ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিনান্স বিভাগের ছাত্র ফিরোজ কবির স্বাধীন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে উন্নত চিকিৎসার আশায় রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। উন্নত চিকিৎসা পাননি, বরং তার জীবন গেছে। তবে স্বাধীন উন্নত চিকিৎসা না পেলেও, তার স্বজনরা পেয়েছেন অতি উন্নত মানের বিল।
Advertisement
স্কয়ার হাসপাতাল নামের ফাইভ স্টার হোটেলে স্বাধীন বেঁচে থাকতে পেরেছিলেন ২২ ঘণ্টা। আচ্ছা বাংলাদেশের একটি হাসপাতালে একজন রোগী, যার কোনো অপারেশন বা আলাদা কিছু হয়নি, তার বিল সর্বোচ্চ কত হতে পারে? আপনাদের কারো কোনো ধারণা আছে?
লেখাটা পড়া থামিয়ে এক মিনিট কল্পনা করুন। তারপর আপনার কল্পনার সাথে বাস্তবতাকে মিলিয়ে নিন। আমি নিশ্চিত কারো কল্পনাই মেলেনি। আমার কল্পনা বিলের ধারে কাছেও যেতে পারেনি। ২২ ঘণ্টায় স্বাধীনের বিল হয়েছে ১ লাখ ৮৬ হাজার ৪৭৪ টাকা। কিভাবে সম্ভব?
এই প্রশ্নের জবাব দেয়ার মত কেউ নেই স্কয়ার হাসপাতালে। তারা ব্যস্ত রোগীর স্বজনদের পকেট কাটতে। আচ্ছা কমন সেন্স কী বলে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা বারবার পরামর্শ দিচ্ছেন, ডেঙ্গু রোগীদের যেন প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য কোনো ওষুধ দেয়া না হয়।
Advertisement
সাথে প্রচুর তরল খাবার খেতে দিতে হবে। তাতে স্বাধীনকে ২২ ঘণ্টায় ৪ টাকা দামের ৪টি প্যারাসিটামল, বড় জোর কয়েকশ টাকা দামের স্যালাইন দেয়া সম্ভব। কিন্তু তার ওষুধের বিল এসেছে ৩২ হাজার টাকা। এখন যদি কেউ বলে, বেশি ওষুধ দিয়েই স্বাধীনকে মেরে ফেলা হয়েছে, কী বলবেন স্কয়ার কর্তৃপক্ষ?
অবশ্য বলার জন্য তাদের কাউকে পাওয়া যায়নি। স্বাধীনকে একবারও রক্ত দেয়া হয়নি। অথচ ১১ বার রক্তের ক্রস ম্যাচ করার জন্য দাবি করা হয়েছে ১১ হাজার ৫৫০ টাকা। ল্যাবরেটরি চার্জ এসেছে ৭৩ হাজার টাকা। ফিরোজ কবির স্বাধীনের এই বিলটি দেখে বোঝা যায়, দেশটা আসলে মগের মুল্লুকে পরিণত হয়েছে। দেখার কেউ নেই।
স্বাধীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, তার মৃত্যুর খবর পেয়ে ডাকসু জিএস গোলাম রাব্বানীসহ ছাত্রলীগ নেতারা ছুটে গেছেন হাসপাতালে। তাই এ নিয়ে অনেক লেখালেখি। কিন্তু সাধারণ মানুষ হলে, এই প্রতিবাদটুকুও হতো না। আমি জানি না কেউ করবে কিনা, তবে ফিরোজ কবির স্বাধীনের বিলটি নিয়ে জনস্বার্থে একটি রিট হতে পারে। আর স্কয়ার কর্তৃপক্ষ যেহেতু কোনো প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন না। তাই আদালতেরই এই বিলের ব্যাখ্যা চাওয়া উচিত।
শুধু স্কয়ার হাসপাতাল নয়, ডেঙ্গুর আশঙ্কাজনক বিস্তারে বেসরকারি হাসপাতালগুলোর যেন ঈদ লেগেছে। কোথাও সিট খালি নেই, তাই সবকিছুর চার্জ বেড়ে গেছে। সরকারি হাসপাতালগুলোতে কয়েকগুণ করে রোগী ভর্তি আছে। মেঝে-বারান্দাসহ কোথাও পা ফেলার জায়গা নেই।
Advertisement
দুদিন আগে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে গিয়ে চমকে গেলাম। যেন জনসমুদ্র। ভেতরেও সত্যি সত্যি পা ফেলার জায়গা নেই। সরকারি হাসপাতালে জায়গা না পেয়ে অনেকেই ছুটছেন বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে, যেখানে পকেট কাটার সকল ব্যবস্থা রয়েছে।
তবে গবেষণা বলছে, ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা সরকারি হাসপাতালের চেয়ে বেসরকারি হাসপাতালে বেশি। সরকারি হাসপাতালে আরাম কম, চিকিৎসা ভালো। বেসরকারি হাসপাতালে আরাম আছে, তবে চিকিৎসা মেলে না ভালো, মিললেও চড়া দামে।
শুধু বেসরকারি হাসপাতালগুলো নয়, ডেঙ্গু যেন ‘ঈদ’ এনেছে ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে। দিনভর মানুষের লম্বা লাইন। প্রাথমিকভাবে ডেঙ্গু শনাক্তের জন্য ডাক্তাররা তিনটি পরীক্ষা করতে বলেন- প্লাটিলেট কাউন্ট, এনএস১ ও আইজিএম। অনেকেই সন্দেহ থেকেই নিজেরা ডায়ানগস্টিক সেন্টারে গিয়ে পরীক্ষাগুলো করিয়ে নিচ্ছেন। ঢাকার অধিকাংশ ডায়াগনস্টিক সেন্টারেই এই পরীক্ষাগুলো করাতে কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে। উন্নতমানের রি-অ্যাজেন্ট দিয়ে এই তিনটি পরীক্ষা করলেও ডায়াগনস্টকি সেন্টারগুলোর খরচ হবে ৮০০ টাকা।
ডাক্তারদের কমিশন, কর্মচারিদের বেতন-ভাতা অন্যান্য সব মিলিয়ে দেড় হাজার টাকা রাখলেও তাদের লাভ থাকার কথা। কিন্তু ঢাকার কোনো কোনো সেন্টারে সাড়ে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত। আপনি কোনো প্রশ্নও করতে পারবেন না। উত্তর দেয়ার সময় নেই কারো। প্রশ্ন করলেই তারা ডাকবে, নেক্সট। নগরবাসী যেন ফাঁদে আটকে পড়া ইঁদুর।
বেসরকারি হাসপাতালগুলো আর ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো সাধারণ মানুষের পকেট কাটছে। ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর বিলে একটা সমতা থাকা দরকার। এগুলো কি দেখার আসলেই কেউ নেই? খালি লাইসেন্স দিয়েই কি সরকারের দায়িত্ব শেষ? তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে ধন্যবাদ, দেরিতে হলেও তারা ডেঙ্গু পরীক্ষার খরচের সর্বোচ্চ সীমা বেঁধে দিয়েছেন। আশা করি সবাই এটা মেনে চলবেন।
ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও বেসরকারি হাসপাতালের মালিকরাও তো এই দেশেরই নাগরিক। তাদেরও তো সামাজিক দায়িত্ব আছে। ডেঙ্গুর কারণে মশার কারণে মশারি, মশার কয়েলসহ মশা মারার নানান সামগ্রীর চাহিদাও বেড়ে গেছে।
অর্থনীতির নিয়ম হলো, চাহিদা বেড়ে গেলে দাম কমে যায়। কারণ দাম কমিয়েও বিক্রি বেশি হলে লাভের পরিমাণ কমে না। বিশ্বের একমাত্র ব্যতিক্রম বাংলাদেশ, যেখানে চাহিদার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ে দাম। সব দেশে উৎসবের সময় সবচেয়ে বড় ডিসকাউন্ট দেয়। আর বাংলাদেশে ঈদে-পার্বণে জিনিসপত্রের দাম বাড়ে।
আমাদের ব্যবসায়ী, ডাক্তার, হাসপাতাল মালিক সবার প্রতি বিনীত অনুরোধ, জাতির এই দুর্যোগে আপনারা ব্যবসার কথা ভুলে যান, মানবিকতা নিয়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়ান। সবাই মিলেমিশেই এই দুর্যোগ মোকাবেলা করতে হবে।
এইচআর/পিআর