দেশজুড়ে

চামড়া কেনা নিয়ে শঙ্কায় ব্যবসায়ীরা

আসন্ন ঈদুল আজহায় কোরবানিরপশুর চামড়া কেনা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন নওগাঁর চামড়া ব্যবসায়ীরা। তাদের হাতে চামড়া কেনার মতো কোনো টাকা-পয়সা নেই। ট্যানারি মালিকদের কাছে বিগত বছরগুলোর টাকা এখনও বকেয়া পড়ে আছে। এ অবস্থায় অনেকে এ ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে অন্য ব্যবসা শুরু করছেন। এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করেছেন ব্যবসায়ীরা।

Advertisement

একদিকে ব্যবসায়ীদের হাতে টাকা নেই, অপরদিকে বাজারে চামড়ার দাম কম। এ অবস্থায় এ বছর চামড়া নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন জেলার চামড়া ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, গত ৫ বছরে ট্যানারি মালিকদের কাছে প্রায় ৬ কোটি টাকা বকেয়া পড়েছে।

নওগাঁ শহরের গোস্তহাটির মোড় থেকে দক্ষিণে দুবলহাটি রাজবাড়ী যাওয়ার রাস্তায় হাট-নওগাঁ মহল্লা। এক সময় ওই এলাকা ‘চামড়া পট্টি’ নামে পরিচিত ছিল। অনেক দূর পর্যন্ত বাতাসে চামড়ার গন্ধ ভেসে যেত। কিন্তু সময়ে বিবর্তনে সেই ‘চামড়া পট্টি’ এখন পরিবর্তন হয়েছে। নাম ‘চামড়া পট্টি’ হলেও সেখানে এখন মুদি, সাইকেল, সিরামিক, প্লাস্টিক সামগ্রীর দোকান গড়ে উঠেছে। কোরবানির ঈদ ছাড়া অন্য সময় ওই এলাকায় চামড়া খুব একটা দেখা যায় না। হয়তো আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ‘চামড়া পট্টি’ নামটাই বিলীন হয়ে যাবে।

জেলায় ছোট বড় মিলে প্রায় ২০০ জন চামড়া ব্যবসায়ী রয়েছেন। তারা কোরবানির সময় টাকা ধার-দেনা করে চামড়া সংগ্রহ করে ট্যানারি মালিকদের কাছে বিক্রি করেন। কিন্তু দফায় দফায় সময় নিয়েও ট্যানারি মালিকরা বিগত বছর ও তার আগেরও পাওনা টাকা পরিশোধ করেননি। তারা টাকা পরিশোধ না করে বিভিন্ন অজুহাত দেখান। ফলে এ বছর চামড়া কেনা নিয়ে অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা।

Advertisement

কোরবানির ঈদের সময় যে চামড়া কিনতে হবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন ব্যবসায়ীরা। চামড়া কেনার জন্য তাদের আগাম কিছু প্রস্তুতি থাকে। লবন সংগ্রহ, দা ও ছুরি এবং শ্রমিকদের মজুরি দেয়া।

ব্যবসায়ীরা জানান, চামড়া কেনার জন্য তাদের মতো ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ঋণ দেয়া হয় না। ঋণ দেয়া হয় যাদের কোটি কোটি টাকা আছে সেই ট্যানারি মালিকদের। ট্যানারি মালিকরা চামড়া কেনার পর বলেন নষ্ট হয়ে গেছে। ব্যবসায়ীরা যে দামে ট্যানারিতে চামড়া বিক্রি করেন, পরবর্তী সময়ে ট্যানারি মালিকরা বলেন বিদেশে দাম কমে গেছে, এজন্য কম দাম নিতে হবে। ট্যানারি মালিকদের কাছে তারা জিম্মি হয়ে পড়েছেন।

আলাউদ্দিন খান নামে একজন বলেন, ‘দীর্ঘ ৪৭ বছর যাবত চামড়া ব্যবসায় জড়িত। গত ৫ বছর ধরে এ ব্যবসায় দুর্দিন চলছে। ট্যানারি মালিকদের কাছে প্রচুর টাকা বকেয়া আছে। আগামীতে কোরবানির চামড়া কেনার প্রস্তুতি এখন পর্যন্ত নিতে পারিনি। যাদেরকে চামড়া দেয়া হয়েছে ফোন দিলে রিসিভ করেন না। আবার ঢাকায় যেতে যে ২ হাজার টাকা খরচ হয় সেটাও তারা দেন না। শুধু হয়রানি করেন।

সাদেক হোসেন নামে একজন বলেন, বংশগতভাবে চামড়া ব্যবসায় জড়িত। ট্যানারি মালিকদের কাছে প্রায় ২১ লাখ টাকা পাওনা আছে। দু’একজন দেশের বাইরে চলে গেছেন। নতুন করে চামড়া কেনার জন্য হাতে টাকা নেই, দুশ্চিন্তার মধ্যে আছি।

Advertisement

তিনি বলেন, সরকার যেভাবে ধান, চাল সংগ্রহ করেন সেভাবে যদি চামড়া কিনতো, তাহলে ট্যানারি মালিকরা সুযোগ পেতেন না। এতে করে আমরা চামড়ার দামও ভাল পেতাম।

সাবেক চামড়া ব্যবসায়ী সাইদ হোসেন বলেন, বর্তমানে এ ব্যবসার খুবই দুর্দিন যাচ্ছে। ট্যানারির কাছে আমার প্রায় ২৫ লাখ টাকা পাওনা আছি। ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়েছি। চামড়ার ব্যবসা ভাল না যাওয়ায় এখন মুদি দোকান দিয়েছি। আমার মতো অনেকেই এখন জীবন জীবিকার জন্য ব্যবসা পরিবর্তন করেছে।

নওগাঁ শহরের হাট-নওগাঁ মহল্লার ইট ব্যবসায়ী এটিএম আলমগীর হোসেন বলেন, ১৯৭৫-৭৬ সালের দিকে চামড়া ব্যবসা রমরমা ছিল। কোরবানির সময়ে চামড়ার গন্ধে এ রাস্তা দিয়ে হাঁটা যেত না। ১৯৮৫-৮৬ সালের দিকেও ভাল ছিল। ক্রমাগত লোকসান হওয়ায় চামড়া ব্যবসায়ীরা এখন অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে। সরকারের এদিকে নজর দেয়া উচিত।

নওগাঁ জেলা চামড়া ব্যবসায়ী গ্রুপের সভাপতি মোমতাজ হোসেন বলেন, ট্যানারি মালিকদের কাছে গত ৫ বছরে নওগাঁর চামড়া ব্যবসায়ীদের প্রায় ৬ কোটি টাকা পাওনা আছে। আগের টাকা বকেয়া থাকায় এ বছর আমরা এখন পর্যন্ত চামড়া কেনার কোনো প্রস্তুতি নিতে পারিনি। ব্যবসায়ীদের চামড়া কেনার আগ্রহ কমে গেছে। এ বছর ২৫ শতাংশ চামড়া নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভবনা আছে। কারণ বাজারে চামড়ার দাম কম। অথচ ভারতে চামড়ার দাম ভাল।

তিনি বলেন, চামড়া ব্যবসাকে টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারকে ‘ওয়েট ব্লু ব্লু’ চামড়া রফতানির অনুমতি দিতে হবে। এ শিল্পকে টিকিতে রাখতে হলে, সরকারকে মাঠ পর্যায়ে তদন্ত করে একটা নীতিমালা তৈরি করতে হবে। তা না হলে আগামী ৫ বছরের মধ্যে এ শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে।

তিনি অভিযোগ করে বলেন, কয়েকজন ট্যানারি মালিক আছেন, যারা কম দামে চামড়া কিনে বেশি দামে জুতা বিক্রি করেন। চামড়ার দাম ভাল না পাওয়ায় এবং বকেয়া টাকা না দেয়ায় অনেক পুরনো চামড়া ব্যবসায়ী পুঁজি হারিয়ে আজ পথে বসেছেন।

আব্বাস আলী/এমএমজেড/এমকেএইচ