এম এ হানিফবিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমার এক শিক্ষক বলেছিলেন- এক সময় জ্বর হয়েই গোটা দুনিয়ার অসংখ্য মানুষ মারা যাবে। জ্বর হয়ে উঠবে মানব জাতির একটা প্রধান উদ্বেগের বিষয়। আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ হবার এখনও পাঁচ বছর হয়নি। অথচ এ-র মধ্যেই স্যারের সে কথাটির বাস্তব রুপ দেখতে পাচ্ছি।
Advertisement
সম্প্রতি একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রতি বছর প্রায় ৩৯ কোটি মানুষ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়। আরেকটি গবেষণায় বলা হয়েছে, ১২৮টি দেশের ৩৯০ কোটি মানুষ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। এই দু'টো পরিসংখ্যান থেকেই স্যারের কথাটির সত্যতা পাওয়া যায়।
এছাড়াও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে, ডেঙ্গু জ্বরে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশ আমেরিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল। ২০১৬ সালে এসব অঞ্চলে আক্রান্ত হয়েছিল প্রায় ৩০ লাখের বেশি মানুষ। ২০১৫ সালে কেবল আমেরিকাতেই আক্রান্ত হয়েছিল ২০ লাখের বেশি। আমেরিকার এত উন্নত চিকিৎসা সেবার পরেও মারা গেছে প্রায় হাজারের ও বেশি মানুষ।
এ বছর, ফিলিপাইনে এ মাসে জাতীয় ভাবে ডেঙ্গু এলার্ট ঘোষণা করা হয়েছে। ইতোমধ্যে সাড়ে চার'শর বেশি মানুষ মারা গেছে, আক্রান্ত হয়েছে প্রায় ১ লাখ। হন্ডুরাসে গেল ৫০ বছরের তুলনায় এবছর বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। চলতি বছর ২৮ হাজারের বেশি ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেছে, এর মধ্যে মারা গেছে ৫৪ জন। সিঙ্গাপুরে এখন পর্যন্ত ৯ জনের মারা যাবার খবর পাওয়া গেছে। আক্রান্ত হয়েছে প্রায় ৮ হাজারের অধিক।
Advertisement
এবার বাংলাদেশের কথায় আসি। ২০০০ সালে এদেশে প্রথম ডেঙ্গু রোগ সনাক্ত হয় এবং এ প্রর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিন লাখের বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। সরকারি সংকলন অনুযায়ী শুধু গত বছরে প্রায় ১০,১৪৮ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। আর এ বছর, ইতোমধ্যে আক্রান্ত লোকের সংখ্যা ১২ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। সরকারি হিসাবে মারা গেছে ১৪ জন। যদিও গণমাধ্যমে সংখ্যাটি আরও বেশি বলা হচ্ছে।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ডেঙ্গু জ্বর ৯৯২ খ্রিস্টাব্দে প্রথম সনাক্ত হয় বর্তমান বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীনে। তবে রোগটিকে ডেঙ্গু জ্বর বলে নামকরণ করা হয় ১৭৭৯ সালে। তখন একে 'হাড়ভাঙ্গা জ্বর'ও বলা হত। ধারণা করা হয় আফ্রিকার সোয়াহিলি ভাষার প্রবাদ ''কা-ডিঙ্গা পেপো' থেকে 'ডেঙ্গু' নামটি এসেছে। যার অর্থ 'শয়তানের শক্তির কাছে আটকে যাওয়ার মতো ব্যথা'। সোয়াহিলি ভাষার 'ডিঙ্গা' শব্দটি স্প্যানিশ শব্দ 'ডেঙ্গু' থেকে আসতে পারে, যার মানে হলো 'সতর্ক থাকা'।
বর্তমানে প্রায় ১০০টি দেশে ডেঙ্গু জ্বর হতে দেখা গেছে অথচ ১৯৭০ সালের আগে মাত্র ৯টি দেশে ডেঙ্গু জ্বরের প্রাদুর্ভাব ছিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ১৯৫০ সালের দিকে ফিলিপিন্স এবং থাইল্যান্ডে ডেঙ্গু জ্বর প্রথম মহামারি আকার ধারণ করে এবং বিংশ শতকের শেষ ২৫ বছরে এই রোগটির ব্যাপকভাবে বিস্তার ঘটে। তারা একে 'সবচেয়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়া রোগ' বলে বর্ণনা করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অফ মেডিসিন বলছে, আঠারো এবং ঊনিশ শতকের দিকে বিশ্বব্যাপী যখন জাহাজ শিল্পের বিকাশ ঘটতে থাকে, বন্দর নগরীগুলো গড়ে উঠতে শুরু করে এবং শহর এলাকা তৈরি হয়, তখন এই ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী ভেক্টর এবং এডিস ইজিপ্টির জন্য আদর্শ পরিবেশ তৈরি হয়।
Advertisement
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ডেঙ্গু রোগটি হয় এডিস স্ত্রী জাতীয় মশার কামড়ে। ডেঙ্গু আক্রান্ত বাহক অন্য জায়গায় ভ্রমণ করার মাধ্যমে রোগটি ছড়িয়ে পড়েছে অর্থাৎ একজন আক্রান্ত ব্যক্তি যখন অন্যত্র ভ্রমণ করেন, সেখানে তাকে এডিস মশা কামড়ালে সেই মশার ভেতরেও ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণু ছড়িয়ে পড়ে। সেসব মশা যাদের কামড়াবে, তাদের শরীরে ডেঙ্গু রোগ ছড়িয়ে পড়তে পারে। এই জাতীয় মশা জমে থাকা পরিষ্কার বা স্বচ্ছ পানিতে জন্ম নেয় এবং দিনে কামড়ায়।
বাংলাদেশে ঢাকাতে এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি হলেও এবছর সারা দেশের সকল জেলায় ইতোমধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। সাধারণ লোকজন তাই এটা নিয়ে আতংকিত। তাদের আতংকিত হবার যতেষ্ট কারণও রয়েছে। কিন্তু ডেঙ্গু নিয়ে কি আমাদের আসলেই আতংকের কিছু আছে? না, আতংকের কিছু নেই। তবে উদ্বেগ আছে।
সামনে কোরবানীর ইদ। ইদে ঢাকার লোকজন নিজ নিজ গ্রামের বাড়িতে যাবে। যাদের ডেঙ্গু জ্বর হয়নি কিন্তু শরীরে ইনফেকশন ঢুকে আছে, তাদের মাধ্যমে এসময় ডেঙ্গু ভাইরাস দেশের অন্য অঞ্চলে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই কারও যদি জ্বর থাকে তাহলে তিনি যেন ভ্রমণ না করেন। জ্বর থাকলে যেন পরীক্ষা করে নিশ্চিত হন যে এটা ডেঙ্গু কি-না। নইলে সারাদেশে ডেঙ্গু মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে।
আরেকটি উদ্বেগের বিষয় হল এবার ফেব্রুয়ারিতে বৃষ্টি হয়েছে। এডিস মশার ডিম ছয়মাস পর্যন্ত শুকনো স্থানে থাকলে বেঁচে থাকতে পারে। এবার আগে বৃষ্টির কারণে ও এখন থেমে থেমে বৃষ্টির কারণে এডিস মশা বংশ বিস্তার করেছে বেশি। জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাস ডেঙ্গু রোগের মৌসুম বলা হলেও, এ বছর আগে-ভাগে রোগের প্রকোপ দেখা দিয়েছে। ফলে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আগের তুলনায় বেড়েছে এবং সামনে উদ্বেগ জনক হারে বাড়বে।
২০০০ সালের দিকে যখন বাংলাদেশে ডেঙ্গু রোগটি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে, তখন এডিস মশা সার্ভেইল্যান্স নামের একটি প্রজেক্ট নেয়া হয়েছিল। সেই প্রজেক্ট একবছর চলে। এরপরে সিটি কর্পোরেশনে কিছুটা এডিস মশা নিয়ন্ত্রিত হয়েছিল। তখন ১৪ জনের একটি টিম ছিল, যারা প্রতিদিন বিভিন্ন ওয়ার্ডে মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পরীক্ষা করতো যে, এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব কোন জায়গায় কেমন আছে এবং সেগুলো গবেষণাগারে নিয়ে এসে পরীক্ষা করে দেখতো। সে অনুযায়ী সিটি কর্পোরেশনকে একটি তথ্য দেয়া হতো। সেই তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে কর্পোরেশন তাদের কার্যক্রম চালাতো। কিন্তু এক বছর পরেই সেই প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে যায়।
বর্তমানে, ঢাকায় এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য আসলে কোন কার্যক্রমই নেই, যে কারণে এই অবস্থার তৈরি হয়েছে। ঢাকা শহরে মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য যে কার্যক্রম নেয়া হয়, সেটা শুধুমাত্র কীটনাশক দিয়ে মশা দমন, যার মাধ্যমে আসলে কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ড্রেন, ডোবা, নালা বা রাস্তার আশেপাশে যে কীটনাশক স্প্রে করা হয়, সেটা হচ্ছে কিউলেক্স মশার আবাসস্থল। আমাদের এটা মনে রাখতে হবে যে, কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি আর এডিস মশা দমনের পদ্ধতি এক নয়, এ দুইটা আলাদা ধরনের এডিস মশার আবাসস্থল হচ্ছে মানুষের বাড়ি, বাড়ির চারপাশে বিভিন্ন পাত্রে জমে থাকা পানি।
এ মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত কর্মী দরকার এবং বিশেষ বিশেষ জায়গায় এ মশা নিয়ন্ত্রণ করা দরকার, সেটা সিটি কর্পোরেশনগুলো আসলে করেনি। এ বিষয়ে সিটি কর্পোরেশনের আসলে কোন প্রশিক্ষিত দলই নেই, যারা এডিস মশার লার্ভা বা পূর্ণাঙ্গ এডিস মশা চিনতে পারেন বা কোথায় এগুলো জন্মায়, সেটা চিনতে পারেন। '' আশার কথা হল সিটি কর্পোরেশন এবার নড়ে চড়ে বসেছে। মশা মারার জন্য ইতোমধ্যে ঢাকার দুই মেয়র নানা কর্মসূচি পরিচালনা করেছে। বিদ্যমান ওষুধে এডিস মশা না মড়ায় বিদেশ থেকে ওষুধ আনার ঘোষণা দিয়েছে। দেখার বিষয় কবে নাগাদ এই ওষুধ আসে আর দেশবাসীর মনে স্বস্তি ফিরে আসে।
তবে আমাদের এটা ভুলে গেলে চলবে না যে মশার বাসস্থান ধ্বংস করা শুধু সরকার বা সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্ব। আমাদের সকলকেই এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে। যেহেতু এডিস মশা জমে থাকা পানিতে জন্মায় সেহেতু নিজ নিজ বাড়ির আশ পাশ নিজেদেরকেই পরিষ্কার রাখতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে কোথাও যেন পানি জমে না থাকে।
এডিস মশার বংশ নিয়ন্ত্রণে কলকাতা সফলতা দেখিয়েছে। তারা সারা বছর ধরে নিবিড় নজরদারি চালায়। শুধু ডেঙ্গুর মৌসুমে নয়, সারা বছর ধরে প্রতি ওয়ার্ডে তদারকি করে। প্রতি ওয়ার্ডে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য স্পেশাল টিম রয়েছে তাদের। দীর্ঘমেয়াদে আমরা কলকাতার মতো পদ্ধতি অনুসরণ করতে পারি। কেননা শুধু কীটনাশক দিয়ে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন। পরিবেশ ব্যবস্থাপনা ও সামাজিক সচেতনতা ছাড়া এটা নিয়ন্ত্রণ করা সহজ নয়। কলকাতায় এক ধরনের জরিমানা করার ব্যবস্থা রয়েছে, সেটা আমাদের দেশে চালু করা যেতে পারে। শুধু কলকাতায় নয়, সিঙ্গাপুরেও এরকম জরিমানা করার বিধান রয়েছে।
তাই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের পাশাপাশি সবাইকে এক হয়ে নিজ নিজ জায়গা থেকে ভূমিকা রাখতে হবে। শুধু সরকারের উপর দায় চাপিয়ে ঘরে বসে থাকলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।
লেখক : অফিসার, বাংলাদেশ ব্যাংক।mhanifcu@gmail.com
এইচআর/জেআইএম