লোকসানের কবলে চারটি, মুনাফার দেখা পেলেও আগের বছরের তুলনায় কমেছে ছয়টির, পরিচালন নগদপ্রবাহ বা ক্যাশ ফ্লো ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে ১২টির, সম্পদ মূল্য কমেছে আটটির এবং একটির সম্পদ মূল্য ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে। এ চিত্র দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত অব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা লিজিং কোম্পানিগুলোর।
Advertisement
সার্বিকভাবে আমানত, তারল্য, মুনাফা, সম্পদ মূল্য নিয়ে সংকটের মধ্যে রয়েছে দেশের অব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। এ খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর এই দুরবস্থা সার্বিক আর্থিক খাতকেও সংকটের মধ্যে ফেলে দিয়েছে।
আরও পড়ুন >> কোথা থেকে আসল ব্যাংকের এত মুনাফা?
চলতি বছরের প্রথমার্ধের হিসাবে মুনাফা, সম্পদ মূল্য ও ক্যাশ ফ্লো- এ তিন সূচকের কোনোটিতেই নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি তালিকাভুক্ত মাত্র তিনটি অব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের। জুলাই-জুন হিসাববর্ষ নির্ধারণ থাকায় ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশকে (আইসিবি) বিবেচনায় নেয়া হয়নি। পিপলস লিজিং অবসায়নের উদ্যোগ নেয়ায় এটিকেও হিসাব থেকে বাদ দেয়া হয়েছে।
Advertisement
বাকি ১৮টি প্রতিষ্ঠানেরই মুনাফা, সম্পদ মূল্য অথবা ক্যাশ ফ্লো- এ তিন সূচকের এক বা একাধিক সূচকে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি লিমিটেড (বিআইএফসি)। প্রতিষ্ঠানটি নগদ অর্থ সংকটের পাশাপাশি লোকসানে নিমজ্জিত রয়েছে। এমনকি ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে সম্পদ মূল্যও।
বাকিগুলোর মধ্যে লোকসানের পাশাপাশি সম্পদ মূল্য কমেছে চারটির। এর মধ্যে তিনটির অর্থসংকটও আছে। মুনাফায় থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে পাঁচটির সম্পদ মূল্য আগের বছরের তুলনায় কমেছে। এছাড়া মুনাফা কমে যাওয়ার পাশাপাশি অর্থসংকটে পড়েছে তিনটি প্রতিষ্ঠান। আবার মুনাফা কিছুটা বাড়লেও অর্থসংকটে পড়েছে সাতটি প্রতিষ্ঠান।
নিয়ম অনুযায়ী, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোকে প্রতি তিন মাস পরপর আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করতে হয়। এরই আলোকে তালিকাভুক্ত ২৩ অব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২১টি চলতি বছরের প্রথমার্ধ শেষে এপ্রিল-জুন প্রান্তিকের পাশাপাশি অর্ধবার্ষিক (জানুয়ারি-জুন) প্রতিবেদনও প্রকাশ করেছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রকাশিত ওই আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অধিকাংশ অব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থা ভলো নয়। এসব প্রতিষ্ঠানের ওপর গ্রাহকের আস্থা নেই। তারল্য সংকটের কারণে গ্রাহকের আমানত ফেরত দিতে অনেকে সমস্যায় পড়ছেন। অবার ব্যাংক খাতও খুব একটা ভালো অবস্থায় নেই। এ কারণে বেশির ভাগ আর্থিক প্রতিষ্ঠান সংকটের মধ্যে পড়েছে।
Advertisement
আরও পড়ুন >> রেড জোনে ১২ লিজিং কোম্পানি, বৈঠকে বসছেন অর্থমন্ত্রী
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, লিজিং কোম্পানিগুলো অবশ্যই সংকটের মধ্যে রয়েছে। আমানতের পাশাপাশি ঋণের প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। অনেকে গ্রাহকের টাকা পরিশোধ করতে পারছে না। লিজিং কোম্পানিগুলোর এ চিত্র সার্বিক আর্থিক খাতকেই সংকটের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এ সংকট বাড়িয়েছে ব্যাংক খাত। আর্থিক খাতের এ সংকট দূর করতে হলে অবশ্যই ব্যাংক খাত ঠিক করতে হবে।
লিজিং কোম্পানিগুলো সংকটে পড়ার কারণ হিসেবে বিশিষ্ট এ অর্থনীতিবিদ বলেন, আমানত না পাওয়ায় লিজিং কোম্পানিকে অতিরিক্ত সুদে আমানত সংগ্রহ করতে হচ্ছে। কিন্তু অতিরিক্ত এ সুদ বহন করার মতো ব্যবসা কোম্পানিগুলো করতে পারছে না। সাধারণ গ্রাহকদের পাশাপাশি লিজিং কোম্পানির আমানতের বড় উৎস ব্যাংক। কিন্তু ব্যাংক খাত সংকটে থাকায় সেখান থেকেও লিজিং কোম্পানিগুলো আমানত পাচ্ছে না। কিছু কোম্পানি গ্রাহকের আমানতের টাকা ফেরত দিতে না পারায় এ খাতে একধরনের ইমেজ সংকটও তৈরি হয়েছে। সার্বিকভাবে ‘কস্ট অব ফান্ড’ বেড়ে যাচ্ছে। এসব বিষয় মিলে আর্থিক খাত সংকটের মধ্যে পড়েছে।
চলতি বছরের জানুয়ারি-জুন সময়ের আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বিআইএফসি’র পাশাপাশি ফারইস্ট ফাইন্যান্স, ফার্স্ট ফাইন্যান্স ও মাইডস ফাইন্যান্স লোকসানের কবলে পড়েছে। এর মধ্যে মাইডস ফাইন্যান্স চলতি বছরে নতুন করে লোকসানের খাতায় নাম লিখিয়েছে। বাকি দুটি প্রতিষ্ঠান গত বছরও লোকসানে ছিল। লোকসানের পাশাপাশি ফারইস্ট ফাইন্যান্স ও ফার্স্ট ফাইন্যান্সের সম্পদ মূল্যও আগের বছরের তুলনায় কমে গেছে। সেই সঙ্গে ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে ক্যাশ ফ্লো। আর মাইডস ফাইন্যান্সের ক্যাশ ফ্লো পজেটিভ থাকলেও কমে গেছে সম্পদ মূল্য।
ক্যাশ ফ্লো বা পরিচালন নগদ প্রবাহ ঋণাত্মক হয়ে পড়ার অর্থ হলো- নগদ অর্থের সংকট তৈরি হওয়া। শেয়ারপ্রতি ক্যাশ ফ্লো যত বেশি ঋণাত্মক হবে নগদ অর্থের সংকটও তত বাড়বে। এ অবস্থা তৈরি হলে চাহিদা মেটাতে চড়া সুদে টাকা ধার করতে হতে পারে। এতে খরচ বেড়ে যাবে এবং আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
ক্যাশ ফ্লো ঋণাত্মক হয়ে পড়া অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে- বিডি ফাইন্যান্স, ফাস ফাইন্যান্স, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, ইসলামীক ফাইন্যান্স, লংকাবাংলা ফাইন্যান্স, ন্যাশনাল হাউজিং ফাইন্যান্স, প্রিমিয়ার লিজিং, প্রাইম ফাইন্যান্স ও ইউনিয়ন ক্যাপিটাল।
আরও পড়ুন >> ‘রেড’ জোনে যেসব আর্থিক প্রতিষ্ঠান
আগের বছরের তুলনায় সম্পদ মূল্য ও মুনাফা কমে যাওয়ার তালিকায় রয়েছে- জিএসপি ফাইন্যান্স ও আইডিএলসি ফাইন্যান্স। সম্পদ মূল্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়া অন্য কোম্পানির তালিকায় রয়েছে- বিডি ফাইন্যান্স, লংকাবাংলা ফাইন্যান্স ও ইউনাইটেড ফাইন্যান্স। এছাড়া ডেল্টা ব্র্যাক হাউজিং ফাইন্যান্স করপোরেশন লিমিটেড (ডিবিএইচ), আইডিএলসি ও ফিনিক্স ফাইন্যান্স মুনাফা কমে যাওয়ার তালিকায় রয়েছে।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. মো. বখতিয়ার হাসান এ প্রসঙ্গে জাগো নিউজকে বলেন, আর্থিক বাজারের একটি খাত অন্য খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বাংলাদেশে আর্থিক বাজারে সবচেয়ে বড় খাত ব্যাংক। এ খাতই সমস্যার মধ্যে রয়েছে। যার প্রভাবে লিজিং কোম্পানিগুলোতে একধরনের সংকট দেখা দিয়েছে। এছাড়া গত কয়েক বছরে লিজিং কোম্পানিগুলোর ব্যবসা খুব একটা বাড়েনি। বরং পড়তির দিকে রয়েছে। যে কারণে লিজিং কোম্পানিগুলো ওইভাবে লিজ (ঋণ) দিতে পারছে না। এতে স্বাভাবিকভাবেই কোম্পানিগুলোর আর্থিক অবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
অর্ধেকের বেশি লিজিং কোম্পানির ক্যাশ ফ্লো ঋণাত্মক থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, ক্যাশ ফ্লো ঋণাত্মক হয়ে পড়া নগদ অর্থসংকটের ইঙ্গিত করে। ক্যাশ ফ্লো ঋণাত্মক হয়ে পড়ার কারণ লিজিং কোম্পানিগুলো একদিকে আমনত পাচ্ছে না, অন্যদিকে তারা যে লিজ দিয়েছে সেগুলো ঠিক মতো আদায় হচ্ছে না। লিজিং খাতকে এ সংকট থেকে বের করে আনতে সবার আগে ব্যাংক খাত ঠিক করতে হবে। ব্যাংক খাত ঠিক হলে লিজিং কোম্পানিগুলোর আবস্থা আপনা-আপনিই ভালো হবে।
অধিকাংশ অব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান খারাপ অবস্থায় থাকলেও বে-লিজিং, আইপিডিসি ও উত্তরা ফাইন্যান্সের মুনাফার পাশাপাশি সম্পদ মূল্য বেড়েছে এবং ক্যাশ ফ্লো পজেটিভ রয়েছে। এর মধ্যে উত্তরা ফাইন্যান্স জানুয়ারি-জুন সময়ে শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে ৬ টাকা ৫ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৫ টাকা ৮১ পয়সা। চলতি বছরের জুন শেষে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারপ্রতি সম্পদ মূল্য দাঁড়িয়েছে ৬১ টাকা ৫ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৫২ টাকা ৫৫ পয়সা।
আরও পড়ুন >> ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট নেই, দাবি গভর্নরের
বি-লিজিং জানুয়ারি-জুন সময়ে শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে ২৪ পয়সা। আগের বছরেও কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি মুনাফা ২৪ পয়সা ছিল। চলতি বছরের জুন শেষে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারপ্রতি সম্পদ মূল্য দাঁড়িয়েছে ১৯ টাকা ৬৬ পয়সা, যা আগের বছরে ছিল ১৯ টাকা ৪২ পয়সা। আর আইপিডিসি চলতি বছরের জানুয়ারি-জুন সময়ে মুনাফা করেছে ১ টাকা ৩৬ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৭২ পয়সা। চলতি বছরের জুন শেষে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারপ্রতি সম্পদ দাঁড়িয়েছে ১৬ টাকা ৬৪ পয়সা, যা আগের বছর ছিল ১৫ টাকা ৯২ পয়সা।
তালিকাভুক্ত লিজিং কোম্পানিগুলোর আর্থিক চিত্র
প্রতিষ্ঠানের নাম
শেয়ারপ্রতি মুনাফা (টাকায়)
শেয়ারপ্রতি মুনাফা (টাকায়)
শেয়ারপ্রতি পরিচালন নগদ প্রবাহ (টাকায়)
শেয়ারপ্রতি সম্পদ মূল (টাকায়)
জানুয়ারি-জুন ২০১৯
জানুয়ারি-জুন ২০১৮
এপ্রিল-জুন ২০১৯
এপ্রিল-জুন ২০১৮
জানুয়ারি-জুন ২০১৯
জানুয়ারি-জুন ২০১৮
৩০ জুন-২০১৯
৩০ জুন-২০১৮
বে লিজিং
.২৪
.২৪
.০৬
.১৫
১.০৩
২.৫৪
১৯.৬৬
১৯.৪২
বিডি ফাইন্যান্স
.২৩
.০২
.১৮
.০১
-.৫৩
-১.৯৬
১৫.৪৮
১৬.৭৭
বিআইএফসি
-৩.৭৮
-৩.৫৭
-২.০৭
-১.৬৫
-২.০৩
-২.০১
-৮৩.২৩
-৬৯.৯৭
ডিবিএইচ
৪.৩৬
৪.৩৯
১.২৪
১.৩২
৯.৭২
১২.৮৭
৩৯.৬৯
৩৭.৫৯
ফারইষ্ট ফাইন্যান্স
-৩.৪৫
-১.৪৩
-.৫২
-১.৩৯
-১.০৩
১.২১
৩.৭৭
৭.২২
ফাস ফাইন্যান্স
.১৪
.০৫
.০২
-.০১
-৬.৬৪
-৩.১৬
১৩.৬৫
১৩.৫১
ফার্স্ট ফাইন্যান্স
-২.১৬
-১.৯৮
-১.৪৫
-.২৮
-৯.৫৮
৬.১৩
৫.২৩
৭.৩৯
জিএসপি ফাইন্যান্স
.৮৩
.৮৯
.৪৫
.৪৬
১.২০
.৪৫
২১.৮৭
২২.৮৪
আইডিএলসি
২.৭৯
২.৯৫
১.৩১
১.৪৯
৪.১২
৯.৬৬
৩৫.৪৬
৩৬.১৭
ইন্টারন্যাশনাল লিজিং
.১০
.৫২
.০১
.০৮
-.০৩
-৩.৬৬
১৩.৪৬
১৩.৩৬
আইপিডিসি
১.৩৬
.৭২
.৬৯
.৪২
২.৫৬
-২.৪৮
১৬.৬৪
১৫.৯২
ইসলামীক ফাইন্যান্স
.৬৬
.৫৮
.৩০
.২৯
-৬.৮০
৩.৩০
১৩.৭২
১২.৮৬
লংকাবাংলা
.৫২
.৫১
.৪১
.৩৫
-৬.৭৭
১.২৬
১৮.০৭
১৯.১৪
মাইডস ফাইন্যান্স
-.৮৫
.১৪
-১.১৬
-.২৪
.৫৪
.০৩
১০.১৩
১০.৯৮
ন্যাশনাল হাউজিং ফাইন্যান্স
১.২৫
১.০১
.৭২
.৫৭
-১৮.০২
২০.৩৪
১৫.৫০
১৫.১৬
ফনিক্স ফাইন্যান্স
.৬৩
.৭৬
.২৩
.৩৩
.৮০
৩.১৫
২১.২৫
২০.৬২
পিপলস লিজিং
প্রিমিয়ার লিজিং
.০৭
.০৮
-.১০
.০১
-২.৭৭
-১.৬৪
১৯.৩৬
১৫.৭৭
প্রাইম ফাইন্যান্স
.০৬
-১.৭৪
.০১
-১.২৩
-.০৩
-১.৮৭
৮.৮০
৬.৭৯
ইউনিয়ন ক্যাপিটাল
.০৬
.০৪
.০০
-.১৩
-১.৮৯
-৫.৩৩
১৩.৩৯
১৩.৩৪
ইউনাইটেড ফাইন্যান্স
.৭২
.৫৬
.৩৪
.২৫
৩.০৩
-.৬৪
১৬.৪০
১৬.৬৭
উত্তরা ফাইন্যান্স
৬.০৫
৫.৮১
৩.৪৩
৪.০১
৮.১৪
৫.৬২
৬১.০৫
৫৫
এমএএস/এমএআর/এমকেএইচ