হুজুগ গতি পেলে এই দেশে অনেক অঘটন ঘটে যেতে দেখেছি। স্বাধীনতার পর পর রাজাকার সন্দেহে গণপিটুনিতে অনেক লোককে মরতে হয়েছে। আমার চাচা বলছিলেন, একবার মতিঝিলে কয়েক লোক এক লোককে দেখে রাজাকার বলে চিৎকার করেছিল। তখন অনেকগুলো লোক তাকে মারা আরম্ভ করে। শেষ পর্যন্ত নাড়িভুঁড়ি বের করে হত্যা করে তারা। অথচ কেউ জিজ্ঞেসও করেনি লোকটা সত্যি সত্যি রাজাকার ছিল কিনা। তখন লোক অপরিচিত জায়গায় চলাফেরা করতেও ভয় পেত। শনাক্ত করা ছাড়া গণপিটুনিতে হত্যাকাণ্ডের ইতিহাস তাই আমাদের নতুন নয়।
Advertisement
আবার স্বাধীনতা বিরোধীরা তখন অরাজগতা সৃষ্টি করে স্বাধীনতাটাকে উপহাসে পরিণত করতে চায়নি- তাও নয়। এমন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা দেশব্যাপী করা হয়েছিল। স্বাধীনতার পরের বছর রোজা আর দুর্গাপূজা একই সময় হয়েছিল। ঠিক রাত আটটার সময় যখন মুসলমানেরা মসজিদে নামাজরত আর হিন্দুরা মণ্ডপে পূজা আরম্ভ করেছে, তখনই স্বাধীনতাবিরোধীরা সুসংঘবদ্ধ হয়ে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত একই সময়ে পরিকল্পিতভাবে পূজামণ্ডপ আক্রমণ করেছিল।
স্বাধীনতা বিরোধীদের এসব কর্মকাণ্ড বঙ্গবন্ধুর সরকার কঠোর হস্তে দমন করেছিল। আবার বঙ্গবন্ধুর সরকার সেই সময়ে সাধারণ ক্ষমার আয়োজনও করেছিল। সরকার একতরফা হলে চলে না। সবাইকে নিয়েই তো দেশ গড়ে তুলতে হয়। আবার সবই যে ষড়যন্ত্র তাও সঠিক নয়। অনেক কর্মকাণ্ড আমরা দেখছি যাকে বাঙালি জাতির সংঘবদ্ধ পাগলামি ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না।
উদাহরণ স্বরূপ পুরণো একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর আবাসিক ছাত্রদের সঙ্গে স্থানীয় যে বসতি রয়েছে তাদের সঙ্গে কোনো সময় সুসম্পর্ক নেই। সব সময় ঝগড়া বিবাদ লেগেই থাকে। অনেক সময় উভয়ের মারামারি থামাতে এমনকি পুলিশের হস্তক্ষেপ জরুরি হয়ে পড়ে। এমন এক মারামারির সময় খুলনা থেকে এক ট্রেন এসে রাজশাহী স্টেশনে পৌঁছে।
Advertisement
উভয় পক্ষ তখন নিজেদের মধ্যে মারামারি বন্ধ করে স্টেশনে অবস্থানরত ট্রেনটি আক্রমণ করে বসে। তখন ট্রেনের ড্রাইভার বগি থেকে ইঞ্জিন খুলে ইঞ্জিন নিয়ে নওগাঁর দিকে চলে যায়। পরে ইত্তেফাক প্রতিনিধি ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করেছিলেন- তিনি ইঞ্জিন নিয়ে চলে গিয়েছিলেন কেন? ড্রাইভার বলেছিলেন, ইঞ্জিনটি বিদেশ থেকে সদ্য আনা হয়েছে। বহু চড়া মূল্যের ইঞ্জিন রক্ষার জন্য তিনি ইঞ্জিন নিয়ে চলে গিয়েছিলেন।
ওই দিনের ঘটনায় বহু যাত্রী হতাহত হয়েছিল। খুলনা উত্তরবঙ্গের ট্রেন চলাচল বিঘ্নিত হয়েছিল। আপনি এই ঘটনাটিকে কি বলবেন? আমি বলছি, বাঙালি জাতির কিছু লোকের সংঘবদ্ধ পাগলামি। আমরা এমন পাগলামি বহু দেখেছি। দেখছি। কয়েক বছর আগে যুদ্ধাপরাধী দেলোয়ার হোসেন সাঈদীকে চাঁদে দেখা গেছে- এটি ছিল জামায়াত শিবিরের একটি পরিকল্পিত প্রচারণা। কিন্তু এই প্রচারণায় যারা গা ভাসিয়েছে তারা কী সবাই জামায়াত শিবির? মোটেও না। এরা হচ্ছে সেই সংঘবদ্ধ পাগল শ্রেণি।
যে দেশের মানুষ সাঈদীর চেহারা চাঁদে দেখা গেছে বিশ্বাস করতে পারে সে দেশের মানুষ নরবলি বিশ্বাস করবে না তাতো হতে পারে না। কারণ নরবলির কেচ্ছা-বাহিনীতো যুগযুগ ধরে চলে এসেছে। এরসঙ্গে প্রচারণায় যুক্ত ছিল কল্লাকাটা এবং ছেলেধরার গুজব। যমুনা সেতুর উদ্বোধনের সময়ও একই রকম শিশুদের কল্লাকাটার গুজব রটেছিল। বলা হয়েছিল ৩০০ শিশুর কল্লা লাগবে- যমুনা সেতু চালু করতে।
এবারও একই কায়দায় গুজব ছড়ানো হয়েছে যে, পদ্মা সেতুতে মানুষ বলি নেবে। প্রচারণা রোধে সরকারের প্রচারযন্ত্রের অদক্ষতা, সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যাপক গুজব- সেটিকে আরও বাড়তে দিয়েছে। রেণু নামের এক মহিলা শিশু কন্যার ভর্তির জন্য স্কুল খুঁজতে গিয়ে রাজধানীর বাড্ডায় এক স্কুলের কয়েকজন অভিভাবকের সন্দেহে পড়ে গণপিটুনিতে মারা গেছেন গত ২০ জুলাই, ২০১৯। তাকে হত্যার ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হলে জাতির বিবেক একটুখানি হলেও নাড়া দিচ্ছে- এ ধরনের অবিবেচক হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে। তারপরও গুজব থামছে বলা যায় না।
Advertisement
২৩ জুলাই ২০১৯ পর্যন্ত সংবাদপত্রের রিপোর্ট অনুসারে দেশের ১৭ জেলায় গণপিটুনিতে নিহত হয়েছে সাত জন। আহত হয়েছে ৩৫ জন, থানায় জিডি হয়েছে ১৫টি আর মামলার সংখ্যা ৯টি। গুজব আর হত্যায় অংশ নেওয়ার জন্য গ্রেফতার হয়েছে ১৮০ জন। বাড্ডায় নারীকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় মূল যুবককে আটক করা হয়েছে। যেসব অভিযোগে এইসব হত্যাকাণ্ড ঘটেছে তার সবকটিই ছিল নিছক গুজব ও ভিত্তিহীন।
আগেই বলেছি নরবলির কেচ্ছা কাহিনী এখানে প্রাচীন। পদ্মা সেতুর নির্মাণের সঙ্গে জড়িত চাইনিজরাও এই বিশ্বাস থেকে দূরে নেই। পত্রিকার রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, ২০১৫ সালের মার্চে চাইনিজ ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের লোকেরা সেতুর কাজ শুরু করার সময় ষাড় জবাই করে তার রক্ত পানিতে ভাসিয়েছে। কিছু গোশতও পানিতে ফেলেছে এবং বাকিটা কর্মচারীদের নিয়ে খেয়েছে।
প্রাচীনকালে বড় কোনো স্থাপনায় নরবলি দেওয়া হতো বলে প্রচারণা আছে। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর উপর নির্মাণ করা কালুরঘাট ব্রিজ এবং পাবনা-কুষ্টিয়ার মাঝখানে পদ্মা নদীর উপর হার্ডিং ব্রিজের নির্মাণকালে (সম্ভবত ১৯১৫ সালে) নরবলি দেওয়া হয়েছিল বলে একটা কথা প্রচারিত হয়েছে। ব্রিটিশ জাতি রেকর্ড সংরক্ষণের খুবই দক্ষ হলেও এসবের কিন্তু কোনো রেকর্ড নেই।
বাস্তবতা হচ্ছে তখন সমাজে প্রাধান্য ছিল হিন্দুদের। বলি প্রথা হিন্দুদের ধর্মীয় ধারণা। বড় স্থাপনায় নরবলির প্রয়োজন এটা হয়তো হিন্দুরা বিশ্বাস করত এবং এই বিশ্বাসের কারণেই হয়তো এসব কথা এই ভূখণ্ডে প্রচারণা হয়েছে। চট্টগ্রামের কালুরঘাট ব্রিজ বা পাকশির হার্ডিঞ্জ ব্রিজ নির্মাণে কোনো নরবলির যে প্রয়োজন হয়নি তার কারণ হিসেবে বলতে পারি সাম্প্রতিককালে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের পাশে আরেকটি সেতু হয়েছে। আবার কালুরঘাট ব্রিজের দক্ষিণ পাশে আরও দুটি সেতু হয়েছে। কোনোটাতেই নরবলির প্রয়োজন হয়নি। তাহলে ১৯১৫ সালে প্রয়োজন হবে কেন!
এখন তো বড় বড় সব নদীর উপর ব্রিজ হয়েছে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ব্রিজ হচ্ছে যমুনা ব্রিজ। সেখানে তো কোনো নরবলির প্রয়োজন হয়েছে প্রমাণিত হয়নি। সিলেটের সুরমা নদীর উপর ব্রিজ হয়েছে, ভৈরব নদীর উপর ব্রিজ হয়েছে, খুলনায় পশুর নদীর উপর ব্রিজ হয়েছে- কোনখানেই নরবলির প্রয়োজন হয়নি। পদ্মা সেতুতে নরবলির প্রয়োজন হবে কোন কারণে! এটি একটি অহেতুক গুজব। ফালতু বিশ্বাস।
ইতিহাসে দেখা যায় নরবলি প্রথা উচ্ছেদ করেছে মুসলমানেরা। দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু মিশর বিজয় করে গভর্নর নিযুক্ত করেছিলেন আমর ইবনুল আস (রাঃ) কে। ফসলের মৌসুম যখন আসলো তখন মিশরের সম্ভ্রান্ত লোকেরা এসে গভর্নরের সঙ্গে দেখা করলেন এবং তাদের রীতি প্রথার কথা বললেন। তারা বললেন, এখন তো নীল নদের পানি নেই। ফসলের মৌসুম আসলে নীল নদে দুটি নরবলি দিতে হয়। তখন নীল নদ ভর্তি হয়ে পানি আসবে। গভর্নরকে নরবলির ব্যবস্থা করতে তারা অনুরোধ করলেন। গভর্নর বললেন, খলিফার অনুমতি লাগবে। আমি খলিফার কাছে সবিস্তারে লিখে পাঠাচ্ছি। দেখি খলিফা কি করেন।
খলিফা ওমর রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু দূত মারফত গভর্নরকে জানালেন যে নীল নদের পানি না আসলেও নরবলি দেয়া যাবে না। তবে আমি নীল নদকে একটা চিঠি দিলাম তুমি চিঠিটি নদীবক্ষে নিক্ষেপ করো। দেখো কি হয়। খলিফা চিঠি লিখেছিলেন- হে নীল, তুমি আল্লাহর হুকুমে প্রবাহিত হও। আমার চিঠি তোমার বক্ষের নিক্ষিপ্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তুমি প্রবাহিত হতে শুরু করবে।
তাই হয়েছিল। নরবলির প্রয়োজন হয়নি। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ আল্লাহতে সমর্পিত। সে কারণে পদ্মা সেতুতে কোনো নরবলি লাগবে এটা বিশ্বাস করাও তাদের জন্য গুনাহের কাজ হবে। যারা এই কাজ করছে তাদেরকে বলবো, এই জনপদে আপনারা উপদ্রব সৃষ্টি করে শান্তি নষ্ট করবেন না। আল্লাহ শান্তি নষ্ট কারীদেরকে পছন্দ করেন না। প্রশাসনকে বলবো, যারা পদ্মায় নরবলির নামে গণপিটুনিতে মানুষ হত্যা করছে তাদেরকে শক্ত হাতে প্রতিরোধ করুন। জাতি হিসেবে আমরা এখন বহু আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের মধ্যে আছি। দল- মত, ধর্ম-জাত নির্বিশেষে আজ আমাদের জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজন। ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বাধীনতা এনেছি, উদ্বুদ্ধ হয়ে সেই স্বাধীনতা রক্ষা করতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।anisalamgir@gmail.com
এইচআর/জেআইএম