শুক্রবার এলেই কিছু মানুষ ছোটেন বাংলামোটরের দিকে। উদ্দেশ্য বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। আরেকটু বাড়িয়ে বললে ভুল হবে না, আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের কথা শোনা। এদিন সাধারণত বিশ্বসাহিত্য পাঠচক্রে উপস্থিত থাকেন তিনি। আগে সকালে হলেও এখন বিকেলে হয় এই পাঠচক্র। আলোকিত মানুষ সৃষ্টির প্রয়াস আলোর ইশকুলের এ কর্মসূচিতে কয়েকটি ধাপ পেরিয়ে আসতে হয় সবাইকে। শিক্ষার্থী-কর্মজীবী সব ধরনের মানুষ থাকেন এ চক্রে। যারা মননশীলতার চর্চায় আগ্রহী তারাই সুযোগ পান। কেউ কেউ বিনা দাওয়াতের মেহমানের মতোও উপস্থিত থাকেন।
Advertisement
সমবেতভাবে চল্লিশটির বেশি বই পড়ানো হয় এখানে। বাংলা সাহিত্যের সেরা বইগুলোর পাশাপাশি বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম বেশকিছু বইয়ের অনুবাদও থাকে। সাধারণত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষের কবিতা দিয়ে শুরু হয়। ফ্রানৎস কাফকার রূপান্তর, আর্নেস্ট হেমিংওয়ের দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি, রেমার্কের অল কোয়াইট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট, এইচ জি ওয়েলসের অদৃশ্য মানব, বার্ট লুই স্টিভেনসনের ড. জেকিল ও মি. হাইড, অস্কার ওয়াইল্ডের সেরা রূপকথা, কৃষণ চন্দরের গাদ্দার, গালিবের গজল, নাজিম হিকমতের কবিতা, কাহলিল জিবরানের দ্য প্রোফেট, শৃঙ্খলিত প্রমিথিউস, বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবিতা ইত্যাদি অনেক সেরা বই পড়ানো হয়।
প্রতি সপ্তাহে একটি বই নিয়ে আলোচনা হয়। আলোচনা করেন পাঠকরা। কোনো গতানুগতিক ক্লাস নয়- যেন জমজমাট আড্ডা। সেই আড্ডায় অংশ নেন আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ। মূলত এটা তাঁরই পাঠচক্র। প্রতিটি বই সাধারণত এক সপ্তাহের জন্য পড়তে দেয়া হয়ে থাকে। কিছু কিছু বই দুই কিংবা তিন সপ্তাহের জন্য থাকে। যেমন- রবীন্দ্রনাথের গোরা, শিবনাথ শাস্ত্রীর রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ, সৈয়দ মুজতবা আলীর দেশে-বিদেশে, পার্ল এস বাকের গুড আর্থ ইত্যাদি। এজন্য এ পাঠচক্র শেষ হতে এক বছর পেরিয়ে যায়।
বই নিয়ে আলোচনায় অংশ নেন চক্রের সদস্যরা। তাদের প্রত্যেকের আলোচনা তন্ময় হয়ে শোনেন আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ। বয়োজ্যেষ্ঠ এমন শ্রোতার জুড়ি মেলা দায়। বাস্তবিকই এখন আর কেউ অন্যের কথা শোনায় উৎসাহ বোধ করে না। সায়ীদ স্যার আশি বছর পূর্ণ করেছেন। অথচ তাঁর পাঠচক্রের সদস্যদের বেশিরভাগই তরুণ। তাদের কথার নতুনত্বে রীতিমতো মুগ্ধ থাকেন তিনি। অনেক সময় কোনো বক্তার বক্তব্যে দ্বিমত করেন, পাঠকও কোনো কোনো সময় নানা প্রশ্ন তোলেন, সেই প্রশ্নগুলোরও উত্তর দেন।
Advertisement
বাস্তবতা হলো তিনি একজন শিক্ষক। পড়িয়েই ক্ষান্ত নন, শিক্ষকতার পেশা থেকে দাফতরিকভাবে অবসর নিয়েও একটি জাতির মধ্যে বই পাঠের আগ্রহ জাগিয়ে তুলছেন তিনি। তাঁর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রেরই বয়স চল্লিশ পেরিয়েছে। অথচ স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি সবকিছুর গণ্ডি পেরিয়ে নানা পেশাজীবীকে এখনো অনবরত পড়াচ্ছেন তিনি। তরুণ শিক্ষার্থীদের শেখাতেই বেশি আনন্দ পান। মাঝে মাঝে যেন জ্বলে ওঠেন, তখন দ্বীপ্তিময় সূর্যের মতো দ্যূতি ছড়ান। সবাই মুগ্ধ হয়। জ্ঞানপিপাসা মিটে যায় অনেকের। একটা জাতি আসলেই গর্বিত হতে পারে, যে জাতির মধ্যে একজন আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ জীবিত আছেন। একজন জীবন্ত কিংবদন্তী তিনি। যাঁর কথা এখনো মানুষ শোনে। যারা সরাসরি শুনতে পায় না তারা ইন্টারনেটের কল্যাণে ইউটিউবে শোনে। ইউটিউবে তাঁর স্রোতার তালিকাও দীর্ঘ।
আমরা জাতি হিসেবে বড়ই দুর্ভাগা! মাঝে মাঝে স্যারের সোজা কথাকে পেচিয়ে তাকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করি। কিন্তু তাকে তার কাজ থেকে কেউ কখনো পিছু হটাতে পারে না। কারণ, তিনি জানেন- যে যত বড় মহৎ কাজ করবে তার শক্তি তত বেশি আর তাকে তত বড় বড় বিড়ম্বনার শিকার হতে হবে। আজকের ইট, কাঠ, পাথরের বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ভবন দেখে যারা ভাবেন স্যার সারা জীবনে এই একটা বিল্ডিং ছাড়া কিছুই করতে পারেননি তারা বোকার স্বর্গে বাস করেন। সায়ীদ স্যার এই জাতির জন্য একটা মহান প্রতিষ্ঠান বানিয়েছেন। কতটা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে সেই প্রতিষ্ঠানটি আজকের এই ভবন হয়েছে, তা জানতে স্যারের লেখা ‘বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও আমি’ বইটা পড়ে দেখার অনুরোধ করবো।
আর যারা বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ফল খোঁজেন, তাদের বলবো- আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ তাঁর সারাটাজীবন কেবল বীজ বুনে চলেছেন। এই বীজ একদিন চারা হবে, বৃক্ষ হবে, ফলও দেবে। সেই সময়টা চোখে দেখতে হয়তোবা আমাদের মতো অনেকেই পাবে না। অক্সফোর্ডের মতো বিশ্বসেরা প্রতিষ্ঠানগুলোও পৃথিবীর মহান মানবরা একদিনে তৈরি করেননি। জ্ঞানীমাত্রই বোঝেন বুদ্ধিবৃত্তিক কাজের ফল লাভে সময় লাগে অনেকটা। যেখানে আমাদের শিক্ষার উদ্দেশ্য এখনো কেবল অর্থ উপার্জন। নাসায় কাজের থেকে উত্তম বিসিএস অর্জন! এর থেকে বড় কোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারে জাতি হিসেবে আমরা সেটা মানি না! নিজ নিজ পরিবারে খোঁজ নিলে আমরা এ কথার প্রমাণ অতি সহজেই পেয়ে যাবো। তাই সায়ীদ স্যারের প্রতিষ্ঠান নিয়ে হা-হুতাশ করার কিছুই নেই। জাতীয় মানস গঠনে শতবর্ষও সামান্য। যদিও আমরা চাই তড়িৎ ফল। আমাদের দৃষ্টিতে ভালো ছাত্র মানেই উচ্চ বেতনের সম্ভাব্য চাকরিজীবী। এমন চাকরিজীবী বানানোর উদ্দেশ্য নিয়ে অসংখ্য কোচিং সেন্টার থাকতে পারে কিন্তু আলোকিত মানুষ সৃষ্টির প্রতিষ্ঠান বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ছাড়া আর একটিও নেই। নিঃসন্দেহে এটা একটা জাতিরও গর্ব।
আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের নামের শুরুতে ‘আ’ অক্ষর থাকলেও তার মাঝে আমিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না! সংগঠন ও বাঙালিতে তিনি লিখেছেন, ‘আমি অতিরিক্ত কবিতাপাঠের দ্বারা বিনষ্ট মানুষ। আলসেমি আর দায়িত্বহীনতা আমার অস্থিমজ্জায়। এ- জগতে কোনোকিছু না করতে হলে কিংবা বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে দিনরাত আড্ডা দিয়ে উড়িয়ে দিতে পারলে আমি সবচেয়ে সুখী হতাম। কেবল তাই নয়। শিশুকাল থেকে আমি এক জন্মগত অসহায়তার শিকার। শক্তপোক্ত মানুষ বলতে যা বোঝায় আমি ঠিক তার উল্টো। বাজার করা, ঘর গোছানো, সময় ধরে ওষুধ খাওয়া বা নিজের জিনিশপত্রের সামান্য পরিমাণে দেখভাল করা-এমনি যা কিছু একজন মানুষকে এই পৃথিবীতে নিজের বাঁচার জন্য করতে হয় আমি সেটুকুও প্রায় পারি না।’
Advertisement
এতো গেল বই থেকে তুলে আনা আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ। চোখের সামনে তাঁর আচরণ দেখে আরও বিস্মিত হয়েছি। আলোর ইশকুলের মুক্ত আলোচনা পর্বটি থাকে প্রতি শনিবার সন্ধ্যায়। সেখানে নির্ধারিত বিষয়ের উপর একজন বক্তা আলোচনা রাখেন। সামনের সারিতে বসে এমনই একটি বক্তৃতা শুনছিলাম একদিন। হাত একেবারে খালি কোনো কাগজ-কলম নেই। নিজের ভাবখানা এমন; যা বলে সব শুনেই আত্মস্থ করার অভ্যাস তো আজীবনের শিক্ষা! সেই আসরে সায়ীদ স্যার এলেন এবং আমার পাশেই বসলেন, মাঝে একটি ফাঁকা চেয়ারের দূরত্ব। আলোচনা চলছে আমিও মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছি। শ্রোতা পাশে যখন গুরুকে পায় তখন আরেকটু মনোযোগী তো হবেই! এই মুহূর্তে আড়চোখে একটু স্যারের দিকে তাকালাম। যা দেখলাম চোখ কপালে উঠলো। অন্যের আলোচনার কেবল মনোযোগী শ্রোতাই নন স্যার, রীতিমতো তার নোটখাতার কয়েকটা পৃষ্ঠা ভর্তি! নোট নিয়েই চলেছেন তিনি। এই আসরে প্রশ্ন করার সুযোগ থাকে। স্যার মাঝে মাঝে প্রশ্ন করে এটা-ওটা জেনে নেন, সন্দেহ কিংবা কৌতূহল দূর করেন। সেদিন লজ্জিত হয়েছিলাম কিন্তু সংশোধন হইনি! আমার তিরিশ বসন্ত পেরুনো দীর্ঘ অভ্যাস আমাকে অনভ্যস্তই রেখেছে! অথচ স্যার আশিতেও দমছেন না। কেউ যদি স্যারকে জিজ্ঞেস করেন স্যারের নিশ্চয়ই এটা পড়া আছে কিংবা ওটা জানা আছে। সেখানে স্যারের হ্যাঁ কিংবা না বলারও অভ্যাস আছে। কখনো অকপটে বলেন, ‘আমি খুব ভালো পাঠক নই।’
বাঙালি মানস জেনেই বুঝি সায়ীদ স্যার তাঁর সংগঠন ও বাঙালিতে বলেছেন, ‘তরুণ ছেলেমেয়েদের মধ্যে আমি এমন বেশকিছু ছেলেমেয়েকে দেখতে পাই যারা হঠাৎ করে ‘মহৎ-বৃহৎ’ একটা-কিছু করার স্বপ্নে মরিয়া হয়ে ওঠে কিন্তু কিছুদিন কাজের পর তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায় না। ছেলেমেয়েদের বিশজনের উনিশজনেই প্রায় এই দলের। এরা উৎসব পূজারী। শিক্ষাঙ্গনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী, পয়লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস- এমনি ধরনের উৎসবের দিবস পেলে এরা জীবন বাজি রেখে কাজ করে, পাহাড় পর্বত উল্টিয়ে সেগুলোকে সফল করে তোলে। কিন্তু অনুষ্ঠান শেষ হতেই সেই-যে ঘুম দেয় ওঠে তিন মাস পর। এরা একটানা কোনোকিছুতে লেগে থাকতে পারে না।… কিন্তু যা দিয়ে সত্যিকারের মানুষ পাওয়া যায় তা তো উৎসব নয় তা তো কর্মসূচি। কর্মসূচিতে এদের পাওয়া যায় না। কর্মসূচি চলে নিয়মিতভাবে, দীর্ঘকাল ধরে। দুঃসাধ্য ও সাধনা কঠিন এর পথ। মানবজীবনের উচ্চতর স্থিতি ও সমৃদ্ধি গড়ে ওঠে কর্মসূচির ভেতর দিয়ে।’
জীবনকাল কিংবা মৃত্যু সম্পর্কিত কোনো কথা উঠলে স্যার গ্রিক দেবতা অ্যাপোলোর একটা উদাহরণ দেন। প্রেমের দেবতা অ্যাপোলো এক সুন্দরীর পানি প্রার্থনা করলে সেই সুন্দরী একটি পাহাড় দেখিয়ে তার কাছে বর চায়, ওই পাহাড়ে যে পরিমাণ বালুকণা আছে যদি ততদিন পর্যন্ত বাঁচার বর দাও তবে আমি তোমার প্রস্তাবে রাজি। অ্যাপোলো তাকে বর দেয় কিন্তু সেই রমণী দীর্ঘ জীবন পেলেও দীর্ঘ যৌবনের কোনো বর চাইতে ভুলে যায়। তার মানে জীবন দীর্ঘ হলেই হবে না যৌবন ও সামর্থও থাকতে হবে। দীর্ঘদিন বেঁচে থাকলে হয়তো সেই তরুণী পৃথিবীর সবচেয়ে কুৎসিত নারীতেই পরিণত হবে। সায়ীদ স্যারের এই প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত সবাই বোঝে।
স্যার যেন চির তরুণ। এখনো তার সঙ্গে আড্ডা জমাতে পারবেন বাম-ডান-মধ্যম সব পন্থার লোকজন। মানুষ হিসেবে বিচার করলে এই পৃথিবীর অগণিত মানুষের মধ্যে তিনি একজন মানুষই। কর্মের বিচারে পৃথিবীর ওই সকল শ্রেষ্ঠ মানুষের সঙ্গে তাঁর তুলনা চলে, যাঁরা পৃথিবীকে কিছু দিয়েছেন বা দেওয়ার জন্য কাজ করেছেন।
নিজের সমালোচনা শুনে স্যার হেসেই বলেন, রবীন্দ্রনাথের কপাল ভালো তিনি ফেসবুকের যুগ পাননি। পেলে ‘সাত কোটি বাঙালির হে মুগ্ধ জননী রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি।’- এমন কথার জন্য তাঁকেও কম বিড়ম্বনা পোহাতে হতো না।
বাংলাদেশের মানুষ হিসেবে আমাদের সবচেয়ে বড় পাওয়া আমাদের একজন আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ আছেন। একদিন তাঁর স্বাভাবিক শরীরক্ষয় হলেও কর্ম তাকে বাঁচিয়ে রাখবে দীর্ঘকাল। তিনি কেবল একজন মানুষ নন একটি প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশে শান্তিনিকেতন কিংবা বিশ্বভারতী নেই আছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র।
এই কেন্দ্র গতানুগতিক কাজের বাইরে আজও বাংলাদেশের শত শত শিক্ষার্থীকে বইপড়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত রাখছে। গাড়িতে করে বাড়ি বাড়ি কিংবা পাড়া-মহল্লায় পাঠক সৃষ্টি করে যাচ্ছে। সার্টিফিকেটের চাহিদা নেই, জোর জবরদস্তি ছাড়া অনাবিল আনন্দ নিয়ে বই পড়ে যাচ্ছে সবাই। তাই তো আমরা বলি- আমাদের একজন আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ আছেন এবং থাকবেন। কর্মই তাঁকে বহুকাল আমাদের মাথার উপর ছায়ার মতো রাখবে।
লেখক: সাংবাদিক
এসইউ/এমকেএইচ