>> বিদেশিদের শেয়ার বিক্রিতে নেতিবাচক প্রভাব বাজারে>> বিদেশিদের শেয়ার বিক্রির প্রবণতা থামাতে বিএসইসির চাপ>> পাঁচ মাসে ২৮ হাজার কোটি টাকা মূলধন হারিয়েছে ডিএসই>> শেয়ার বিক্রিতে বাধা দিলে নতুন বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে>> পাঁচ মাসে বিদেশিদের ক্রয়ের চেয়ে বিক্রয় ৫১৮ কোটি টাকা বেশি
Advertisement
দেশের পুঁজিবাজারে শেয়ার বিক্রির চাপ অব্যাহত রেখেছেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। সদ্য সমাপ্ত জুলাই মাসে বিদেশিরা পুঁজিবাজার থেকে যে পরিমাণ টাকার শেয়ার কিনেছেন তার চেয়ে বেশি বিক্রি করে দিয়েছেন। এ নিয়ে টানা পাঁচ মাস বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শেয়ার ক্রয় থেকে বিক্রি বেশি করলেন। তবে আগের কয়েক মাসের চেয়ে জুলাইয়ে বিদেশিদের শেয়ার বিক্রির চাপ ছিল তুলনামূলক বেশি।
বিদেশি বিনিয়োগকারীদের শেয়ার ক্রয়-বিক্রয় তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) হালনাগাদ তথ্য পর্যালোচনা করে এ তথ্য পাওয়া গেছে। বাজারের ওপর আস্থা না পাওয়ায় বিদেশিরা এভাবে শেয়ার বিক্রি করছেন বলে অভিমত পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টদের।
বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মাসের পর মাস শেয়ার বিক্রির চাপ অব্যাহত থাকায় সার্বিক বাজারেও মন্দাভাব দেখা দিয়েছে। প্রায় ছয় মাস ধরে মন্দা চলছে পুঁজিবাজারে। এর আগে দেশের পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বিক্রির এমন অব্যাহত চাপ দেখা যায়নি।
Advertisement
বিদেশি বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বিক্রির এ চাপে উদ্বিগ্ন বাজার সংশ্লিষ্টরা। যে কারণে বিদেশিদের শেয়ার বিক্রির প্রবণতা থামাতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) থেকে কয়েকটি ব্রোকারেজ হাউজকে চাপ দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এরপরও বিদেশিদের শেয়ার বিক্রির প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে।
বিদেশি বিনিয়োগকারীদের পোর্টফোলিয় নিয়ে কাজ করে এমন একটি ব্রোকারেজ হাউজের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘সম্প্রতি বিদেশিদের শেয়ার বিক্রির চাপ বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে বিএসইসি থেকে আমাদের ডাকা হয়েছিল। সেই সঙ্গে শেয়ার বিক্রির চাপ বন্ধ করার জন্য নির্দেশও দেয়া হয়েছে। কিন্তু গ্রাহক যদি শেয়ার বিক্রি করে আমরা বন্ধ করব কীভাবে?’
তিনি বলেন, ‘একজন বিনিয়োগকারী কখন শেয়ার কিনবেন, আর কখন বিক্রি করবেন-সেটা তার নিজস্ব ব্যাপার। আমরা তো শেয়ার ক্রয় অথবা বিক্রির জন্য কোনো বিনিয়োগকারীকে চাপ দিতে পারি না। তবে এটা সত্য বিদেশিরা শেয়ার বিক্রি করলে সার্বিক বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।’
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, চলতি বছরের জুলাই মাসজুড়ে বিদেশিরা শেয়ারবাজার থেকে ৩০৯ কোটি ৩৬ লাখ ৩৭ হাজার ৮৩৯ টাকার শেয়ার ক্রয় করেছেন। এর বিপরীতে বিক্রি করেছেন ৪৭৪ কোটি ৩ লাখ ৪৬ হাজার ১৮ টাকার। অর্থাৎ মাসটিতে বিদেশিরা শেয়ার ক্রয়ের চেয়ে বেশি বিক্রি করেছেন ১৬৪ কোটি ৬৭ লাখ ৮ হাজার ১৭৯ টাকা।
Advertisement
জুলাই মাসের মতো আগের চার মাসেও বিদেশিদের শেয়ার বিক্রির চাপ ছিল। এর মধ্যে জুনে বিদেশিরা যে পরিমাণ টাকার শেয়ার কিনে বিক্রি করে তার থেকে ১০ কোটি ৫২ লাখ ১ হাজার ২৬৬ টাকা বেশি। মাসটিতে বিদেশিরা ২৯৪ কোটি ৯৪ লাখ ৪৯ হাজার ৬৫৪ টাকার শেয়ার ক্রয়ের বিপরীতে বিক্রি করে ৩০৫ কোটি ৪৬ লাখ ৫০ হাজার ৯২০ টাকা।
একইভাবে মে মাসে বিদেশিরা শেয়ার ক্রয় থেকে বিক্রি বেশি করে ৬৫ কোটি ১৬ লাখ ৬৫ হাজার ৬০২ টাকা। তার আগের মাস এপ্রিলে ১৫৪ কোটি ১৮ লাখ ৮৩ হাজার ৫১৯ টাকা। আর মার্চে ক্রয় থেকে বিক্রি বেশি ছিল ১২৩ কোটি ৭০ লাখ ৮৮ হাজার ৯৩০ টাকা। অর্থাৎ মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত বিদেশিরা যে পরিমাণ টাকার শেয়ার ক্রয় করেছেন বিক্রি করেছেন তার থেকে ৫১৮ কোটি ২৫ লাখ ৪৭ হাজার টাকা বেশি।
বিদেশিদের এমন অব্যাহত শেয়ার বিক্রির চাপের কারণে সার্বিক শেয়ারবাজারেও মন্দাভাব দেখা দিয়েছে। প্রায় ছয় মাস ধরে মন্দা থাকায় পুঁজি হারিয়েছেন লাখ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী। ভয়াবহ দরপতনের কারণে এ সময়ের মধ্যে রাজধানীর মতিঝিলের রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। একই সঙ্গে প্রতীকী গণঅনশনও করেন তারা। প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপিও দিয়েছেন দিশেহারা বিনিয়োগকারীরা।
বিদেশিদের অব্যাহত শেয়ার বিক্রির চাপের প্রভাবে গত পাঁচ মাসে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান মূল্য সূচক ডিএসইএক্স কমেছে ৫৩৯ পয়েন্ট। ফেব্রুয়ারি মাস শেষে ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচক ছিল ৫ হাজার ৭১১ পয়েন্টে, যা ৪ আগস্ট লেনদেন শেষে দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ১৭২ পয়েন্টে।
সূচকের বড় ধরনের পতনের কারণে মোটা অঙ্কের বাজার মূলধন হারিয়েছে ডিএসই। ফেব্রুয়ারি মাস শেষে ডিএসইর বাজার মূলধন ছিল ৪ লাখ ১৫ হাজার ৭৩ কোটি টাকা, যা রোববার (৪ আগস্ট) লেনদেন শেষে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৮৬ হাজার ৬৩৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ পাঁচ মাসে ডিএসই ২৮ হাজার ৪৩৯ কোটি টাকা মূলধন হারিয়েছে। এ হিসাবে গত পাঁচ মাসে ডিএসইতে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ার ও ইউনিটের দাম কমেছে ২৮ হাজার কোটি টাকার উপরে।
বিদেশিদের শেয়ার বিক্রির বিষয়ে ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) সভাপতি শাকিল রিজভী জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করবে আবার কিনবে-এটাই নিয়ম। তবে বিদেশিরা ধারাবাহিকভাবে শেয়ার বিক্রি করতে থাকলে বাজারে এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। গত কয়েক মাসে আমরা বাজারে তারই প্রতিফলন দেখেছি।’
তিনি বলেন, ‘আমার ধারণা বিদেশিরা এখন শেয়ার বিক্রি করছেন, তারা সামনে আবার শেয়ার কিনবেন। এটা নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। তবে বিদেশিদের শেয়ার বিক্রির ক্ষেত্রে বাধা দেয়া ঠিক না। কারণ শেয়ার বিক্রিতে বাধা দিলে নতুন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা নিরুৎসাহিত হবেন।’
এদিকে গত পাঁচ মাস বিদেশিরা অব্যাহতভাবে শেয়ার বিক্রি করলেও চলতি বছরের প্রথম দুই মাসের চিত্র ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি পর পর দুই মাস শেয়ার বিক্রির চেয়ে ক্রয়ে বেশি মনোযোগী ছিলেন বিদেশিরা। এর মধ্যে জানুয়ারিতে বিদেশিদের শেয়ার বিক্রির চেয়ে ক্রয় বেশি হয় ১৭৫ কোটি ২৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা। আর ফেব্রুয়ারিতে শেয়ার বিক্রির চেয়ে ক্রয় বেশি ছিল ৩২৩ কোটি ১৮ লাখ ৬৭ হাজার টাকা।
বিদেশিদের এমন টানা শেয়ার ক্রয়ের কারণে ওই দুই মাসে শেয়ারবাজারে বড় ধরনের উত্থান ঘটে। ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচক ডিএসইএক্স বাড়ে ৩২৬ পয়েন্ট। আর বাজার মূলধন বাড়ে ২৭ হাজার ৭৭৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ মাত্র দুই মাসে ডিএসইতে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ার ও ইউনিটের সম্মিলিত দাম বাড়ে প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা।
এমএএস/এনডিএস/জেআইএম