ট। বিজেএমসির বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় ঘোড়াশালে খেলতে গিয়েছিলাম ময়মনসিংহ জুট মিলের হয়ে; কিন্তু তখন আমাদের ২০০ মিটার দৌড়ে খেলার কোনো মেয়ে ছিল না। দল থেকে আমাকে বলা হলো, ২০০ মিটারে খেলতে। আমি দৌড়ে সম্ভবত তৃতীয় হয়েছিলাম। তারপর ময়মনসিংহের সিনিয়র এক অ্যাথলেট জামাল ভাই বলেন, উচ্চ লম্ফ না, তুমি দৌড়ের অনুশীলনই করো। শুরু হলো আমার নতুন ইভেন্ট। জামাল ভাইয়ের পরামর্শেই ১৯৮৫ সালের সাফ গেমসের জন্য উম্মুক্ত ট্রায়ালে আমি দৌড়ে অংশ নিলাম’- খেলাধুলার ক্যারিয়ারের বাঁক বদলের গল্পটা এভাবেই বলছিলেন ফিরোজা খাতুন।

১০ বারের দ্রুততম মানবী ফিরোজা খাতুন দেশের বর্তমান অ্যাথলেটিকস নিয়ে বলেন, ‘এখন তো অনেক সুযোগ-সুবিধা। আমরা তো অনুশীলনের সুযোগই পেতাম না ঠিক মতো। ময়মনসিংহে তখন একটি মাত্র জিমনেশিয়াম ছিল। সেখানে ভারোত্তোলকরা অনুশীলন করতেন। আমরা দাঁড়িয়ে থাকতাম, কখন তাদের অনুশীলন শেষ হবে। তারপর আমরা শুরু করবো। আমরা অনুরোধ করে করে অনুশীলন করতাম।’

Advertisement

আপনাদের সময় তো অ্যাথলেটিকস দেখতে অনেক দর্শক আসতো। এখন তো ফাঁকা গ্যালারির সামনে অ্যাথলেটরা দৌড়ান। এটাকে কিভাবে দেখবেন? ‘আমরা যখন দৌড়াতাম তখন তো আর গ্যালারির দিকে তাকাতাম না। দৌড় নিয়েই ব্যস্ত থাকতাম (হা হা হা)। তবে হ্যাঁ, এখন অ্যাথলেটিকসে দর্শক কম হয়’- বলছিলেন ফিরোজা।

নিজের সাফল্যের জন্য এলাকার সিনিয়র অ্যাথলেট জামালের কথা কখনো ভুলবেন না ফিরোজা, ‘বাবা-মা আমাকে কোলেপিঠে করে বড় করেছেন। শিক্ষা-দিক্ষা দিয়ে মানুষ করেছেন; কিন্তু আমাকে অ্যাথলেট তৈরি করেছিলে জামাল ভাই। আমি তার কাছে চির কৃতজ্ঞ।’

মাহমুদা, রাফেজা, বীনা, লাভলী আর রেহানারা তখন পুরোদস্তর দৌড়বিদ। এদেরই বিভিন্ন সময়ে হারিয়ে দেশের দ্রুততম মানবী হয়েছিলেন ফিরোজা খাতুন। বর্তমানে ময়মনসিংহ বিভাগীয় মহিলা ক্রীড়া সংস্থার সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। দেশের সাবেক এই দ্রুততম মানবী ক্যারিয়ারে পেয়েছেন জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার, বাংলাদেশ ক্রীড়ালেখক সমিতি এবং বাংলাদেশ ক্রীড়ালেখক সমিতি ময়মনসিংহ শাখার পুরস্কার।

আরআই/আইএইচএস/এমকেএইচ