ক্রিকেটে সাফল্যের জন্য টেকিনিক্যাল মগজাস্ত্রের ব্যাবহার নতুন কিছু নয়। কিন্তু দিন শেষে সাফল্যের হিসাব মেলানো হয় একেবারে অংক শাস্ত্র দিয়ে। কে কতো বড় ক্রিকেটার, কার টেকনিক কতো ভাল এসব নিয়ে আলোচনা সাময়িক। কিন্তু গ্রেট ব্যাটসম্যান, গ্রেট বোলার কিংবা গ্রেট টিম এ সরণি-তে ক্রিকেটার বা কোনো টিমকে রাখতে গিয়ে অংককে বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়। স্যার ডন-ই সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান কথাটাকে ক্রিকেট মনস্ক মানুষগুলো মেনে নেন কারণ ডনের নামের পাশের সংখ্যাগুলো। অথচ ঐ ভদ্রলোক জীবিত থাকার সময়েই ইয়ান বোথামের মতো লোকও বলেছিলেন; ‘কোন বড় নামকে অবজ্ঞা না করেও বলছি, ভিভের চেয়ে ভালো কোনো ব্যাটসম্যান ক্রিকেট গ্রহে দেখিনি!’ সেটা কি বোথাম নিজের বিশ্বাস থেকে বলেছিলেন নাকি বন্ধুপ্রীতি থেকে তা নিয়ে তর্ক হতে পারে। কিন্তু বোথামের কথা ক্রিকেট বিশ্ব মেনে নেয়নি কারণ, ডনের নামের পাশের সংখ্যাগুলো।তবে এটাও ঠিক ক্রিকেটে শুধু সংখ্যা দিয়ে সব সমীকরণ মেলানো যায় না। মেলাতে গেলে গণ্ডগোলের শঙ্কা থেকে যায়। সে কারণেই বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া সিরিজের আগে লেখা যাচ্ছে না অস্ট্রেলিয়ার চেয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে। অথচ লেখার জন্য হাতের কাছে কতো সহজ অংক পড়েছিল! দুটো টেস্ট ম্যাচ খেলার জন্য অস্ট্রেলিয়া যে দলটা ঘোষণা করেছে তারা সবাই মিলে খেলেছেন ২০৭ টেস্ট। পনের সদস্যের ঐ দলে জনপ্রতি গড়ে টেস্ট খেলার অভিজ্ঞতা ১৩ দশমিক ৮। বাংলাদেশ এখনো তাদের দল ঘোষণা করেনি। তবে কারা থাকতে পারে সেটা মোটামুটি অনুমান করা যায়। পুরো দলের দরকার নেই। আপনি চোখ বন্ধ করে গোটা কয়েক নাম বসিয়ে দিতে পারেন, দলে যাদের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে কেউ কোনো প্রশ্ন তুলবেন না। তামিম ইকবাল, ইমরুল কায়েস, মুমিনুল হক, মুশফিকুর রহিম, মাহমুদউল্ল্যাহ, সাকিব আল হাসান। ইনজুরি ছাড়া অন্য কোনো কারণে এদের দলের বাইরে যাওয়ার সম্ভাবনা কম। একাদশে এরা সবাই না থাকলেও দলে থাকছেন এটা ধরে নিলে একটা তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, যে কারণে খেলা যায় বাংলাদেশের বিপক্ষে সিরিজে অস্ট্রেলিয়া ‘অনভিজ্ঞ’ একটা দল পাঠাচ্ছে!অভিজ্ঞতার সংজ্ঞা কি হবে তা নিয়ে লম্বা আলোচনা হতে পারে। বিভিন্ন মতবাদ দেয়া যেতে পারে। তবে ম্যাচ খেলার সংখ্যা যদি কম হয়, তাহলে সেই দলটাকে অনভিজ্ঞ বলা যেতেই পারে। আর সেই বিবেচনায় অস্ট্রেলিয়া দলটা তুলনামূলক অনভিজ্ঞ। পনের সদস্যের অস্ট্রেলিয়া দলের সর্বসাকূল্যে টেস্ট খেলার অভিজ্ঞতা ২০৭! আর এই মুহূর্তে বাংলাদেশ দলের ব্যাটিং লাইনের প্রথম ছয় ব্যাটসম্যান টেস্ট খেলেছেন ২০০! জনপ্রতি গড়ে টেস্ট খেলেছেন ৩৩ দশমিক ৩৩। অভিজ্ঞতার সংজ্ঞা যেভাবেই দেয়া হোক, বাংলাদেশ সেই অভিজ্ঞতার বিচারে কি এগিয়ে থাকবে না? তা ছাড়া খেলা হবে নিজেদের মাঠে। চেনা-জানা কন্ডিশনে। এবং এমন একটা সময়ে যখন ক্রিকেট বিশ্বে একটা আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে; বাংলাদেশ ভালো ক্রিকেট খেলছে। তাছাড়া বাংলাদেশ দলের ড্রেসিংরুমে থাকবেন এমন একজন কোচ যিনি অস্ট্রেলিয়ার এই দলটাকেও ভালোভাবে চেনেন। কারণ, শুধু সিডনি প্রবাসী হয়ে বসে থাকেননি হাথুরুসিংহে। এই শ্রীলংকান ঢুকে পড়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট অলিন্দে। স্টিভ স্মিথদের ক্রিকেটীয় ডিএনএ-টাও তাঁর চেনা। তাহলে এই সিরিজে কোনো বল বাইশ গজে পড়ার আগে কি বাংলাদেশ এগিয়ে?হ্যাঁ, এগিয়ে। কথাটা লিখতে পারলে দেশপ্রেমিক ক্রিকেটানুরাগীদের মন ভরিয়ে দেয়া যেতো। কিন্তু লেখা যাচ্ছে না। কারণ, খেলাটা ক্রিকেট। যেটা আসলে জীবনের মতো, চেয়েও সব সময় পাওয়া যায় না। তাই না পাওয়ার আগ পর্যন্ত কারো মনে ‘পেয়ে গেছি’- গোছের আগাম পরিতৃপ্তি সঞ্চারিত করার কোনো মানে হয় না। বরং অনেক রক্তাক্ত, ক্ষত-বিক্ষত, হয়ে পাওয়ার পরই বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসে ভাসা ভালো।অনভিজ্ঞ দল অস্ট্রেলিয়ার। তবে সেই দলটার মধ্যে খুনে মেজাজের অভাব থাকবে তেমনটা ভাবলে ভুল হবে। বিনা লড়াইয়ে ওরা হাফ ইঞ্চি জায়গাও ছাড়বে না তা জোর দিয়ে বলা যায়। তবু এরকম একটা দলের বিপক্ষে কেন বাংলাদেশ জয়ের কথা ভাববে না? একদম ঠিক কথা। কেন জেতার কথা ভাববে না বাংলাদেশ? ভাবা উচিত। ভাবতে না পারলে জেতাও যাবে না। তবে এটাও সত্যি, অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটে হঠাৎ একটা পরিবর্তনের হওয়া বইছে ঠিক-ই। তবে তাতেই ওদের দলটা একেবারে এলোমেলো হয়ে গেছে এটা ভাবার কোনো কারণ নেই। অতো দারিদ্র্য ভর করেনি স্যার ডনের দেশের ক্রিকেটে। দলে অভিজ্ঞতার অভাব দেখা যাচ্ছে ঠিকই। তবে তাদের ক্রিকেটীয় সম্পদ আর প্রতিভার ভাণ্ডারে টান পড়েনি। সেটা বুঝতে খুব বেশি মগজাস্ত্র প্রয়োগের দরকার পড়ছে না।‘অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট জয়’ এই শব্দগুলোকে একটু দূরে সরিয়ে রেখে সিরিজ শেষে যদি লেখা যায়; অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট হারলো না বাংলাদেশ! এরচেয়ে স্বস্তিদায়ক বাক্য আপাত কি হতে পারে বাংলাদেশ ক্রিকেট প্রেসের জন্য? কিন্তু স্বস্তির পাশাপাশি শঙ্কার একটা চোরা স্রোতও বইছে। কারণ, এই অস্ট্রেলিয়া যে ইংলিশ সিংহের কাছে রক্তাক্ত হয়ে ক্রিকেটীয় ছাইভস্ম সব হারিয়েছে! আবার সিংহাসনে বসার জন্য বাংলাদেশ থেকে সবকিছু লুটপুটে নিতে চাইবে অজিরা।লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘ইনজুরি টাইম’ ‘এক্সট্রা টাইম’ ব্যাপক পাঠক প্রিয়তা পেয়েছে। তিনি কাজ করেছেন দেশের নেতৃস্থানীয় বিভিন্ন দৈনিকে, টেলিভিশন এবং দেশি-বিদেশি রেডিওতে।এইচআর/এমএস
Advertisement