বছরের পর বছর চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) দায়িত্বহীন আচরণ আর সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কাণ্ডজ্ঞানহীন কর্মকাণ্ডে চট্টগ্রামের মানুষ যখন অতিষ্ঠ, নগরের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা এ দুটি প্রতিষ্ঠানের যথেচ্ছাচারের শিকার হয়ে বন্দরনগরবাসী যখন জলের তলায় হাবুডুবু খাচ্ছে, তখন সিটি মেয়র আজম নাছির উদ্দিন সেই জলাবদ্ধতার জন্য উল্টো নগরবাসীকেই দায়ী করলেন।
Advertisement
রোববার (৪ আগস্ট) রাতে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে নগরের জলাবদ্ধতা নিয়ে এক অনুষ্ঠানের প্রশ্নোত্তর পর্বে তিনি এমন অভিযোগই করলেন।
‘জলাবদ্ধতার স্থায়ী নিরসনে প্রস্তাবনা নিয়ে নাগরিকের কনভেনশন‘ শিরোনামে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে চট্টগ্রাম নাগরিক ফোরাম।
কনভেনশনের প্রশ্নোত্তর পর্বে দর্শক অ্যাডভোকেট মুহাম্মদ বরকতুল্লাহ খানের প্রশ্ন ছিল- বিভিন্ন সময় চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতার জন্য সিটি কর্পোরেশন সিডিএকে দায়ী করে। আবার কখনও সিডিএ সিটি কর্পোরেশনকে দায়ী করে। এবার এ দূরত্ব ঘুচবে কি-না?
Advertisement
প্রশ্নকারীর প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই মাইক্রোফোন চেয়ে নিয়ে সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন বলেন, ‘আমরা কখনও বলিনি জলাবদ্ধতার জন্য সিডিএ দায়ী, বা সিডিএ বলেনি জলাবদ্ধতার জন্য সিটি কর্পোরেশন দায়ী। দায়ী যদি করতেই হয় নগরবাসীকে দায়ি করতে হবে। সিডিএ বা সিটি কর্পোরেশন খাল দখল করেনি। ‘
তিনি আরও বলেন, ‘এমনও নজির আছে বাড়ির পাশে একটা খাল ছিল, পরে সেটা আঙিনায় ঢুকিয়ে ফেলা হয়েছে। নগরের ৩৬ খালের মধ্যে যে ১৩টি খাল নিয়ে সেনাবাহিনী কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেখানে ১ হাজার ৩৬৫টি অবৈধ স্থাপনা রয়েছে।’
‘শুধু উচ্ছেদের কথা বললেই হবে না। উচ্ছেদের জন্য ম্যাজিস্ট্রেট প্রয়োজন, পুলিশ প্রয়োজন, ফায়ার সার্ভিস, বিদ্যুৎ বিভাগ সবার কাজ রয়েছে। আমি চাইলেই পুলিশ ফোর্স পাওয়া অতটা সহজ না। নগরবাসী যদি এগিয়ে আসে তবেই জলাবদ্ধতা সমস্যার নিরসন সম্ভব। তাদের সচেতন হতে হবে। এখন সময় এসেছে সবার সহযোগিতায় সেসব ঠিক করার। ’
সিটি মেয়র বলেন, ‘২০১৫ সালের ২২ আগস্ট থেকে জন সচেতনতা তৈরিতে ২২ লাখ লিফলেট বিতরণ করা হয়েছে, বিভিন্ন পত্রিকায় টানা ৩৫ দিন সাতবার বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছে। মাইকিং করা হয়েছে দুই বছর। কান থাকতে যারা বধির, চোখ থাকতে যারা কানা তাদের কী বলবেন? শুধু সিঙ্গাপুরের বাসিন্দা হতে চাইলে হবে না, সিঙ্গাপুরের মানুষের মতো মানসিকতা থাকতে হবে ।’
Advertisement
মেয়রের এমন বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সহ-সভাপতি রিয়াজ হায়দার চৌধুরী তার বক্তব্যে মেয়রকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘মেয়র মহোদয় তার নেতৃত্বকে রক্ষার জন্য হয়তো এমন বলছেন। তিনি একটি দলের দায়িত্বে আছেন। তাই তার দলের নেতাকে সেভ করতে চাইছেন হয়তো। কিন্তু এ শহরের মানুষের মধ্যে অনেক প্রশ্ন রয়েছে, যার উত্তর তারা খুঁজে পাচ্ছেন না। এসব নগরবাসীর ভুল হতে পারে না।
আরও পড়ুন>> জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রকল্প আছে, সুফল নেই
তিনি আরও বলেন, এক নেতা মন্ত্রী হওয়ার পরে ডিসি হিলে সামাজিক সাংস্কৃতিক প্রোগ্রাম বন্ধ করে দিতে চান। চট্টগ্রামে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে, কিন্তু সেটার কী অবস্থা? কীভাবেই বা হচ্ছে? সে খবর নেয়ার কেউ নেই।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ বলেন, ‘চট্টগ্রাম নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য আরও তিন বছর প্রয়োজন। প্রকল্প সঠিকভাবে বাস্তবায়নের জন্যই সময় বাড়াতে হবে। এ জন্য আমরা সময়ের আবেদন করব।’
সিডিএ চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ বলেন, ‘দুই বছর আগে প্রকল্প শুরু হলেও এ বছরের জুলাই মাস থেকে মূলত প্রবল্পের মূল কাজ শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৩৪ কন্সট্রাকশন ব্যাটেলিয়ান এ কাজ করছে।’
‘উনারা কাজ করার কারণে এবার নগরের জলাবদ্ধতা কিছুটা সহনীয় ছিল। বিশেষ করে নগরের মুরাপুর অংশে এবার পানি তাড়াতাড়ি নেমে গেছে। ইতোমধ্যে নগরের ৩৬টি খাল থেকে ১৬টি খাল চিহ্নিত করা হয়েছে। এ ছাড়া আরও ২০টি ব্রিজ তারা তৈরি করবেন। এসব কাজ শেষ হলে নগরের জলাবদ্ধতা থাকবে না।’
মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে উচ্ছেদ একটি বড় সমস্যা উল্লেখ করে সিডিএ চেয়ারম্যান বলেন, ‘উচ্ছেদ কত বড় সমস্যা, তা বলে বোঝানো যাবে না। আমার কাছে প্রতিদিন কত সুপারিশ আসে। বিভিন্ন এনজিও-মানবাধিকার সংস্থাগুলো পর্যন্ত সুপারিশ করে। অনেকে বলে আমরা কোথায় যাব। তাদের কোনো বিকল্প জায়গার বন্দোবস্ত করা হবে কি-না, সেটাও জানতে চায়।’
জহিরুল আলম দোভাষ বলেন, ‘আমরা জনগণের টাকা যেনতেনভাবে খরচ করতে চাই না। কেন করব? আমরা চাই টেকসই কাজ। এ প্রকল্পের কাজ শেষ হলে সিটি কর্পোরেশন যদি তাদের রুটিনওয়ার্ক ভালোভাবে করে, আমরা যদি আমাদের কাজগুলো ভালোভাবে করি, তবে অবশ্যই এ প্রকল্পের সুফল আমরা পাব।’
কনভেনশনে আরও বক্তব্য দেন মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থার প্রকল্প পরিচালক লে. কর্নেল মো. শাহ আলী, প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন মজুমদার, প্রকৌশলী এম আলী আশরাফ, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রধান পরিকল্পনাবিদ রেজাউল করিম প্রমুখ।
প্রসঙ্গত, একে অপরের ওপর দোষ চাপানো ও সমন্বয়হীনতার মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প। এরই মধ্যে জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক), চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) এবং পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) পৃথক পৃথকভাবে প্রায় ১০ হাজার ৭৬৭ কোটি টাকার প্রকল্প নিয়ে কাজ করছে। কিন্তু কবে নাগাদ জলাবদ্ধতার তীব্র যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবেন বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের বাসিন্দারা তা বলতে পারছে না কেউই।
আবু আজাদ/জেডএ/পিআর