জাতিসংঘের পলিসি ডিলডারশিপ ক্যাটাগরিতে পরিবেশ পুরস্কার ‘চ্যাম্পিয়ন্স অব দ্য আর্থ’ এর জন্য ভূষিত হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব এহসানুল করিম জাগো নিউজকে টেলিফোনে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে চলতি মাসের শেষ সপ্তাহে নিউইয়র্ক যাবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানেই তিনি এই পুরস্কার আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করতে পারেন।জানা গেছে, বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় তাঁর সুদূরপ্রসারী কর্মকাণ্ডের স্বীকৃতিস্বরূপ এই পুরস্কার প্রদান করা হয়েছে।প্রতিবেশগতভাবে ভঙ্গুর বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট চ্যালেঞ্জ মোকালিয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের সামগ্রিক পদক্ষেপের স্বীকৃতি হচ্ছে এই পুরস্কার।জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির নির্বাহী পরিচালক অচিম স্টেইনার বলেন, ‘বেশ কয়েকটি উদ্ভাবনমূলক নীতিগত পদক্ষেপ এবং বিনিয়োগের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা বাংলাদেশ তার উন্নয়নের মূল প্রতিপাদ্য হিসেবে গ্রহণ করেছে। জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন কার্যক্রম থেকে শুরু করে বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণ আইন প্রণয়ন ইত্যাদি কার্যক্রম গ্রহণের ফলে বাংলাদেশের বর্তমান এবং ভবিষ্যত প্রজন্ম জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি এবং পরিবেশ বিপর্যয়ের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় অনেক বেশি প্রস্তুত।’জলবায়ু পরিবর্তনকে দেশে জাতীয় অগ্রাধিকার ইস্যু এবং একইসঙ্গে এ বিষয়ে বিশ্ব সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণে জোরালো ভূমিকা পালনের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর নেতৃত্ব এবং দূরদৃষ্টি প্রদর্শন করতে সক্ষম হয়েছেন। বিশ্ব নেতৃবৃন্দ কয়েকদিনের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা এবং ডিসেম্বরে প্যারিসে জলবায়ু সম্মেলনের অংশ হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে কর্মসূচি গ্রহণ করতে যাচ্ছেন। জলবায়ু অভিযোজন কর্মসূচির অগ্রগামী বাস্তবায়নকারী এবং অভিযোজন নীতির স্বপক্ষের একজন বলিষ্ঠ প্রবক্তা হিসেবে শেখ হাসিনা অন্যদের জন্য অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত।পুরস্কার সাইটেশনে ‘বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ স্ট্র্যাটিজি অ্যান্ড অ্যাকশন প্লান ২০০৯’ এর উল্লেখ করে বলা হয়েছে বাংলাদেশ বিশ্বের প্রথম উন্নয়নশীল দেশ যেখানে এ ধরণের সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়াও বাংলাদেশ প্রথম দেশ হিসেবে নিজস্ব তহবিল দ্বারা ‘ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ড’ গঠন করেছে। ২০০৯ থেকে ২০১২ পর্যন্ত এ তহবিলে ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।সরকার বর্তমানে বার্ষিক বাজেটের ৬-৭ শতাংশ (যা প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারের সমান) জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন কার্যক্রমের জন্য বরাদ্দ করছে। এর ২৫ শতাংশ আসছে আন্তর্জাতিক সাহায্যদাতাদের কাছ থেকে। একটি ‘ক্লাইমেট চেঞ্জ ফিসক্যাল ফ্রেমওয়ার্ক’ তৈরির কাজ চলছে যাতে জলবায়ু তহবিলের চাহিদা এবং সরবরাহ সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যায়। জলবায়ু পরিবর্তন কোন অতিরিক্ত চাহিদা হিসেবে নয় বরং সরকারের উন্নয়ন সম্ভাবনার কেন্দ্রবিন্দুতে এই প্রথমবারের বিষয়টিকে স্থান দেওয়া হয়েছে।এছাড়া, শেখ হাসিনার নেতৃতে ২০১১ সালে বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধন করা হয়। এই সংশোধনীতে বর্তমান এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য পরিবেশ এবং প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণে রাষ্ট্রকে সাংবিধানিক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সংবিধানে জলাভূমি এবং বণ্যপ্রাণী রক্ষাকে প্রাধিকার দিয়ে শেখ হাসিনার সরকার গৃহীত বন নীতিমালা আবহাওয়ার বেশকিছু চরমভাবাপন্ন অবস্থার প্রতিকার হিসেবে কাজ করছে। পাশাপাশি দেশে বনাঞ্চলের পরিমাণ প্রায় ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত অভিযোজনে বস্তুগত এবং আর্থিক বিনিয়োগ ছাড়াও, সরকার ক্রমবর্ধমান অনিশ্চিত ভবিষ্যত মোকাবিলায় জনগণকে প্রস্তুতি গ্রহণে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। এগুলোর মধ্যে বন্যাজনিত কারণে পানিবাহিত রোগ নিরাময়ে স্বাস্থ্যসেবা, আগাম সতর্কীকরণে কম্যুনিটি দল গঠন এবং পরিবেশ-বান্ধব কৃষি প্রযুক্তিতে উৎসাহ প্রদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে সরকার দূষণমুক্ত নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে বিশ্বের সর্ববৃহৎ সোলার হোম সিস্টেম গড়ে উঠেছে যা গ্রিড বহির্ভূত এলাকার ১০ শতাংশ জনগণের বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাচ্ছে। এছাড়া সরকার দেশের সবচেয়ে বৃহৎ গ্যাস নির্গমন উৎস - ইটভাটা থেকে গ্যাস নির্গমন হ্রাসের পদক্ষেপ নিয়েছে।পরিবেশ, মানবস্বাস্থ্য রক্ষা এবং জীবিকায়নের গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ হিসেবে জাহাজ-ভাঙা শিল্প যাতে উপকূলীয় অঞ্চলে পরিবেশ বিনষ্ট না করতে পারে সেজন্য নতুন আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। জাহাজ ভাঙা শিল্পে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বিপুল সংখ্যক শ্রমিক কাজ করে থাকে।বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক রবার্ট ওয়াটকিনস বলেন, ‘বিশ্বের অন্যতম দুর্যোগপ্রবণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া মোকাবিলার বিষয়টি গুরুত্বসহকারে অনুধাবন করতে পেরেছে। দেশটি ইতোমধ্যেই এর ক্ষতিকর প্রভাবের কুফল ভোগ করছে এবং প্রায়শঃই সবচেয়ে দরিদ্র এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এই বিরূপ প্রভাবের প্রধান শিকার।’তিনি বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে ১৯৯০ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত বাংলাদেশ তার বার্ষিক জিডিপি’র ১ দশমিক ৮ শতাংশ হারিয়েছে। তারপরও এটা স্মরণ রাখা দরকার যে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিরূপ প্রভাব নিরসন শুধু অর্থনীতির প্রশ্ন নয়, বরং তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে জোয়ারের পরিমাণ বৈশ্বিক গড় মাত্রার চেয়ে দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে যা জীবন-জীবিকার উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে এবং মানুষকে বাস্তুহারা করছে।তিনি আরো বলেন, অনুমান করা হচ্ছে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের প্রতি ৭ জনের মধ্যে একজন মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাস্তুহারা হবেন এবং তাঁরা শহরাঞ্চলের দিকে ধাবিত হবেন। দেশের শহরগুলো এখনই অধিক জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলাকে দেশের উন্নয়ন অগ্রাধিকারের তালিকায় স্থান দেওয়ায় আমি বাংলাদেশ সরকারকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। বিশ্ব সম্প্রদায়ের জন্য উদাত্ত আহ্বান হচ্ছে এখনই পদক্ষেপ নিন। জলবায়ু পরিবর্তন যে ভবিষ্যতের কোন সমস্যা নয় এটা আমাদের জীবনকালেই ইতোমধ্যে ঘটে চলেছে।এসএ/এসএইচএস/এআরএস/এমএস
Advertisement