মতামত

প্রিয়া সাহার বক্তব্য, মৌলবাদ ও বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা

সম্প্রতি ইউএসএ প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে সাক্ষাতে প্রিয়া সাহা নামে একজন বাংলাদেশির দেয়া বক্তব্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও সরকারে যে তোলপাড় হয়ে গেলো তাতে মৌলবাদীদের শক্তি, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাহীনতা ও রাজনৈতিক ব্যক্তিস্বার্থে গোষ্ঠীকে ব্যবহারের বিষয়টি আরো একবার পরিষ্কার হলো।

Advertisement

প্রথমেই বলে নেয়া ভালো প্রিয়া সাহা কেন তার সংগঠন 'হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান পরিষদে'র সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নিজ উদ্যেগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সাথে দেখা করেছেন এবং সরকারকে এড়িয়ে গিয়ে কৌশলে মৌলবাদীদের দোষারোপ করে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের রক্ষার জন্য ট্রাম্পের কাছে আকুতি জানিয়েছেন তা এখনো পর্যন্ত দেশের মানুষের কাছে পরিষ্কার নয়। অভিজ্ঞদের মধ্যে কেউ বলছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজতান্ত্রিক রাজনীতি করা প্রিয়া সাহা গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোয়ন বঞ্চিত হয়ে সরকারকে একহাত নিচ্ছেন, কেউ বলছেন মেয়েরা সেখানে পড়ছে বলে তিনি নাগরিকত্বের লোভে সংখ্যালঘু হিসেবে বিষয়টি ব্যবহার করেছেন, আবার তার এনজিওর জন্য বরাদ্দ বাড়ানোর চেষ্টাও বলছেন কেউ কেউ। যদিও তিনি ভিডিও বার্তায় ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন যে উনি সরকারের মৌলবাদ বিরোধী যে অভিযান তাতে সহায়তা করার জন্যই ট্রাম্পকে দেশের সংখ্যালঘুদের দুরাবস্থার কথা জানিয়েছেন। সেটি খুব একটা গ্রহণযোগ্য নয় এবং আমি প্রিয়া সাহার ব্যাখ্যাটি বিভিন্ন কারণে প্রত্যাখ্যান করছি।

এক, তিনি জেনে বুঝে মৌলবাদীদের হাতে তার বক্তব্য তুলে দিয়েছেন যা শুধু সরকারকে বেকায়দায় ফেলেনি, দেশের প্রায় দেড় কোটি সংখ্যালঘু হিন্দু জনগোষ্ঠিকে ভয়ঙ্কর ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে ঠিক যখন একটি গোষ্ঠি চট্টগ্রামে কয়েকটি স্কুলে ইস্কন অনুসারীদের প্রসাদ বিতরণের ঘটনা নিয়ে গুজব ছড়িয়ে উত্তেজনা তৈরি করেছে। এর মাধ্যমে তিনি মূলত সরকার এবং সংখ্যালঘুদের এই বার্তা দিলেন যে তাদের অধিকার দেখভাল করার মতো দেশে কেউ নেই।

মৌলবাদীরা প্রিয়া সাহার আরোপ করা নিজেদের দোষ ঢাকার জন্য সুযোগটি কাজে লাগলো দুই ভাবে; এক, সরকারকে দেখালো আওয়ামী লীগের ভোটব্যাংক হিন্দুদের আর হাসিনা সরকারের ওপর আস্থা নেই; দুই, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানকে তথ্য বিকৃতি করে বোঝালো প্রিয়া সাহা সকল মুসলমানকেই অত্যাচারী বলেছেন! প্রিয়া সাহার না জানার কথা নয় বাংলাদেশে মৌলবাদিরা গুজব ছড়িয়ে গত দেড় দশকে কি কি করেছে এবং তার এই বক্তব্যের জেরে কয়েক ঘন্টার মধ্যে কি হতে পারে। সরকারের সামান্য অসর্তকতায় ঘটে যেতে পারতো অনেক বড় বিপদ।

Advertisement

যা হবার তাই হয়েছে, আমাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনা আরেকবার মৌলবাদীদের কৌশলের কাছে হেরে গেলো এবং আমরা যারা প্রগতিশীল বলে নিজেদের দাবি করি তারা প্রায় সবাই ভীষণ আপত্তিকর ভাষায় সমগ্র হিন্দু সমাজকে আক্রমণ করে বাঁশের কেল্লার তৈরি করে দেয়া ভিডিওটি ও ইনকিলাবের তৈরি করা দেশের ভাবমূর্তি নষ্টের বক্তব্যের ব্যাপক প্রচার করে নিজেদের মধ্যে অবিশ্বাস ও দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করেছি। মোদ্দা কথা, মৌলবাদীরা এবার প্রিয়া সাহার ঘাড়ে বন্ধুক রেখে আওয়ামী লীগ ও হিন্দুদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিলো। অথচ, এই দুই পক্ষের আস্থার জায়গাটি অনেক পুরোনো ও পরীক্ষিত ছিল!

দুই, তিনি মুখে বলছেন সংখ্যালঘুদের ভালোর জন্য বলেছেন কারণ তিনি নিজে ২০০৪ সালে মৌলবাদীদের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। কিন্তু 'হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান পরিষদের' সাথে ওনার সমঝোতা নেই কেন? কেন উনি ভুল তথ্য উপাত্ত ও মিথ্যা রেফারেন্স দিয়ে ইউএসের মতো এতো গুরুত্বপূর্ণ একটি প্লাটফর্মে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের হয়ে কথা বলবেন? মিথ্যা পদবি ব্যবহার করে কি তিনি আমাদের প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন?

সংখ্যালঘুদের সাথে এই প্রতারণা করে, তাদের উন্নয়নের নামে একটি এনজিও পরিচালনা করে, একটি পত্রিকার সম্পাদক হয়ে তিনি তাদের কি কি কল্যাণ করলেন? দেশে তো ওনার কোনো তৎপরতাই আমি দেখিনি। গত দুই দশকে নাসিরনগর থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতায় প্রিয়া সাহার নাম বা বক্তব্য কেন কোথাও পেলাম না? তিনি কি ভেবেছেন এইরকম বিতর্কিত অবস্থা তৈরি করে এবং আলোচিত হয়ে তিনি পরবর্তীতে নির্বাচনে বা সংখ্যালঘুদের নেতৃত্বে আসার পথ তৈরি করবেন?

তিন, এই ঘটনায় শুরুর দিকে প্রিয়া সাহা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সমালোচনার স্বীকার হলেও পরবর্তীতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সম্প্রদায়িক আক্রমণের মুখে তারা তার জন্য সহমর্মিতা দেখতে শুরু করেন। অনেকেই বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন প্রক্রিয়াটি বিতর্কিত হলেও প্রিয়া সাহা সংখ্যালঘুদের জন্য ভালো করেছেন কেননা গত ক'টি টার্মেই দেশে নিয়মিতভাবে বা নির্বাচন পরবর্তী যেসব সংখ্যালঘু নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে তা দমনে বর্তমান সরকারের উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকা ছিল না।

Advertisement

এতে পুরো সম্প্রদায় কিছুটা হতাশই ছিল; যদিও আস্থা হারিয়ে বিদেশে অভিযোগ করার মতো মানসিকতা ছিল না। আমি বিশ্বাস করি দেশের দেড় কোটি হিন্দু জনগোষ্ঠী এখনো আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর আস্থা রাখেন এবং মৌলবাদীদের স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে প্রিয়া সাহার মতো যারা ক্ষমতা ও সুযোগ ব্যবহার করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে ঝুঁকির মুখে পতিত করেন তাদের ব্যাপারে প্রগতিশীল সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু - দুই সম্প্রদায়কেই সচেতন থাকতে হবে।

পরিশেষে, মন্দের ভালো বিষয়টি হলো এই ঘটনায় সংখ্যালঘু নির্যাতনের পরিসংখ্যানের সাথে সাথে সরকারের দায়িত্ব ও সামাজিক সচেতনতার বিষয়টি সামনে এসেছে। একইসাথে 'হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদে'র ভূমিকা ও কার্যকরিতাও নতুন করে আলোচনায় এসেছে। শুধু সাংগঠনিক কার্যক্রমের মধ্যে সীমাবদ্ধ সংগঠনগুলির নেতৃবৃন্দকে নতুন করে ভাবতে হবে কিভাবে সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় কার্যকরী ভূমিকা রাখতে হবে যেন তাদের তৃতীয় কোনো শক্তি বা ব্যক্তির ওপর ভরসা করতে না হয়। কোনো মৌলবাদী শক্তি যেন সরকার ও নেতৃবৃন্দের সামান্য দুর্বলতার সুযোগে সমাজে বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে না পারে। লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

এইচআর/এমকেএইচ