মাহিন নামে একটা ছেলেকে চিনি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ছুটে বেড়াতে দেখি সারাক্ষণই। কখনো ক্লাসে; কখনো ছোট্ট একটা ব্যবসা নিয়ে। ব্যবসাটা ওর মায়ের হাতে গড়া। ছোট ব্যবসা। কিন্তু মাহিনের স্বপ্ন মায়ের উদ্যোগকে টেনে নিয়ে যাবে বহুদূর। উপায়ও নেই। কারণ এই ব্যবসাতেই চলে ওদের সংসার, নিজের আর ছোট ভাইয়ের লেখাপড়ার খরচ। এই মাহিনকেই এখন বাড়তি টাকা দিতে হবে তার টিউশন ফি`র জন্য। কারণ ওই টিউশন ফিতে ভ্যাট বসিয়েছে সরকার। এমন মাহিনের ছড়াছড়ি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও এদের সংখ্যা অনেক। আসলে লেখাটা সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়। এই লেখা কিছু তরুণের স্বপ্নকে ঘিরে। এই লেখা এই দেশের ভবিষ্যৎ কারিগরদের বর্তমান নিয়ে।পৃথিবীর কোনো সভ্যতায় শিক্ষাকে কখনোই পণ্য হিসেবে দেখা হয়নি। শিক্ষা যদি পণ্য না হয়, যদি ব্যবসার খাত না হয়, তাহলে ভ্যাট দিতে হবে কেন? শিক্ষা যদি মৌলিক অধিকারই হবে, তবে সেই দাবিতে পথে নামলে গুলি চলবে কেন? আমাদের এই দেশে গুলি আর জীবন কি এতই সস্তা? মানবাধিকার কি এতটাই ভূলুষ্ঠিত?জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কোনো এক কর্মকর্তা নাকি তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, "যুক্তিটি এখানেই...যখন সন্তান কোথাও সুযোগ পায় না তখন স্বপ্নে বিভোর অভিভাবক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় খোঁজেন তার স্বপ্ন মেটাতে। আমরা তাঁর এই স্বপ্ন নামক বিলাসিতার ওপর ৭.৫% হারে করারোপ করছি। " ওই কর্মকর্তা কি স্বপ্ন আর বিলাসিতার বিষয়টি পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে তার এই স্ট্যাটাস দিয়েছেন? সন্তানকে নিয়ে সব অভিভাবকেরই স্বপ্ন থাকে। ওই কর্মকর্তারও আছে। কিন্তু অভিভাবকের স্বপ্নকে তিনি কোন যুক্তিতে বিলাসিতা বলছেন? তিনি কি জানেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থীই তাদের শিক্ষাজীবন শেষ করার পরও শুধু টাকার অভাবে তাদের সনদপত্র তুলতে পারছে না? তিনি কি জানেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া সব শিক্ষার্থীর বাবারই ব্যক্তিগত গাড়ি নেই? সেখানকার সব শিক্ষার্থীই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাফেটেরিয়ায় বসে নাস্তা করতে পারে না? অনেককেই রাস্তার পাশের টং দোকানে রুটি-কলা আর চা দিয়েই দুপুরের খাবার সারতে হয়।এনবিআর একটা ব্যাখ্যা দিয়েছে। একই ব্যাখ্যা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রীও। ভ্যাট দেবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ; কোনো অবস্থাতেই শিক্ষার্থীরা নয়। কিন্তু সেই ভ্যাটের টাকা আদায় করতে গিয়ে কর্তৃপক্ষ যে টিউশন ফি বাড়াবে না- তার কি নিশ্চয়তা আছে? এনবিআর নিজে কি বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারবে? বরং এনবিআর কিংবা সরকারের উচিৎ ছিলো, ৭.৫% ভ্যাট আরোপ না করে শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি ৭.৫% কমাতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বাধ্য করা। এতে শিক্ষার্থীদেরই উপকার হতো। কিন্তু এখন পর্যন্ত সরকারের অবস্থান ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেই শিক্ষার্থীদের বিপক্ষে। বলার অপেক্ষা রাখে না- এতে নেতিবাচক প্রভাবই পড়ছে শিক্ষা ক্ষেত্রে। কারণ এই ভ্যাট আরোপের মধ্য দিয়ে সরকার স্পষ্টতই শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণকে বৈধতা দিচ্ছে। সরকার কি শেষ পর্যন্ত শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ নীতির দিকেই এগুচ্ছে?আসলে শিক্ষা বিষয়ে সরকারের নীতিমালা কিংবা নীতিগত অবস্থান নিয়ে ধোঁয়াশা আছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বিশ্ব সাক্ষরতা দিবসের অনুষ্ঠানে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন। জিজ্ঞেস করেছেন, প্রথম শ্রেণিতে কেন ভর্তি পরীক্ষা দিতে হবে? সরকারপ্রধান নিজেই যখন মেয়েদের পাশাপাশি ছেলেদেরও একটি পর্যায় পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষার আওতায় আনার কথা ভাবছেন, সেখানে উল্টো পথে হাঁটছেন অর্থমন্ত্রী। যেকোনো মন্ত্রিসভায় অর্থমন্ত্রীর গুরুত্ব এবং প্রভাব অন্য মন্ত্রীদের চেয়ে বেশি। সরকারের নীতি নির্ধারণেও তার ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। আবুল মাল আবদুল মুহিতের নিজের শিক্ষাজীবন নিয়ে আমরা কমবেশি সবাই জানি। মন্ত্রী হিসেবেও তাঁর অভিজ্ঞতা কম নয়। তিনি না জেনে কিংবা না বুঝে ভ্যাট বসিয়ে দেবেন এটা হতে পারে না। অতিকথনের কারণে তিনি শিক্ষকদের `জ্ঞানের অভাব` আছে টাইপের বক্তব্য দিতে পারেন- এটা মেনে নেয়া যায়। কিন্তু কারণ ছাড়া তিনি শিক্ষার্থীদের ওপর ভ্যাট বসাননি- এটা কিভাবে বিশ্বাস করবো?কারণ যেটাই হোক, শিক্ষার ক্ষেত্রে ভ্যাট নেয়া কোনোভাবেই যৌক্তিক বা নৈতিক হতে পারে না। দক্ষ মানবসম্পদ গঠনে শিক্ষার বিকল্প আজ পর্যন্ত কেউ দিতে পারেনি। এ কারণেই অন্তত শিক্ষার ওপর ভ্যাট আরোপ অন্যায্য। এতে নিশ্চিতভাবেই বাধাগ্রস্ত হবে উচ্চশিক্ষার বিস্তার। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তুলনা করলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা উচ্চ বেতনেই পড়ছে। সেই উচ্চ বেতন থেকেই কিন্তু আয় করছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষগুলো। সেখান থেকে আয়করও পাচ্ছে সরকার। তাহলে শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি`র উপর কেন ভ্যাট বসাতে হবে?ভ্যাট বসানোর এই সিদ্ধান্ত কেবল অযৌক্তিকই নয়, অনাকাঙ্খিতও। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রণীত আইনের সঙ্গে তা সাংঘর্ষিক এবং স্ববিরোধী। ১৯৯২ সালে প্রণীত আইনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে অলাভজনক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। পরে ২০১০ সালে প্রণীত সংশোধনী আইনেও তা বহাল রাখা হয়। এগুলো কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মুনাফা করার স্বার্থে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আসলে হতে পারেও না। যেখানে মুনাফার প্রশ্ন নেই, সেখানে ভ্যাট আরোপের সুযোগ আসে কোত্থেকে? বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কত হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে তা একমাত্র এনবিআরের জানার কথা। যদি হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়, সেটার প্রতি কেন দৃষ্টি দিচ্ছে না সরকার? হাতিয়ে নেয়া অর্থ নিয়ন্ত্রণ করতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর করের বোঝা চাপিয়ে দেয়াতো যৌক্তিক হতে পারে না। যদি সত্যি সত্যিই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ টাকা হাতিয়ে নিয়ে থাকে, তবে তার তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। এনবিআরের ব্যাখ্যা অনুযায়ী ভ্যাট দেবে কর্তৃপক্ষ। সেক্ষেত্রে যদি কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের ওপর থেকে ভ্যাটের টাকা আদায় করে নেয় সেখানেও এনবিআরের হস্তক্ষেপ করা উচিৎ।সরকার তার রাজস্ব বাড়াতে টিউশন ফি`র উপর ভ্যাট বসালো। কিন্তু শিক্ষার মান নিশ্চিতে কি করেছে? দেশে এখন ৮০টির বেশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। এতগুলো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠার ক্ষেত্রটা সরকার নিজেই তৈরি করেছে। ৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যে পরিমাণ আসন আছে তার থেকে কয়েকগুণ বেশি শিক্ষার্থী পাস করছে এইচএসসি পরীক্ষায়। তাদের একটি অংশের সুযোগ হচ্ছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কি শিক্ষার মান সমান? বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পরিবেশ এবং শিক্ষার মানে টক্কর দিচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে। অন্তত চাকরির বাজারে ওই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চাহিদাই এটি প্রমাণ করে। কিন্তু এটি হাতে গোনা কয়েকটি। বেশিরভাগেই মানের বিষয়টি উপেক্ষিত চরমভাবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ন্যূনতম মান বজায় রাখার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এবং সরকার আদৌ কি কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখছে? যদি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা যায় তাহলে উচ্চশিক্ষা নিয়ে অনেক অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি এড়ানো সম্ভব। অভিযোগ আছে, বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি বা ট্রাস্টির লোকজন টাকা সরিয়ে নিচ্ছে। এনবিআর এই বিষয়টি কেন তদারক করছে না? এই তদারকি থাকলেইতো সরকারের আয় বাড়ে। শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি`র ওপর থেকে আর রাজস্ব বাড়ানোর সিদ্ধান্তে যেতে হয় না।ভ্যাট বসিয়ে শিক্ষা খাত থেকে রাজস্ব আদায় বাড়াতে চাইছে সরকার। কিন্তু শিক্ষার মান? এই প্রশ্নে কতটা আগ্রহী সংশ্লিষ্টরা? স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত সত্যিকার অর্থে বাস্তবমুখি কোনো শিক্ষানীতি কি হয়েছে এই দেশে? কর্মমুখি আধুনিক শিক্ষানীতি দিতে পারেনি কোনো সরকার। একটা পর্যায় পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষার ব্যবস্থা করে দেয়া, পঞ্চম শ্রেণি আর অষ্টম শ্রেণিতেও পাবলিব পরীক্ষার মতো পদ্ধতি প্রণয়ন করা, বছর বছর এসএসসি আর এইচএসসিতে জিপিএ-পাঁচের ছড়াছড়ি সার্বিক শিক্ষাকে কতটা যুগোপযোগী করছে? সরকারকে তাই বলবো, শুধু আয় বাড়ানোর পথ না খুঁজে আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় সক্ষম শিক্ষিত প্রজন্ম গড়ে তোলায় মনোযোগটা বাড়ানো হোক। যে প্রজন্মটি কেবল শিক্ষিতই হবে না, বরং হয়ে উঠবে বিশ্বসেরা দক্ষ মানবসম্পদ। আর এই মানবসম্পদ তৈরিতে ভ্যাট না বসিয়ে দরকার হলে প্রণোদনা দেয়া হোক। তবু বেঁচে থাকুক স্বপ্নবাজ এই প্রজন্ম। ভ্যাটের চাপে ওদের স্বপ্ন দেখা যেন বন্ধ হয়ে না যায়। লেখক: বার্তা সম্পাদক, এসএটিভি shahariar@journalist.comএইচআর/এমএস
Advertisement