দেশজুড়ে

ওসির নেতৃত্বে থানায় গৃহবধূকে গণধর্ষণ, ওসিই করছেন তদারকি!

খুলনার জিআরপি (রেলওয়ে) থানা পুলিশের ওসি ওসমান গনি পাঠানসহ পাঁচ পুলিশ কর্মকর্তার হাতে গণধর্ষণের শিকার নারীর (২১) ডাক্তারি পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। সোমবার দুপুরে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগে তার ডাক্তারি পরীক্ষা সম্পন্ন হয়।

Advertisement

এদিকে এ ঘটনায় পাকশী জিআরপির পুলিশ সুপার মো. নজরুল ইসলাম তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। আগামী সাতদিনের মধ্যে কমিটিকে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

এর আগে রোববার খুলনার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারকের কাছে থানার ভেতরে আটকে পাঁচ পুলিশের হাতে গণধর্ষণের বর্ণনা দেন ওই নারী। জিআরপি থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ওসমান গনি পাঠানসহ পাঁচ পুলিশ সদস্য থানায় আটকে তাকে ধর্ষণ করেছে বলে বিচারককে জানান ওই নারী।

আরও পড়ুন > বাবার জানাজায় না গিয়ে ভাতিজিকে ধর্ষণ করে মেরে ফেলল চাচা

Advertisement

তার বর্ণনা শুনে আদালতের বিচারক ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য নির্দেশ দেন। আদালতের নির্দেশে রোববার রাতে তাকে ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলেও সময় স্বল্পতার কারণে তা হয়নি। ফলে সোমবার দুপুরে তার ডাক্তারি পরীক্ষা সম্পন্ন করা হয়।

খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. অঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, রোববার রাতে সময় স্বল্পতার কারণে ধর্ষণের শিকার গৃহবধূর ডাক্তারি পরীক্ষা সম্পন্ন করা যায়নি। তাই সোমবার দুপুরে তার ডাক্তারি পরীক্ষা সম্পন্ন করা হয়েছে। এজন্য বেশকিছু আলামত সংগ্রহ করা হয়েছে। ডাক্তারি পরীক্ষার প্রতিবেদন পেতে একটু সময় লাগবে।

খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের ডা. শফিকুজ্জামান বলেন, ধর্ষণের শিকার ওই নারীর ডাক্তারি পরীক্ষা সোমবার দুপুরে সম্পন্ন হয়েছে। প্রতিবেদন পেতে কয়েক দিন সময় লাগবে।

আরও পড়ুন > আদালতে দাঁড়িয়ে ৫ পুলিশের গণধর্ষণের বর্ণনা দিলেন ‘আসামি’

Advertisement

ধর্ষণের শিকার গৃহবধূর বড় বোন বলেন, আমার বোনের শ্বশুরবাড়ি সিলেটে। আমার মা খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি থাকায় দেখতে খুলনায় আসে বোন। বোন নিজে অসুস্থ থাকায় বৃহস্পতিবার যশোরে ডাক্তার দেখাতে গিয়েছিল। শুক্রবার যশোর থেকে আসার সময় ফুলতলা এলাকায় জিআরপি পুলিশ প্রথমে তাকে মোবাইল চুরির অপরাধে থানায় ধরে নিয়ে যায়।

শুক্রবার বিকেলে জিআরপি পুলিশ প্রথমে বলেছে আমার বোন মোবাইল চুরি করে ধরা পড়েছে। পরে জানায় তাকে ছাড়াতে এক লাখ টাকা লাগবে। টাকা না দিলে কি করে আদায় করা যায় তা নাকি পুলিশ জানে। পরে টাকা না দিয়ে থানা থেকে চলে আসি আমরা।

তিনি আরও বলেন, আমরা থানা থেকে বের হয়ে আসার পর ওই দিন রাতে থানা হাজতে আমার বোনকে বিবস্ত্র করে ওড়না দিয়ে হাত-মুখ বেঁধে ফেলা হয়। এরপর প্রথমে ওসি ওসমান গনি পাঠান ও পরে আরও চার পুলিশ আমার বোনকে পালাক্রমে ধর্ষণ করে। এ সময় তাকে মারপিটও করা হয়। পরদিন শনিবার পাঁচ বোতল ফেনসিডিলসহ আমার বোনের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে আদালতে সোপর্দ করে পুলিশ।

রোববার তাকে আবার আদালতে আনা হয়। তখন আদালতে বিচারকের সামনে নেয়ার পর জিআরপি থানায় গণধর্ষণের বর্ণনা দেয় আমার বোন। তখন আদালতের বিচারক তার ডাক্তারি পরীক্ষার নির্দেশ দেন।

আরও পড়ুন > ‘বন্দুকযুদ্ধে’ গণধর্ষণ মামলার প্রধান আসামিসহ নিহত ৩

ধর্ষণের শিকার গৃহবধূর দুলাভাই বলেন, শুক্রবার (২ আগস্ট) আমার শ্যালিকা যশোর থেকে ট্রেনে খুলনায় আসে। ট্রেন থেকে নামার পর সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে খুলনা রেলস্টেশনে কর্তব্যরত জিআরপি পুলিশের সদস্যরা তাকে ধরে থানায় নিয়ে যায়। পরে আমাদের ফোন দিয়ে এক লাখ টাকা নিয়ে থানায় যেতে বলে পুলিশ।

তখন ওসিকে বলেছি, স্যার আমরা গরিব মানুষ, আমাদের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। তখন ওসি বলেন, ঠিক আছে, এখন সাত বছর জেল খাটলে সব ঠিক হয়ে যাবে। ওই দিন রাত ১০টা পর্যন্ত থানায় বসে থেকেও আমার শ্যালিকাকে ছাড়াতে পারিনি আমরা।

থানা থেকে চলে আসার পর ওই দিন গভীর রাতে জিআরপি থানা পুলিশের ওসি ওসমান গনি পাঠান প্রথমে আমার শ্যালিকাকে ধর্ষণ করে। এরপর আরও চার পুলিশ সদস্য পালাক্রমে তাকে ধর্ষণ করে। পরদিন শনিবার পাঁচ বোতল ফেনসিডিলসহ একটি মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে তাকে আদালতে পাঠায়। সেদিন তাকে আদালত থেকে কারাগারে পাঠানো হয়। ওই দিন জেলারকে ধর্ষণের বিষয়টি জানিয়ে আইনজীবীর মাধ্যমে ওই গৃহবধূকে রোববার আদালতে তোলা হয়।

তখন আদালতে বিচারকের সামনে নেয়ার পর জিআরপি থানায় আটকে গণধর্ষণের বিষয়টি আদালতের বিচারকের সামনে তুলে ধরেন গৃহবধূ। এরপর আদালতের বিচারক তার ডাক্তারি পরীক্ষার নির্দেশ দেন।

আরও পড়ুন > প্রেমিকের সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে গণধর্ষণের শিকার কিশোরী

এদিকে ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে ভুক্তভোগীর পরিবারকে ওসি ওসমান গনি মোটা অংকের টাকা দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন। কিন্তু সমঝোতায় রাজি না হওয়ায় হুমকি দিচ্ছে ধর্ষণের ঘটনায় জড়িত পুলিশ সদস্যরা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি ওসমান গনি বলেন, শুনেছি ওই গৃহবধূকে থানায় গণধর্ষণ করা হয়েছে বলে আদালতে অভিযোগ করেছেন। কিন্তু ওই গৃহবধূকে এক নারী এসআই এবং নারী কনস্টেবল পাঁচ বোতল ফেনসিডিলসহ আটক করেছেন। থানায় ওই দিন রাতে তিনজন নারী পুলিশসহ আটজন পুলিশ পাহারায় ছিলেন। সেখানে গৃহবধূকে গণধর্ষণের সুযোগ নেই। মূলত মামলা থেকে রক্ষা পেতে মিথ্যা অভিযোগ করেছেন ওই গৃহবধূ।

জিআরপি থানায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শুক্রবার রাতে ওসি ওসমান গনি, কনস্টেবল মফিজ, কুদ্দুস, আলা উদ্দিন ও কামরুল ডিউটিতে ছিলেন।

সোমবার দুপুরে জিআরপি পুলিশের এসআই মফিজুল বলেন, ওই দিন আমি ঘটনাস্থলে ছিলাম না। তবে ওই গৃহবধূ নাকি আদালতে অভিযোগ করেছেন তাকে গণধর্ষণ করা হয়েছে।

ওসি ওসমান গনি বর্তমানে কোথায় আছেন জানতে চাইলে এসআই মফিজুল বলেন, বর্তমানে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রয়েছেন ওসি। গণধর্ষণের শিকার নারীর তদারকি করছেন তিনি।

এদিকে পাকশী রেলওয়ের পুলিশ সুপার সোমবার ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। তদন্ত কমিটির প্রধান করা হয়েছে জিআরপির সহকারী পুলিশ সুপার ফিরোজ আহমেদকে।

কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- পুলিশ পরিদর্শক (নিরস্ত্র) শ. ম কামাল হোসাইন ও মো. বাহারুল ইসলাম। আগামী সাতদিনের মধ্যেই এ কমিটিকে প্রতিবেদন দেয়ার নিদের্শ দেয়া হয়েছে।

আলমগীর হান্নান/এএম/জেআইএম