এমনিতেই দেশের ক্রিকেটে হঠাৎ দুঃসময়। বিশ্বকাপের মাঠ মাতিয়ে যুক্তরাজ্যে ওভাল, কার্ডিফ, টনটন আর সাউদাম্পটন মাতানো টাইগাররা শ্রীলঙ্কার মাটিতে গিয়ে লঙ্কানদের সাথে খাবি খাচ্ছে। আগের রাতে ঘুরে দাঁড়াতে গিয়ে উল্টো মুখ থুবড়ে পড়েছে তামিম, সৌম্য, মাহমুদউল্লাহ, সাব্বির-মোসাদ্দেকরা।
Advertisement
সেই হতাশা ঘেরা রাত পার হতেই সোমবার সকাল সকাল কানে আসলো দুঃসংবাদ, জাতীয় দলের প্রথম অধিনায়ক শামীম কবির আর নেই। ৭৫ বছর বয়সে রাজধানীর ইডেন হসপিটালে পরলোক গমন করেছেন।
তার সমবয়সী আর সমসাময়িক ক্রিকেটার ও ক্রিকেট ব্যক্তিত্বের বেশিরভাগই বেঁচে নেই। পাড়ি জমিয়েছেন পরপারে। কাজেই শামীম কবিরের স্মৃতিচারণ করার মত মানুষ খুঁজে পাওয়াও কঠিন।
অফিস থেকে বলা হলো, বাবু ভাই আপনার সাথে তো ক্রিকেট এরেনার অনেকের সখ্য, শামিম কবিরের সাথে পরিচয়টা কেমন ছিল? তাকে নিয়ে আপনার স্মৃতিচারণ একটি লেখা লিখে ফেলেন না। কী করে বোঝাই শামীম কবির যখন ক্রিকেট ছেড়েছেন আমি তখন স্কুল বালক, হাফ প্যান্ট পরি। যদিও তখন মানে ৭০ দশকের শেষ ভাগে একটু-আধটু ক্রিকেট দেখি। কিন্তু শামীম কবিরের কোন খেলার কথা মনে নেই।
Advertisement
থাকবে কি করে? সাংবাদিকতা জীবনে তো প্রশ্নই আসে না, আমি যখন নিয়মিত ঢাকা মাঠে (আজকের বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম ও তার চারপাশে) খেলা দেখতে শুরু করি, তারও আগেই শামীম কবির আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় দলের পক্ষে খেলা থেকে দূরে সরে দাঁড়িয়েছিলেন।
আজ পত্রপত্রিকা আর অনলাইনসহ সর্বত্র লেখা হয়েছে ও হচ্ছে, টিভি চ্যানেলগুলোয় বলা হচ্ছে শামীম কবির ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় দলের প্রথম অধিনায়ক। ১৯৭৭ সালে বিশ্ব ক্রিকেটের এক অভিজাত ও ঐতিহ্যবাহী দল মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাবের (এমসিসি) সঙ্গে বাংলাদেশ জাতীয় দলের প্রথম অনানুষ্ঠানিক তিন দিনের ম্যাচে নেতৃত্বে ছিলেন সদ্য প্রয়াত শামীম কবির।
কিন্তু কেউ কি জানেন, সেটাই ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় দলের হয়ে শামীম কবিরের প্রথম ও শেষ ম্যাচ। তারপর শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট দলের বাংলাদেশ সফর এবং পাকিস্তানের বিপক্ষে ঘরের মাঠে আর ১৯৭৯ সালে ইংল্যান্ডে প্রথম আইসিসি ট্রফি- কোন জায়গায়ই ছিলেন না শামিম কবির। তাই চিন্তায় পড়ে গেলাম কার কাছ থেকে স্মৃতিচারণ করি?
হঠাৎ একটি ছবির দিকে চোখ পড়লো, এইতো আজ পরলোকে পাড়ি জমানো শামীম কবির আর রকিবুল হাসান পাশাপাশি ব্যাট হাতে পা বাড়াচ্ছেন এবং সেটা ঐ এমসিসির বিপক্ষে প্রথম বেসরকারি ম্যাচেই।
Advertisement
তখনই মনে হলো, ‘ইউরেকা’! আরে মিছেই এদিক ওদিক খুঁজে ফিরছি। আর কাউকে দরকার নেই। রকিবুল হাসানই হতে পারেন সর্বোত্তম ব্যক্তি, যিনি শামীম কবিরের স্মৃতিচারণ করতে পারবেন বেশ ভাল।
বলার অপেক্ষা রাখে না, জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক ও বাংলাদেশর ক্রিকেটের প্রথম তারকা উইলোবাজ রকিবুল হাসানের ঢাকাই ক্রিকেটে হাতে খড়িও সেই আজাদ বয়েজ ক্লাবেই। ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটে শামীম কবির যে দলের হয়ে খেলতেন, সেই কেতাদুরস্ত ক্রিকেটারদের পিঠস্থান অভিজাত ক্রিকেট ক্লাব আজাদ বয়েজের হয়ে ৬০ দশকের শেষ ভাগে (১৯৬৬-১৯৬৭) প্রথম নাম লেখান পরবর্তীতে দেশের ক্রিকেটের অন্যতম সেরা ওপেনিং ব্যাটসম্যান ও অধিনায়ক রকিবুল হাসান।
যেমন ভাবা, তেমন কাজ। মুঠোফোনে রকিবুল হাসানের শরণাপন্ন হওয়া। সৌজন্যতা বিনিময় পর্ব শেষ করে আসল উদ্দেশ্য বলার আগে রকিবুল হাসান নিজ থেকেই বলে বসলেন, মনটা মোটেই ভাল নেই। ভেতরটা বিষাদে ভরা। অগ্রজ শামীম ভাই চলে গেলেন।
পরক্ষণে কথা পাতা হলো, তার স্মৃতিচারণ করতেই আপনাকে ফোন দেয়া। তারপর স্মৃতি ঝাপি খুললেন রকিবুল। বললেন অনেক কথা। যা নতুন প্রজন্মের কাছে একদমই অজানা। কেমন মানুষ ছিলেন শামিম কবির? তার ক্রিকেট বোধ, অনুভব, মেধা-প্রজ্ঞাই বা ছিল কতটা?
এসব বলতে গিয়ে রকিবুল হাসান বলে দিলেন, নো ডাউট শামীম ওয়াজ আ পারফেক্ট জেন্টলম্যান, আ ম্যান অব পারসোনালিটি। ক্রিকেটার হিসেবে কেমন ছিলেন? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে রকিবুলের মুখ থেকে বেরিয়ে এলো, শামিম ভাই ছিলেন খুব কেতাদুরস্ত ক্রিকেটার। দেখেই মনে হতো এক অভিজাত ক্রিকেটারের প্রতিমূর্তি।
জানালেন তার সঙ্গে এক সুঁতোয় গাঁথা ছিলেন শামীম কবির এবং যে সম্পর্কের সূচনা হয়েছিল একদম ৬০ দশকের শেষ ভাগে (১৯৬৬-১৯৬৭'তে)। আবেগতাড়িত রকিবুল বলে উঠলেন, আমার ক্রিকেট ক্যারিয়ারের সাথে শামীম ভাইয়ের স্মৃতি জড়িয়ে আছে আষ্টেপৃষ্টে। আমি যখন ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটে প্রথম ওপেন করি, তখন আমার সিনিয়র পার্টনার ছিলেন শামীম ভাই। তারপর ১৯৬৮ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের হয়ে যখন প্রথম কায়েদ ই আজম ট্রফিতে প্রথম খেলতে নামি, তখনও তিনি ছিলেন আমার সঙ্গী। সেটাই শেষ নয়। এরপর স্বাধীন বাংলাদেশের হয়ে যখন প্রথম খেলি, শামীম ভাই সে দলের অধিনায়ক আর ওপেনিং ব্যাটসম্যান- বিস্তারিত বলতে গিয়ে খানিক আবেগতাড়িত রকিবুল হাসান।
আমি তখন নবম শ্রেণির ছাত্র। পড়তাম ঢাকা তথা দেশের অন্যতম অভিজাত ও সেরা বিদ্যা নিকেতন সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুলে। সেই স্কুল মাঠের এক ক্রিকেট আসরে ভাল খেলেই আজাদ বয়েজ ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতার চোখে পড়া এবং তার মাধ্যমেই আজাদ বয়েজ ক্লাবে নাম লিখানো। আর সেই দলের অধিনায়ক ছিলেন শামীম কবির।
কিন্তু প্রথম বছর সেভাবে সুযোগ পাইনি। কারণ আজাদ বয়েজের হয়ে তখন খেলতে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অনেক লদ্ধ প্রতিষ্ঠিত ব্যাটসম্যান। সবাই বয়সে সিনিয়র, মেধাবী। আর আমি ক্লাস নাইনে পড়া এক কিশোর। তাই পুরো মৌসুম প্রায় বসেই কাটাতে হলো। প্রথম বছর আজাদ বয়েজের হয়ে একটি ম্যাচ খেলার সুযোগ পাই। সেটাও মিডল অর্ডারে। সাত নম্বর পজিসনে। এখনও মনে আছে ২৭- ২৮ রানে নট আউট ছিলাম।
তারপরের বছর মানে ১৯৬৮ সালে হঠাৎ এক ম্যাচের আগে শামীম ভাই আমাকে নেটের পর বললেন, রকিবুল শোন, কালকের ম্যাচে তুই আমার সাথে ওপেন করতে নামবি। পারবি? আমি তখন খেলতে মুখিয়ে ছিলাম। বললাম, পারবো। প্রতিপক্ষ ঠিক মনে নেই। টাউন ক্লাব না কোন দল যেন ছিল।
শামীম ভাই আর আমি ওপেন করতে নামলাম। এখনো পরিষ্কার মনে আছে, ঢাকা স্টেডিয়ামের ঠিক বাইরে আউটার স্টেডিয়ামের দুই নম্বর মাঠে হয়েছিল খেলা। শামীম ভাই সেঞ্চুরি করেছিলেন আর আমি ৭০+ রানের এক ইনিংস খেলে নট আউট থাকলাম। তারপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ঐ বছরই আমি চার চারটি সেঞ্চুরি করে পূর্ব পাকিস্তান দলে জায়গা পাই। সেখানেও শামীম ভাই ছিলেন ওপেনার। আর অধিনায়ক ছিলেন লতিফ ভাই।
আমার স্মৃতিতে আজও অম্লান, লিটল মাস্টার হানিফ মোহাম্মদের নেতৃত্বে করাচি ছিল দারুণ শক্তিশালী এক দল। মুশতাক মোহাম্মদ, জহির আব্বাসের মত নামী তারকাও ছিলেন সেই দলে। আমি আর শামীম ভাই ওপেন করেছিলাম।
তারপর দেশ স্বাধীন হলো। আমি আজাদ বয়েজেই থেকে গেলাম। ১৯৭৪ পর্যন্ত শামীম ভাই আমাদের ক্যাপ্টেন ছিলেন। তারপর আমি চলে গেলাম ভিক্টোরিয়ায়। সেখান থেকে মোহামেডানে। এরপর ১৯৭৬ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশে এলো এমসিসি। আমরা জোনাল ম্যাচ খেললাম। আমিও এক জোনের অধিনায়ক ছিলাম।
আর শেষ অবশি শামীম ভাইয়ের ক্যাপ্টেন্সিতে হলো প্রথম তিন দিনের আন অফিসিয়াল ম্যাচ। একটু বলে রাখি, এমসিসির সাথে যে ম্যাচে আমরা ‘টিম বাংলাদেশ’ নামে খেলতে নেমেছিলাম, ঐ ম্যাচের আগে ঘরোয়া ক্রিকেটেও শামীম ভাই নিয়মিত ছিলেন না। তখন তিনি প্রায় খেলা ছেড়েই দিয়েছিলেন। তবে যেহেতু তিনি পাকিস্তান আমলে আমাদের সবার বয়সে বড় ছিলেন এবং সিনিয়র ক্রিকেটার হিসেবে খেলেছেন। তাই বাংলাদেশ জাতীয় দলের প্রথম ম্যাচে আনুষ্ঠানিকভাবে শামীম ভাইকে অধিনায়ক মনোনীত করে প্রক্রারন্তরে তাকে সম্মানিত করেছিল তদানিন্তন বিসিসিবি।
১৯৭৭ সালের জানুয়ারি মাসে এমসিসির বিপক্ষে নেতৃত্ব দেবার পর আর জাতীয় দলের হয়ে খেলেননি শামিম ভাই। ব্যবসায় পুরোপুরি মনোযোগী হন। দেশের অন্যতম অভিজাত ও ঐতিহ্যবাহী পরিবারের সদস্য শামীম ভাই (দেশ প্রসিদ্ধ পত্রিকা দৈনিক সংবাদের সম্পাদক ও বিশিষ্ট প্রগতিশীল চেতনার রাজনীতিবিদ আহমেদুল কবিরের ছোট ভাই)।
অনেকে জানেন না, ক্রিকেট ছেড়ে শামীম ভাই সামাজিক সংগঠনের সাথে জড়িয়ে পড়েন। তিনি অভিজাত ‘ঢাকা ক্লাবের’ ও প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তবে কখনও ক্রিকেট বোর্ড বা ক্লাব ক্রিকেটে জড়াননি। অবশ্য ১৯৮২ ও ১৯৮৬ সালে জাতীয় দলের ম্যানেজারের দায়িত্বও পালন করেছেন।
শামীম কবির সম্পর্কে রকিবুল হাসানের শেষ কথা, আমি সৌভাগ্যবান। শামীম ভাইকে ক্রিকেটার, ওপেনিং পার্টনার আর অধিনায়ক হিসেবে পেয়েছি। পরে জাতীয় দলের ম্যানেজার পদেও দেখেছি আমার মনে হয়েছে, সব জায়গায় দারুণ পরিপাটি ও সুশৃঙ্খল এক মানুষ শামীম ভাই। দারুণ সাজানো গোছানো। সব সময় নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলা মেনে চলতেন। খুব পরিপাটি আর কেতাদুরস্ত থাকতেে পছন্দ করতেন।
১৯৮২ সালে আমরা যখন আইসিসি ট্রফি খেলতে ইংল্যান্ডে যাই তখনকার একটি ঘটনা বলি, ইংল্যান্ডে তখন গ্রীষ্মকাল। সূর্য ডুবতো প্রায় রাত ১০.০০ টায়। আর শামীম ভাই ম্যাচের আগের দিন আমাদের ৯টা নাগাদ ঘুমাতে যেতে বলতেন। আমরাও খুনসুটি করতাম। বলতাম, শামিম ভাই এখনও তো সন্ধ্যায়ই হয়নি। আমরা কি দিনেই রাতের ঘুম ঘুমাবো? শামিম ভাই আমাদের সবার হোটেল রুমে জানালার মোটা পর্দা ঢেকে বলতেন, রাত ভেবেই ঘুমিয়ে পড়। কাল সকালে খেলা। ভোরে উঠতে হবে।
জাগো নিউজের সঙ্গে শামীম কবিরের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মিনহাজুল আবেদিন নান্নুও দারুণ এক গল্প শোনালেন।
নান্নু যেবার প্রথম আইসিসি ট্রফি খেলতে যান, সেবার মানে ১৯৮৬ সালেও শামীম কবির ছিলেন জাতীয় দলের ম্যানেজার। বলার অপেক্ষা রাখে না, সেবার আইসিসি ট্রফির আসর বসেছিল ইংল্যান্ডে। দারুণ কেতাদুরস্ত ও পেশাক আশাক এবং কথা বার্তায় চোস্ত শামীম কবির চাইতেন দলের ক্রিকেটাররা সব সময় পরিপাটি থাকুক।
আর তাই খেলার দিন টিম বাসে মাঠে যাবার আগেও ক্রিকেটারদের ‘স্যুটেড ব্যুটেড’ রাখতে চাইতেন। নান্নু জানান, খেলার দিন মানে ম্যাচ ডে'তে আমরা মাঠে যাবার আগেই শামীম ভাই সবাইকে জানিয়ে দিতেন, বয়েজ গেট ড্রেসড। মানে ব্লেজার, ট্রাউজার্স আর শু পরে নাও। তারপর মাঠে গিয়ে ড্রেসিং রুমে পোশাক পাল্টে ক্রিকেটের সাদা পোশাক পরে নেবে।
এআরবি/এসএএস/এমআরএম