জাতীয়

যার ফোনে ফেরি ছাড়া হয়নি তার নির্দেশেই তদন্ত কমিটি

যুগ্ম সচিবের অপেক্ষায় তিন ঘণ্টা দেরিতে ফেরি ছাড়ায় মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ির ১নং ফেরিঘাটে অ্যাম্বুলেন্সে স্কুলছাত্র তিতাস ঘোষের মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে তিনটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।

Advertisement

এর মধ্যে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক মো. ওয়াহিদুল ইসলাম। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. শহিদুল হক পাটোয়ারীকে প্রধান করে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন জেলা প্রশাসক।

আরও পড়ুন : ভিআইপি সংস্কৃতির অপব্যবহার বন্ধে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রয়োজন

কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন শিবচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান, এএসপি (সার্কেল) আবির হোসেন ও বিআইডব্লিউটিসির এজিএম (মেরিন) একেএম শাজাহান। কমিটিকে সাতদিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

Advertisement

অথচ ওই দিন ‘ভিআইপি যাবে’ বলে ফেরিঘাটের ব্যবস্থাপক সালামকে বার্তা পাঠান জেলা প্রশাসক মো. ওয়াহিদুল ইসলাম। মূলত তার অনুরোধ রাখতেই ওই দিন দেরিতে ফেরি ছাড়া হয়। ফলে মস্তিষ্কে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়ে অ্যাম্বুলেন্সেই মারা যায় স্কুলছাত্র তিতাস।

আরও পড়ুন : সচিবের অপেক্ষায় ৩ ঘণ্টায় ছাড়েনি ফেরি, অ্যাম্বুলেন্সে রোগীর মৃত্যু

একই ঘটনা তদন্তে আরেকটি কমিটি গঠন করেছে বিআইডব্লিউটিসি। বিআইডব্লিউটিসির জেনারেল ম্যানেজার মো. আশিকুজ্জামানকে প্রধান করে দুই সদস্যের এ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অপর সদস্য হলেন সংস্থাটির ডিজিএম (মেরিন) মো. ফজলুল হক।

এরই মধ্যে সোমবার দুপুরে আশিকুজ্জামানের নেতৃত্বে বিআইডব্লিউটিসির দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। পরিদর্শনকালে কুমিল্লা ফেরির ইনচার্জ, কাঁঠালবাড়ি ঘাটের বিআইডব্লিউটিসির কর্তব্যরত কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন তদন্ত কমিটির সদস্যরা। একই সঙ্গে ঘাট এলাকা পরিদর্শন করেন তারা। তবে এ বিষয়ে সাংবাদিকদের কিছুই জানাননি তদন্ত কমিটির সদস্যরা।

Advertisement

এর আগে সোমবার সকালে এ ঘটনা তদন্তে একটি কমিটি গঠন করে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব শাহনেওয়াজ দিলরুবা খানকে প্রধান করে দুই সদস্যের এ কমিটি করা হয়। কমিটির অপর সদস্য হলেন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব শাহ হাবিবুর রহমান হাকিম। কমিটিকে আগামী সাতদিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।

আরও পড়ুন : সচিবের অপেক্ষায় ফেরি : অ্যাম্বুলেন্সে মৃত্যুর ঘটনায় তদন্ত কমিটি

জানা যায়, গত বৃহস্পতিবার রাতে জেলার শিবচরের কাঁঠালবাড়ি ঘাটে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এটুআই প্রকল্পের যুগ্ম সচিব আবদুস সবুরের জন্য ফেরি ছাড়তে দেরি হওয়ার কারণে অ্যাম্বুলেন্স যাত্রী স্কুলছাত্র তিতাস ঘোষের মৃত্যুর ঘটনার অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় সোমবার তিনটি আলাদা তদন্ত কমিটি গঠ্ন করা হয়েছে।

এর আগে গত বৃহস্পতিবার রাত ৮টার দিকে মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ি ১নং ফেরিঘাটে ফেরির জন্য অপেক্ষা করছিল সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত স্কুলছাত্র তিতাসকে বহনকারী একটি অ্যাম্বুলেন্স। তিন ঘণ্টা অপেক্ষার পর রাত ১১টার দিকে ফেরিতে ওঠে অ্যাম্বুলেন্সটি। কিন্তু ততক্ষণে মস্তিষ্কে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়ে অ্যাম্বুলেন্সেই মারা যায় ওই স্কুলছাত্র।

নিহত তিতাস ঘোষ (১২) নড়াইলের কালিয়া উপজেলার পৌর এলাকার মৃত তাপস ঘোষের ছেলে। কালিয়া পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র ছিল তিতাস।

আরও পড়ুন : ৯ দিন পর পদ্মায় ভেসে উঠল স্ত্রী, এখনও নিখোঁজ স্বামী

স্থানীয় সূত্র ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অতিরিক্ত সচিবের গাড়ির অপেক্ষায় প্রায় তিন ঘণ্টা ফেরি ঘাটে থাকায় প্রাণ গেল অ্যাম্বুলেন্সের রোগীর। ওই দিন আশপাশের লোকজনের অনুরোধের পরও কাঁঠালবাড়ি ঘাট থেকে ফেরি ছাড়া হয়নি। অথচ রাত ৮টায় কাঁঠালবাড়ি ১নং ফেরিঘাটে পৌঁছায় অ্যাম্বুলেন্সটি। তখন কুমিল্লা নামের ফেরিটি ঘাটেই ছিল। কিন্তু ওই কর্মকর্তার গাড়ি না আসা পর্যন্ত ফেরি ছাড়তে রাজি হয়নি ঘাট কর্তৃপক্ষ। কারণ ওই কর্মকর্তার ভিআইপি গাড়ি যাওয়ার বার্তা দিয়েছিলেন মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক।

এ অবস্থায় রোগীর স্বজনরা ফোন করেন জাতীয় জরুরি সেবার ৯৯৯ নম্বরে। সাহায্য চান ঘাটে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের। কিন্তু কারও কোনো অনুরোধই রাখেনি ঘাট কর্তৃপক্ষ। প্রায় তিন ঘণ্টা পর রাত পৌনে ১১টার দিকে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের স্টিকার লাগানো সাদা রঙের মাইক্রোবাসটি ঘাটে আসার পর রাত ১১টার দিকে ফেরি ছাড়া হয়। ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। মস্তিষ্কে প্রচুর রক্তক্ষরণে অ্যাম্বুলেন্সেই মৃত্যু হয় স্কুলছাত্র তিতাসের।

তিতাসের স্বজনদের অভিযোগ, ভিআইপি আসার অপেক্ষায় প্রায় তিন ঘণ্টা ঘাটেই বসেছিল ফেরিটি। আশপাশের লোকজনের অনুরোধের পরও কাঁঠালবাড়ি ঘাট থেকে ফেরি ছাড়েনি। এমনকি সরকারি জরুরি সেবা পেতে ৯৯৯ নম্বর ফোন করেও কোনো কাজ হয়নি। পুলিশ এবং ঘাট কর্তৃপক্ষ বার বার জানিয়ে দিল ভিআইপি আসবে, তারপর ফেরি ছাড়া হবে। রাত ৮টার ফেরি ছাড়ল রাত ১১টায়। ততক্ষণে মৃত্যু হয় রোগীর। তিতাস মারা যাওয়ায় ঢাকার দিকে না গিয়ে শিমুলিয়া ঘাট থেকে বাড়ির দিকে অ্যাম্বুলেন্স ঘুরিয়ে দেয়া হয়। এই মৃত্যুর জন্য ওই ভিআইপি ও বিআইডব্লিউটিসির কর্মকর্তারা দায়ী। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানাই।

আরও পড়ুন : পদ্মায় ডুবে শিশুর মৃত্যু

এ বিষয়ে মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক মো. ওয়াহিদুল ইসলাম বলেন, সরকারের এটুআই প্রকল্পের যুগ্ম সচিব আবদুস সবুর মণ্ডল পিরোজপুর থেকে ঢাকা যাচ্ছিলেন। তিনি কাঁঠালবাড়ি ঘাটে যাওয়ার আগে আমার কাছে ফেরিতে যাওয়ার বিষয়টি জানান। পরে আমি ঘাটের ব্যবস্থাপক সালামকে ভিআইপি ফেরিতে ওঠার বিষয়ে বার্তা পাঠাই। কিন্তু ওই ঘাটে অ্যাম্বুলেন্সে একজন গুরুতর আহত অবস্থায় রোগী আছে, তা আমি জানতাম না। ঘাটের ম্যানেজার এ বিষয় আমাকে কিছু জানাননি। রোববার বিষয়টি জানতে পারলাম আমি।

বৃহস্পতিবার রাতে ফেরিঘাটে দায়িত্বে থাকা বিআইডব্লিউটিসির সহকারী ব্যবস্থাপক ফিরোজ হোসেন বলেন, ‘আমি তখন অন্য ঘাটে ছিলাম। খবর পেয়ে ওই অতিরিক্ত সচিবকে ফেরিতে উঠানোর জন্য ঘাটে আসি। রাত ১০টার দিকে সাংবাদিক পরিচয়ে এক ব্যক্তি রোগীবাহী একটি অ্যাম্বুলেন্স ফেরিতে উঠানোর অনুরোধ করেন। সচিবের গাড়ির সঙ্গে রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্সটি রাত ১১টার দিকে ফেরিতে উঠিয়ে দেই। পরে কি হয়েছে তা আমি জানি না।’

একে এম নাসিরুল হক/এএম/এমএস