শুরু হলো রক্তঝরা আগস্ট। এই মাস কান্নার মাস। বেদনার মাস। শোকাবহ আগস্টে জাতি হারিয়েছে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। যার অঙ্গুলির নির্দেশে গোটা বাঙালি জাতি একাত্তরে ‘যার হাতে যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা’ করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ৯ মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে ছিনিয়ে এনেছিল স্বাধীন বাংলার লাল-সবুজ পতাকা। সেই তাঁকেই কিনা জীবন দিতে হলো এদেশেরই কিছু বিপথগামী সেনাসদস্যের হাতে। এই আগস্টে তাই নতুন করে শপথ নিতে হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশকে আরো এগিয়ে নেয়ার।
Advertisement
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে তাঁর নাম নিশানা মুছে ফেলতে চেয়েছিল ঘাতক চক্র। শুধু তাই নয়, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশকে তারা ফিরিয়ে নিতে চেয়েছিল পাকিস্তানি ভাবধারায়। সত্যি বলতে কী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করার পর রাজনীতির বিপথগামিতার শুরু হয়। নানা ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ক্ষমতাসীন হওয়ার পর প্রকৃত রাজনীতিবিদদের কাছে টানতে না পেরে দলছুটদের নিয়ে দল গঠন করলেন ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য। হালুয়া রুটির আশায় অনেকেই ভিড়লেন সে দলে। রাজনীতিবিদরা যাতে তাঁর জন্য হুমকি না হতে পারেন সে জন্য তিনি এমনসব বিধি ব্যবস্থা প্রণয়ন করলেন যাতে প্রকৃত রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি করাটা সত্যি কঠিন হয়ে পড়ল। তিনি নিজেই ঘোষণা করলেন, রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি কঠিন করার কথা।
যে ছাত্ররা ভাষা আন্দোলন করলেন, ৬ দফাকে জনপ্রিয় করলেন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি করলেন এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অগ্রসৈনিকের ভূমিকা পালন করলেন সেই ছাত্ররাজনীতির উর্বর ভূমিতে রোপণ করা হলো স্বার্থপরতা এবং ক্ষমতালিপ্সার বিষবৃক্ষ। অস্ত্র, টাকা, আর ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে ছাত্রদের একটি অংশকে দলে টানতে সক্ষম হলেন সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান। আরেক সামরিক শাসক ক্ষমতায় এসে সেই ধারাবাহিকতা বজায় রাখলেন। বিষবৃক্ষে জল ঢাললেন। এর মাধ্যমে ছাত্ররাজনীতিতে কলুষতার ষোলোকলা পূর্ণ হলো। ক্ষমতায় থাকা এবং যাওয়ার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকল ছাত্র নেতারা। ছাত্র রাজনীতিতে থেকে আদর্শ নামক বস্তুটি হারিয়ে যেতে থাকল। সেই সঙ্গে জাতীয় রাজনীতি থেকেও।
কেননা সামরিক শাসন আমলে একটি নব্য ধনিক শ্রেণীর সৃষ্টি হওয়ায় তারা ক্ষমতার অংশীদার হতে চাইলেন। টাকা দিয়ে দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার সংস্কৃতি চালু হলো এবং আরও বেশি টাকা দিয়ে মন্ত্রিত্বের পদ কেনারও ব্যবস্থা হলো। এভাবে রাজনীতি চলে গেল ব্যবসায়িক শ্রেণির হাতে। নির্বাচনী ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ত্যাগী আদর্শবাদী রাজনীতিবিদরা অনেকেই রাজনীতির মাঠ থেকে ছিটকে পড়লেন। অন্যদিকে সামরিক শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় মৌলবাদী রাজনীতি ফুলেফেঁপে উঠল। এমনকি তারা ক্ষমতার অংশীদার পর্যন্ত হলো। শুধু রাজনীতি নয়, ধর্মকে পুঁজি করে তারা ব্যাংক-বীমাসহ অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও স্থাপন করল। ব্যবসা-বাণিজ্যে, রাজনীতিতে ‘মৌলবাদের অর্থনীতি’ এক বিরাট সমস্যা হয়ে দেখা দিল।
Advertisement
রাজনীতিতে জায়গা করে নিল সাম্প্রদায়িকতা। স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হওয়ায় একটি সুস্পষ্ট বিভাজন সৃষ্টি হলো। সামরিক শাসকদের সৃষ্টি করা দলগুলো এই বিভাজনকে আরও প্রকট করে তুলল। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তিকে এভাবে দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে রাখা হলো। সামরিক, বেসামরিক প্রশাসন এমনকি বিচার বিভাগকেও ক্ষতবিক্ষত করা হলো দলীয়করণের মাধ্যমে। এভাবে গণতান্ত্রিক চর্চা ব্যাহত হতে থাকল।
এরপর নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনের পর গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা শুরু হলেও সে পথও কণ্টকাকীর্ণ হয়ে পড়ল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তির হাতে ক্ষমতা ফিরে না আসায়। এক সামরিক সরকার হটিয়ে সেনাছাউনিতে জন্ম নেয়া দলটিকেই আবার ক্ষমতাসীন করা হলো। এভাবে গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে কার্যত সামরিক শাসকের উত্তরসূরিরাই ক্ষমতায় থেকে গেল। ফলে গণতন্ত্র কাক্ষিত মাত্রায় বিকশিত হতে পারল না।
এরপর দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বিকাশ শুরু হয়। এত দিনের পুঞ্জীভূত পাহাড়সম সমস্যার সামনে দাঁড়িয়েও শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার দেশে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হন। এই সময় রাজনীতিতেও একটি গুণগত পরিবর্তনের ধারা সূচিত হয়। এরই মধ্যে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের অনেকের ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হয়েছে। চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদেরও বিচার হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারায় দেশ আবার ফিরে এসেছে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে জনকল্যাণই ছিল মুখ্য বিষয়। তাকে হত্যার মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে যে বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। শোকাবহ আগস্টে নতুন করে শপথ নিতে হবে যাতে জনকল্যাণই মুখ্য বিষয় হয় রাজনীতির। অনিশ্চিত অন্ধকারের পথে আর এক মুহূর্ত নয়। হীনস্বার্থ নয়, একটি সুখী সমৃদ্ধ গণতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই কেবল বঙ্গবন্ধুসহ সকল শহীদের রক্তঋণ শোধ করা সম্ভব। রাজনৈতিক দলগুলোকে এ ব্যাপারে অবশ্যই ঐকমত্যে পৌঁছতে হবে।
Advertisement
এইচআর/জেআইএম