বর্তমানে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ তলানিতে রয়েছে। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ঋণপ্রবৃদ্ধি কমে বিগত ৬ বছরের সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমেছে। এমন পরিস্থিতিতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি ঘোষণা করতে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
Advertisement
বাংলাদেশ ব্যাংকের জাহাঙ্গীর আলম কনফারেন্স হলে বুধবার বেলা সাড়ে ১১টায় চলতি (২০১৯-২০) অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) জন্য মুদ্রানীতি (মনিটরি পলিসি স্টেটমেন্ট) ঘোষণা করবেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জনের মধ্যে ভারসাম্য রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতি বছর দু’বার মুদ্রানীতি প্রণয়ন ও প্রকাশ করে। ছয় মাস অন্তর এই মুদ্রানীতি একটি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে অর্থাৎ জুলাই মাসে এবং অন্যটি জানুয়ারি মাসে প্রণয়ন হয়। দেশের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় মুদ্রানীতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে পরবর্তী ছয় মাসে অভ্যন্তরীণ ঋণ, মুদ্রার সরবরাহ, অভ্যন্তরীণ সম্পদ, বৈদেশিক সম্পদ কতটুকু বাড়বে বা কমবে এর একটি পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়।
জানা গেছে, বর্তমানে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ তলানিতে রয়েছে। এখন বিনিয়োগ পরিস্থিতি উন্নতি করতে না পারলে চলতি অর্থবছরে সরকার লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জন চ্যালেঞ্জিং হবে। এমন পরিস্থিতিতে কীভাবে ঋণপ্রবাহ তথা বিনিয়োগের গতি ফেরানো যায়, সে বিষয়টিতে বেশি গুরুত্ব দিতে চাওয়া হচ্ছে নতুন মুদ্রানীতিতে।
Advertisement
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরের মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের প্রক্ষেপণ ছিল সাড়ে ১৬ শতাংশ। কিন্তু গত জুন শেষে এ খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১১ দশমিক ২৯ শতাংশ। এটি চলতি মুদ্রানীতির ঘোষিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৫ শতাংশ কম। অপরদিকে সরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধির প্রক্ষেপণ ছিল ১০ দশমিক ৯০ শতাংশ। আর অভ্যন্তরীণ ঋণ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ১৫ দশমিক ৯০ শতাংশ। জুন শেষে প্রাথমিক হিসাবে দেশের অভ্যন্তরীণ প্রবাহে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১২ দশমিক ১৭ শতাংশ আর সরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৮ দশমিক ১০ শতাংশ।
সংশ্নিষ্টরা বলছেন, বেসরকারি বিনিয়োগ কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ ব্যাংকগুলোর কাছে এখন পর্যাপ্ত তারল্য নেই। ঋণ আমানত অনুপাতের (এডিআর) সমন্বয়ের চাপ রয়েছে। এছাড়া আর্থিক খাতের নানা কেলেঙ্কারি ও সঞ্চয়পত্রে সুদ বেশি হওয়ায় ব্যাংকে আমানত প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। ফলে একদিকে চাহিদা থাকার পরও ঋণ দিতে পারছে না ব্যাংকগুলো। অন্যদিকে উচ্চ সুদহারের কারণে ঋণ নিতেও আগ্রহী না উদ্যোক্তা ব্যবসায়ীরা। সব মিলিয়ে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমছে।
তাদের মতে,বেসরকারি ঋণ কমে যাওয়ায় এ খাতের প্রবৃদ্ধি কমেছে। অন্যদিকে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ কমায় সরকারি খাতের ঋণ প্রবাহ বেড়েছে। সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক মেগা প্রকল্পের জন্য বড় আমদানি ব্যয় হয়েছে। এ কারণে সরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধি বেড়েছে।
২০১৮-১৯ অর্থবছরের মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ায় এ খাতে লক্ষ্য কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অন্যদিকে সরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ সম্প্রসারণের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এজন্য নতুন মুদ্রানীতিতে সরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ ১৬ শতাংশে উন্নীত করার প্রস্তাব করা হবে বলে জানা গেছে। অন্যদিকে বেসরকারি খাতে ঋণ ১৪ থেকে ১৫ শতাংশের লক্ষ্য ঠিক করা হবে।
Advertisement
এদিকে গুণগতমানের উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনে বেসরকারি ঋণ বাড়ানো ছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই। এ জন্য বেসরকারি ঋণ কেন বাড়ছে এ বিষয়ে অনুসন্ধান করতে হবে এবং যুগোপযোগী বাস্তব প্রদক্ষেপ দিতে হবে, বলছেন অর্থনীতিবিদরা।
মুদ্রানীতি প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বেসরকারি খাতের ওপর নির্ভর করে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। কিন্তু ধারাবাহিকভাবে বেসরকারি ঋণ কমে যাওয়া অর্থনীতির জন্য শুভকর নয়। কেননা এ রকম প্রবণতা থাকলে কর্মসংস্থান কমবে। অর্থনীতির অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হবে।
তিনি বলেন, বেসরকারি খাতের ঋণ কেন বাড়ছে না তা অনুসন্ধান করতে হবে। এছাড়া অনিয়ম অব্যবস্থাপনা, খেলাপি ঋণসহ ব্যাংকিং খাতের নানা সমস্যা রয়েছে তা সমাধান করতে হবে।
সাবেক এ গভর্নর বলেন, এখন চ্যালেঞ্জ নিয়ে বেসরকারি খাতের ঋণ বাড়াতে হবে। আবার সরকার যেন ঋণ বেশি না নেয় সেই বিষয়টি সমন্বয় করতে হবে। কারণ সরকার বেশি খরচ করলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে। তাই টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হবে। এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে যুগোপযোগী সিন্ধন্ত নেয়ার পরামর্শ দেন প্রবীণ এ অর্থনীতি বিশ্লেষক।
এদিকে চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৮ দশমিক ২০ শতাংশ। আর মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সহায়তা করতে মুদ্রানীতি ঘোষণা করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এসআই/এনএফ/এমএস