কিছুদিন আগেও পানিবন্দি ছিল উত্তরের বেশ কয়েকটি জেলা। ঘরে ঘরে ছিল হাঁটুপানি। খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির অপ্রতুলতা, সেই সঙ্গে গবাদিপশুর নিরাপদ আশ্রয়ের অভাব। সে সময় অনেকেই উঁচু বাঁধের ওপর, আশ্রয়কেন্দ্রে কেউবা খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নেয়। সব মিলিয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল উত্তরাঞ্চলের মানুষের জীবন।
Advertisement
এ সময় প্রায় ২৫ লাখ টাকার ত্রাণ সামগ্রী বিতরণে উত্তরের বন্যাকবলিত জেলাগুলোতে যায় দেশের শীর্ষস্থানীয় নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কম টিম। এ উদ্যোগে সার্বিক সহযোগিতা করে দেশের বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ।
বিভিন্ন জেলায় ত্রাণ বিতরণ শেষে জাগো নিউজ টিম গত ২৮ জুলাই গাইবান্ধা জেলায় পৌঁছে। সেখানেও ত্রাণ বিতরণ করা হয়। গাইবান্ধার পানিবন্দি মানুষ কেমন আছে তার খোঁজ-খবর, প্রতিবেদন এবং ছবি সংগ্রহে আরও প্রত্যন্ত অঞ্চল ফুলছড়ি উপজেলার বাউশি গ্রামে যান জাগো নিউজের নিজস্ব প্রতিবেদক আবু সালেহ সায়াদাত ও নিজস্ব আলোকচিত্রী মাহবুব আলম। হাঁটুপানি পেরিয়ে তারা সেখানে পৌঁছান।
পানিবন্দি, বানভাসি মানুষ কতটা অসহায় অবস্থায় খেয়ে না খেয়ে জীবন পার করছেন, সেসবের ছবি তুলতে থাকেন মাহবুব আলম। অসহায় মানুষের দুর্দশা কাছ থেকে দেখতে আরও সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন। হাঁটুপানি পেরিয়েই বাউশি গ্রামের একটি ঘরের দিকে এগিয়ে যান তিনি। ঠিক এ সময় তার কানে ভেসে আসে এক বৃদ্ধার কান্নার শব্দ। কান্না শুনে কৌতূহলবশত হাঁটুপানি পেরিয়ে তিনি সেই ঘরে প্রবেশ করেন।
Advertisement
ঘরে ঢুকে দেখেন, জরাজীর্ণ সেই ঘরের ভেতর ভাঙাচোরা চৌকিতে বসে আছেন প্রায় ৮০ বছর বয়সী এক বৃদ্ধা। ছেঁড়া কাপড় পরে রুগণ চেহারের এই বৃদ্ধা আলোচকচিত্রী মাহবুব আলমকে দেখে আরও কান্নায় ভেঙে পড়লেন। তিনি শুধুই কাঁদছেন, কিছুই বলতে পারছেন না।
ততক্ষণে আশপাশের দু-একজন নারী সেখানে উপস্থিত হন। তাদের কাছ থেকে জানা গেল, গ্রামে এ বৃদ্ধার আর কেউ থাকে নেই। তিনি কথাও বলতে পারেন না। বন্যার পানিতে গ্রামের সবাই অন্য কোথাও গিয়ে আশ্রয় নিলেও, তার কেউ না থাকায়, পানিবন্দি হয়ে একাই ঘরে পড়ে আছেন। না খেয়েই এখানে দিনতিপাত করেছেন তিনি।
এই বৃদ্ধার দুই মেয়ে থাকলেও তারা অন্য জেলা এবং দূরে বাস করেন। যে যার মতো সংসার নিয়ে ব্যস্ত। ফলে তাকে সাহায্য করা বা তার পাশে থাকার মতো কেউ নেই। এছাড়া বার্ধক্যজনিত কারণে নিজেও ঠিকমতো চলাফেরা করতে পারেন না। এমনকি কথা বলার শক্তিও নেই তার।
এ অবস্থায় বন্যার পানির মধ্যে তাকে না খেয়ে পানিবন্দি থাকতে হয়েছে। অন্য কেউই তার খোঁজ-খবর নেয়নি। এমন অবস্থায় আলোকচিত্রী মাহবুবকে দেখে শুধু কেঁদেই যাচ্ছিলেন বৃদ্ধা। চোখের ইশারায় বোঝাতে চাইছিলেন, এমন অসহায় পরিস্থিতি থেকে মুক্তি চান তিনি। কিছু দানাপানি দিতে চান পেটে।
Advertisement
বৃদ্ধার এমন অসহায়ত্বের দৃশ্য নিয়ে জাগোনিউজ২৪.কম-এ ছবি ও ভিডিও প্রকাশিত হয়, যা অল্প সময়ের মধ্যেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক শেয়ার হতে থাকে। অনেকের টাইমলাইনে জাগো নিউজের এই ছবি ও ভিডিও শেয়ার করে সাহায্য চান। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের পরিচিত মুখ সোলায়মান সুখনসহ অনেকেই তাদের টাইমলাইনে এই ছবি ও ভিডিও শেয়ার করে। আগ্রহ প্রকাশ করেন সাহায্যের।
কেউ কি খাবার তুলে দিল তার মুখে?
প্রতিবেশীরা ওই বৃদ্ধাকে রাবেয়ার মা বলে ডাকে। অনেকের কাছে তিনি ফুলবনী নামেও পরিচিত। জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যানুসারে, তার নাম ফুলমনি বেগম। জন্ম ১৯৩৭ সালে। বর্তমানে এই বৃদ্ধার ঘর থেকে বন্যার পানি নেমে গেছে। দুই মেয়ের মধ্যে এক মেয়ে তাকে দেখেতে এসেছেন।
তাকে বর্তমানে যিনি দেখাশোনা করছেন তার নাম শিউলি খাতুন। শিউলির দূর সম্পর্কের দাদি তিনি। বাড়ির পাশে বাড়ি হওয়ায় এবং শুধু মানবিক কারণেই বৃদ্ধার দেখাশোনা করছেন। বন্যার ভয়বহতার সময় শিউলিও নিজের বাড়িতে ছিলেন না। আশ্রয় নিয়েছিলেন এক আত্মীয়ের বাড়িতে। যে কারণে সে সময় আরও বেশি অসহায়ত্ব নিয়ে পানিবন্দি অবস্থায় না খেয়ে থাকতে হয়েছিল ওই বৃদ্ধাকে।
মঙ্গলবার জাগো নিউজের এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় শিউলি খাতুনের। তিনি বলেন, ওই বৃদ্ধার ঘর থেকে বন্যার পানি নেমে গেছে। অনলাইনে ছবি-ভিডিও দেখে এখন অনেকেই প্রতিদিন তাকে সাহায্যে করতে আসছেন। ৫০০-১০০০ টাকা করে সাহায্য করছেন। বর্তমানে আরও অসুস্থ ফুলমনি বেগম। তার চিকিৎসা প্রয়োজন। কোনো কথা বলতে পারেন না। হাতের ইশারায় খেতে চান। প্রাকৃতিক কাজ সারেন বিছানায়ই।
অনেকেই তাকে সাহায্যে করতে আসছেন। ফলমূলসহ খাবার দিচ্ছেন, খোঁজ-খবর নিচ্ছেন। বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন থেকে লোকজনও আসছেন। একেকজন একেকভাবে সাহায্য করছেন। তবে অনেকেই বলছেন, বিচ্ছিন্নভাবে সাহায্য না করে একটা ব্যাংক একাউন্ট করে সেখানে সাহায্যের টাকা দিলে ভালো হয়। তখন প্রতি মাসে সেখান থেকে টাকা তুলে তার ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা হবে।
তিনি বলেন, ফুলমনি বেগমের দুই মেয়ে আছে। একজনের বিয়ে হয়েছে বগুড়ায়। আরেক মেয়ে দূরে থাকেন, তারাও অসহায় দরিদ্র। এই বৃদ্ধাকে দীর্ঘদিন ধরে একাই থাকতে হয়। আমার বাড়ি পাশে হওয়ায় আমি তাকে মানবিক কারণে যতটুকু সম্ভব দেখাশোনা করতাম। কিন্তু বন্যার সময় আমিও গ্রামে ছিলাম না। তাই বৃদ্ধা ওই বন্যার পানিতে পানিবন্দি অবস্থায় কয়েক দিন না খেয়ে বসবাস করেছিলেন। ওই কয়দিন শুধু কেঁদেছেন। এ সময় একজন ফটোগ্রাফার এসে তার ছবি তুলে নিয়ে যান। এরপর থেকেই বৃদ্ধার খোঁজ নিতে অনেকেই ছুটে আসছেন।
এএস/এমএসএইচ/এমএস