খেলাধুলা

লঙ্কান বোর্ডের অনুরোধেই ‘ঢেঁকি গিলেছিল’ বিসিবি!

শ্রীলঙ্কা সফরের প্রয়োজনীয়তা, যৌক্তিকতা আর যথার্থতায় পক্ষের চেয়ে বিপক্ষেই যুক্তি বেশি। সফরের আগে থেকে অনেকেই আপত্তি তুলেছিলেন। ঠিক বিশ্বকাপের পর এ সিরিজ খেলতে যাবার দরকার কি থাকতে পারে? তারচেয়ে ক্রিকেটারদের ছুটি দিলে ভাল হবে বেশি। বেশ কিছু দিন বিশ্রাম পেলে সবাই চাঙ্গা ও ফুরফুরে হয়ে ওঠার সুযোগ পাবে।

Advertisement

বেশিরভাগ ক্রিকেট অনুরাগি, ভক্ত-সমর্থক ও বিশেষজ্ঞ- এমন মত দিলেও ক্রিকেট বোর্ডের ভেতরের মত কি? শ্রীলঙ্কায় খেলতে যাওয়া নিয়ে বোর্ড কর্তাদের ভাবনাই বা কি? কি ভেবে এবং কোন চিন্তায় অনেক নেতিবাচক পরিস্থিতির মধ্যেও জাতীয় দলকে শ্রীলঙ্কা সফরে পাঠানো হলো?

তা জানতেও অনেকেই উন্মুখ হয়ে আছেন। বোর্ডের শীর্ষ কর্তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, আসলে বিশ্বকাপের পর শ্রীলঙ্কা সফরে যাওয়া খানিক দ্বিধা-বিভক্তি আছে বোর্ডেও।

তবে একটা বিষয়ে প্রায় সবাই একমত। তাহলো, লঙ্কান ক্রিকেট বোর্ডের (এসএলসি) অনুরোধেই আসলে বিশ্বকাপের ক্লান্তি-অবসাদ আর সাকিব, লিটন ও সাইফউদ্দীনকে ছাড়াও দল পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে চূড়ান্ত। শেষ পর্যন্ত ইনজুরির কারণে সফরে যেতে পারেননি অধিনায়ক মাশরাফিও।

Advertisement

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন বোর্ড পরিচালক শ্রীলঙ্কা সফর সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে মন্তব্য করেছেন, এটা আসলে ছিল ‘অনুরোধে ঢেঁকি গেলার’ মত। আসলে প্রাণঘাতি হামলার পর শ্রীলঙ্কায় কোন বিদেশী দল খেলতে যেতে খানিক ভয়ে ছিল। দ্বিধা-সংশয় তৈরি হয়েছিল যে, শ্রীলঙ্কার মাটিতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ খেলতে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ।

মোটকথা, শ্রীলঙ্কায় নিরাপত্তা নিয়ে তটস্থ ছিল টেস্ট খেলুড়ে দলগুলো। এমন অবস্থায় লঙ্কান বোর্ড চাচ্ছিলো, একটা বিদেশি দলকে আমন্ত্রণ জানিয়ে তাদের দেশে খেলতে নিয়ে যেতে। তাতে করে তারা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট অঙ্গনে বড় মুখ করে বলতে পারবে, ‘শ্রীলঙ্কা এখন পুরোপুরি নিরাপদ। এখানে খেলতে আসায় কোনই ঝুঁকি নেই। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ আয়োজন নিয়েও কোন শঙ্কা কিংবা চিন্তার কারণ নেই।’

বলার অপেক্ষা রাখে না, সেই বিষয়টা প্রমাণের উদ্দেশ্যেই আসলে বিসিবিকে জাতীয় দল পাঠানোর অনুরোধ করেছিল লঙ্কান ক্রিকেট বোর্ড। বিসিবি পরিচালক এবং জাতীয় দল পরিচালনা, পরিচর্য্যা-তত্বাবধায়ক কমিটি, ক্রিকেট অপারেশন্সের চেয়ারম্যান আকরাম খানসহ কয়েকজন শীর্ষ পরিচালকের সাথে কথা বলে বেরিয়ে এসেছে এসব তথ্য। জাগো নিউজের সাথে আলাপে আকরাম খান জানিয়েছেন, ‘আসলে আমরা লঙ্কান ক্রিকেট বোর্ডের অনুরোধেই দল পাঠিয়েছি।’

আকরাম খান শ্রীলঙ্কায় দল পাঠানোর কারণ উল্লেখ করে বলেন, ‘এর আগে একটা সময় আমাদের দেশেও রাজনৈতিক অস্থিরতায় উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল। তখন অস্ট্রেলিয়া ট্যুর বাতিল করেছিল। ইংল্যান্ডও নানা টালবাহানা করে তারপর খেলতে এসেছিল। সেই সময় শ্রীলঙ্কা আমাদের পাশে ছিল। আমাদের আমন্ত্রনে সাড়া দিয়ে ঠিকই দল পাঠিয়েছিল লঙ্কান ক্রিকেট বোর্ড। আমাদের দেশে অস্থির অবস্থায় লঙ্কান জাতীয় দলের খেলতে আসার বিষয়টি আমাদেরকে খানিক কৃতজ্ঞতার বন্ধনে আবদ্ধ করে রেখেছিল। বলতে পারেন, সে কারণেই এবার আমরাও তাদের ওই আহ্বানে না বলে পারিনি। আসলে অতীতে লঙ্কান ক্রিকেট বোর্ডের সাহায্য সহযোগিতা এবং আমাদের পাশে থাকার বিষয়টিই এবার গুরুত্ব পেয়েছে। আমরাও বিশ্বকাপের পর তাদের আহ্বানে সাড়া না দিয়ে পারিনি।’

Advertisement

আকরাম আরও যোগ করেন, লঙ্কান ক্রিকেট বোর্ড সব সময়ই বিসিবির পরীক্ষিত মিত্র ও বন্ধু। অতীতে তারা আমাদের পাশে থেকেছে। আছেও। তাই তাদের আবেদন অগ্রাহ্য করা সম্ভব হয়নি। আমরা খানিক বৈরি পরিস্থিতিতেও দল পাঠাানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তাই জাতীয় দল শ্রীলঙ্কা সফরে গিয়েছে।’

আকরাম শেষ করেন এভাবে, ‘আসলে রেজাল্ট ভাল হলে আর দল পাঠানো নিয়ে হয়ত এত কথা হতো না। পারফরমেন্স বেশি অনুজ্জ্বল। ছেলেরা একদমই ভাল ক্রিকেট খেলতে পারেনি। আর সেই না পারায় দল পাঠানোর যৌক্তিকতা ও যথার্থতা হয়েছে প্রশ্নবিদ্ধ। দল ভাল খেলে সিরিজ জিতে আসলে এসব কোন কথাই উঠতো না। পারফরমেন্সটা আসলে বেশি খারাপ হয়েছে। মাঠের পারফরমেন্স যতটা খারাপ হয়েছে, আমাদের দল কিন্তু এত খারাপ না।’

জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক ও বর্তমান বোর্ড পরিচালক আকরাম খান যে জায়গায় শেষ করেছেন, ঠিক সেখানেই শুরু করেছেন আরেক পরিচালক জালাল ইউনুস। শ্রীলঙ্কায় দল পাঠানো নিয়ে জাগো নিউজের মুখোমুখি হয়ে জালাল বলেন, ‘হ্যাঁ, লঙ্কান বোর্ডের অনুরোধ তো ছিলই। তার পাশাপাশি আরও একটি কারণও ছিল।’

কি সেই কারণ? জালাল ইউনুস বলেন, ‘তাহলো, বিশ্বকাপে আমাদের শেষটা ভাল হয়নি। শুরুর সাথে শেষটার মিল ছিল না তেমন। এক সময় মনে হচ্ছিল আমরা সেরা চারে থাকবো। তারপর সে সম্ভাবনা উবে গিলেও পাঁচ নম্বরে থাকার বড় সুযোগ ছিল। পাকিস্তানের কাছে হারের পর সে সম্ভাবনাও নিঃশ্বেষ হয়ে যায়। আমরা হই আট নম্বর।’

শ্রীলঙ্কা সফর দিয়েই বিশ্বকাপের ক্ষত সারাতে চেয়েছিল বিসিবি। সেটাই জানালেন জালাল ইউনুস। তিনি বলেন, ‘বোর্ডে একটা চিন্তা এসে ভর করেছিল, শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে আসতে পারলে সেই না পারার বেদনায় খানিকটা প্রলেপ দেয়া যাবে। ক্রিকেট বিশ্বও জানবে, ভারত ও পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশ বিশ্বকাপের শেষ দুটি ম্যাচ ভাল খেলতে না পারলেও বিশ্বকাপের পর শ্রীলঙ্কার মাটিতে গিয়ে লঙ্কানদের হারিয়েছে। তার মানে তারা দল হিসেবে উন্নতি করেছে। অবস্থান আট হলেও আসলে বাংলাদেশ তারচেয়ে ওপরে থাকার দল। বৃষ্টিতে ধুয়ে-মুছে না গেলে হয়ত, ব্রিস্টলে শ্রীলঙ্কাকে হারাতো এবং কে জানে সেমিফাইনালও খেলতো।’

বিসিবির অন্যতম শীর্ষকর্তা জালাল ইউনুস বোঝানোর চেষ্টা করলেন, আসলে শ্রীলঙ্কা সফরটি ছিল ইমেজ উজ্জ্বলের মিশন। শ্রীলঙ্কার মাটিতে লঙ্কানদের হারাতে পারলে মুখ রক্ষা হবে। বিশ্বকাপের অপূর্ণতা ও অতৃপ্তি ঘুচবে; কিন্তু হায়! হয়েছে তার উল্টো।

কথায় বলে না, মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক। শ্রীলঙ্কা সফরে ঘটলো ঠিক তাই।

এআরবি/আইএইচএস/এমএস