দেশের বিভিন্ন স্থানের মতো সিলেটেও ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গু। প্রতিদিনই বাড়ছে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা। বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত সিলেট বিভাগের চার জেলায় ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ১০৪ জনে দাঁড়িয়েছে।
Advertisement
তবে সিলেটের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ৭৩ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন আছেন। বাকি ৩২ জন বিভিন্ন সময়ে চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরেছেন।
বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় সিলেটের চার জেলার স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা এ তথ্য জানিয়েছেন। এর মধ্যে সিলেট জেলায় ৬১ জন, মৌলভীবাজারে ২৫ জন, হবিগঞ্জে ১২ জন ও সুনামগঞ্জে ছয়জন ডেঙ্গু রোগী রয়েছেন।
সিলেটে এখনো ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে কেউ মারা যাননি। তবে ওসমানীতে ভর্তিকৃতদের মধ্যে ঢাকা বিশ্বদ্যিালয় ছাত্রী নাজনীন আহমদ নাহিনের অবস্থা গুরুতর বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
Advertisement
এদিকে, ডেঙ্গুর ভয়াবহতা রোধে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসাপতালে পুরুষ রোগীদের জন্য ডেঙ্গু কর্নার খোলা হলেও নারী রোগীরা রয়েছেন সাধারণ ওয়ার্ডে। ফলে ওই ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন শতাধিক রোগী ও তাদের স্বজনরা রয়েছেন মারাত্মক ঝুঁকিতে।
চিকিৎসকরা জানান, হাসপাতালগুলোতে প্রতিদিন ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়লেও এখন পর্যন্ত সিলেটে থেকে আক্রান্ত হয়েছেন এমন কাউকে পাওয়া যায়নি।
সিলেটের সিভিল সার্জন ডা. হিমাংশু লাল রায় বলেন, প্রতিদিন হাসপাতালগুলোতে নতুন রোগী ভর্তি হচ্ছেন। তবে কেউই সিলেট থেকে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়নি। তারা বাইরে থেকে ডেঙ্গু নিয়ে এসেছেন। আক্রান্তদের অবস্থা ভালো। অনেকে সুস্থ হয়ে বাড়িতে যাচ্ছেন।
সিলেট জেলা সিভিল সার্জন অফিসের দেয়া তথ্য থেকে জানা যায়, বুধবার রাত পর্যন্ত সিলেটে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল মিলে সর্বমোট ৬১ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে সিলেট ওসমানী হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যা ৩৮ জন। মঙ্গলবার সন্ধ্যা থেকে বুধবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় নতুন ১৩ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন।
Advertisement
এছাড়া জালালাবাদ রাগিব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজে ১১ জন, ইবনে সিনা হাসপাতালে পাঁচজন, নর্থইস্ট মেডিকেলে তিনজন, উইমেন্স মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনজন, পার্কভিউ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একজন ও মাউন্ট এডোরা হাসপাতালে একজন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন।
মৌলভীবাজার সিভিল সার্জনের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, মৌলভীবাজারে বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ২৫ জন। এদের মধ্যে মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালে আটজন চিকিৎসা নিচ্ছেন। পাঁচজন মৌলভীবাজার পলি ক্লিনিকে, একজন লাইফ লাইন হাসপাতালে এবং বাকি সাতজন চিকিৎসকের পরামর্শে নিজ বাড়িতে আছেন। এছাড়া চারজনকে সিলেটে পাঠানো হয়েছে। তাদের কারও অবস্থা গুরুতর নয়।
মৌলভীবাজারের সিভিল সার্জন ডা. শাহজাহান কবির চৌধুরী বলেন, ডেঙ্গু আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য সদর হাসপাতালের চারতলায় পৃথক কর্নার চালু করা হয়েছে। ডেঙ্গু আক্রান্তদের চিকিৎসায় একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। কিছু ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী সুস্থ হয়েছেন।
সুনামগঞ্জে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ছয়জন। সুনামগঞ্জ সদর ২৫০ শয্যা হাসপাতালের আবাসকি চিকিৎসক ডা. রফিকুল ইসলাম বলেন, আক্রান্ত ছয়জনের মধ্যে দুইজন ভালো হয়ে বাড়িতে গেছেন। দুইজন সিলেটে চিকিৎসা নিচ্ছেন। আর দুইজন সুনামগঞ্জ সদর ২৫০ শয্যা হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। আক্রান্তরা ঢাকায় ছিলেন, সেখান থেকে ডেঙ্গু নিয়ে এসেছেন। তবে তাদের অবস্থা ভালো।
হবিগঞ্জ জেলার স্বাস্থ্য তত্ত্বাবধায়ক ডা. রুহুল আমীন বলেন, বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত হবিগঞ্জে ১২ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। তাদের চিকিৎসা চলছে।
সরেজমিনে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দেখা যায়, হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সম্প্রসারিত ২৭নং ওয়ার্ডের ডেঙ্গু কর্নারে চিকিৎসাধীন রয়েছেন সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার সড়কের বাজার এলাকার উমাইরমাটি গ্রামের মৃত মঈন উদ্দিনের ছেলে নজরুল ইসলাম। তিনি ঢাকার মহাখালী এলাকায় নির্মাণশ্রমিকের কাজ করতেন। তিনদিন আগে সেখানেই ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়েছেন তিনি। মঙ্গলবার সিলেটে এসে ভর্তি হন নজরুল।
একইভাবে ভর্তি হয়েছেন হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলার নুরীহাট গ্রামের এমরান মিয়ার ছেলে ইমন ও সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার চরিপাড়া গ্রামের আব্দুল হাফিজের ছেলে মাহমুদুল হাসান। তাদের মধ্যে ইমন রাজধানী ঢাকার পান্থপথ এলাকার একটি কলেজের ছাত্র ও হাসান তেজগাঁও এলাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।
এছাড়া ওই ওয়ার্ডের আরও কয়েকজন ঢাকা থেকে আক্রান্ত হয়ে এখানে ভর্তি হয়েছেন। ওই ওয়ার্ডে ভর্তি রয়েছেন সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ থানার এসআই রাজিব চৌধুরী। তবে তিনি কোম্পানীগঞ্জ থানা এলাকাতেই ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়েছেন বলে জানা গেছে।
অপরদিকে, হাসপাতালের চারতলার মহিলা মেডিসিনের ৩নং ওয়ার্ডেও একই অবস্থা। সেখানে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানা এলাকার নাসির উদ্দিনের মেয়ে নাজনীন আহমেদ নাহিন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী। গত ২৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হলে তিনি ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন।
এখানে আরও ভর্তি রয়েছেন সিলেট নগরের দাড়িয়াপাড়া এলাকার রফিক উদ্দিনের স্ত্রী শাহিদা বেগম। তিনি ঢাকায় তার বাবার বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলেন। সেখানেই ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হন তিনি।
জাবির আহমেদ নামে এক রোগীর স্বজন জানান, সাধারণ রোগীদের সঙ্গে একই ওয়ার্ডে ডেঙ্গু রোগীদের রাখা মোটেই ঠিক হয়নি। সাধারণ রোগীদের কোনো মশারি দেয়া হয় না। ফলে আক্রান্তদের দেহ থেকে মশার মাধ্যমে এ রোগ ছড়াতে পারে। তাদের পৃথক স্থানে রাখা উচিত ছিল।
সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলা থেকে আসা রোগীর স্বজন কাইয়ুম সাজ্জাদ জানান, ডেঙ্গু এখন মহামারি। এখানে যে কয়েকজন রোগী রয়েছেন তারা সাধারণ রোগীদের মতো চলাচল করছেন। ফলে যেকোনো সময় এই ভাইরাস ছড়াতে পারে। ডেঙ্গু আক্রান্তদের পৃথক কর্নারে রাখা হোক।
এ ব্যাপারে হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, জায়গা স্বল্পতা থাকায় সাধারণ ওয়ার্ডে ডেঙ্গু রোগীদের ভর্তি করতে হয়েছে। তবে যারা ডেঙ্গু আক্রান্ত তাদেরকে সবসময় মশারি ব্যবহার ও সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। এজন্য রোগীর অভিভাবককে আরও সচেতন হতে হবে।
সিলেটের ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ নুরে আলম শামীম বলেন, দেশের অন্যান্য জেলার মতো সিলেটেও ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে। বুধবার কন্ট্রোল রুমের রিপোর্টে ৭৩ জন রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। ভর্তিকৃতদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রয়েছেন সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। অন্যান্য বেসরকারি হাসপাতালেও চিকিৎসাধীন আছেন অনেকে। ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রয়েছেন পুরুষ রোগী এবং তারা কমবয়সী।
ছামির মাহমুদ/এএম/পিআর