অর্থনীতি

ন্যূনতম মূলধনই নেই, গ্রাহকের টাকা দেবে কোথা থেকে?

>> সংকটেও সহযোগী প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়েছে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং>> লিজ, ঋণ ও অগ্রিমের ক্ষেত্রে খেলাপি বেড়েছে ২ দশমিক ১১ শতাংশ>> সঞ্চিতি ঘাটতি রয়েছে ২৫২ কোটি ৪৭ লাখ ৮৫ হাজার ৮১২ টাকা

Advertisement

সংকটে পড়েছে পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড। তারল্য সংকটের কারণে কোম্পানিটি গ্রাহকের অর্থ পরিশোধ করতে পারছে না। আইন অনুযায়ী কোম্পানিটির ন্যূনতম যে মূলধন থাকার কথা, তাও নেই।

বেড়েছে খেলাপি ঋণ। সঞ্চিতি ঘাটতিতেও পড়েছে কোম্পানিটি। যে পরিমাণ ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও (সিআরআর) থাকার কথা তাও নেই। এমন সংকটের মধ্যেও আইন লঙ্ঘন করে সহযোগী প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়েছে কোম্পানিটি। প্রতিষ্ঠানটির নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

আরও পড়ুন > ছয়-নয় সুদহার নিয়ে নয়-ছয় বললেন এমডিরা

Advertisement

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস দীর্ঘ মেয়াদে সম্পদ অর্থায়নের জন্য স্বল্প মেয়াদের ঋণের ওপর অত্যধিক নির্ভর ছিল। কোম্পানিটির এমন আচরণের ওপর আপত্তি জানিয়েছেন নিরীক্ষক।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর শেষে কোম্পানিটির অপারেটিং ক্যাশ ফ্লো বা পরিচালন নগদ প্রবাহ ঋণাত্মক অবস্থায় রয়েছে। তারল্য সংকটের কারণে কিছু আমানতকারী ও ঋণদাতার টাকা পরিশোধ করতে পারছে না কোম্পানিটি।

আর্থিক খাতের এ প্রতিষ্ঠানের লিজ, ঋণ ও অগ্রিমের বিপরীতে খেলাপির চিত্র নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন নিরীক্ষক। সেই সঙ্গে লিজ, ঋণ ও অগ্রিমের বিপরীতে রাখা সঞ্চিত নিয়েও আপত্তি জানানো হয়েছে। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, কোম্পানিটির লিজ, ঋণ ও অগ্রিমের ক্ষেত্রে খেলাপি বেড়েছে ২ দশমিক ১১ শতাংশ।

লিজ, ঋণ ও অগ্রিমের বিপরীতে সঞ্চিতি রাখার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের (এফআইডি) ২০০২ সালের প্রজ্ঞাপনের কথা উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের লিজ, ঋণ ও অগ্রিমের বিপরীতে সঞ্চিতি ঘাটতি রয়েছে ২৫২ কোটি ৪৭ লাখ ৮৫ হাজার ৮১২ টাকা।

Advertisement

আরও পড়ুন > যোগ্যতা নেই, তবুও ‘বিশেষ ব্যবস্থায়’ তালিকাভুক্তি

এফআইডি’র প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, খেলাপির কারণে কোম্পানিটির লিজ, ঋণ ও অগ্রিমের বিপরীতে ২৫৮ কোটি ৪৩ লাখ ৭০ হাজার ৬৬৫ টাকা সঞ্চিতি রাখার কথা। কিন্তু সঞ্চিতি রাখা হয়েছে পাঁচ কোটি ৯৫ লাখ ৮৪ হাজার ৮৫৩ টাকা। অর্থাৎ লিজ, ঋণ ও অগ্রিমের বিপরীতে সঞ্চিতি ঘাটতি রয়েছে ২৫২ কোটি ৪৭ লাখ ৮৫ হাজার ৮১২ টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও (সিআরআর) রাখার ক্ষেত্রেও কোম্পানিটি অনিয়ম করেছে। মোট টার্ম ডিপোজিটের (দীর্ঘ মেয়াদের আমানত) বিপরীতে নিয়ম অনুযায়ী যে পরিমাণ সিআরআর থাকতে হয় কোম্পানিটির তার থেকে ৯৮ শতাংশ কম রয়েছে।

এ বিষয়ে নিরীক্ষক অভিমত দিয়েছেন, মোট টার্ম ডিপোজিটের ২ দশমিক ৫ শতাংশ সিআরআর হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা রাখতে হয়। সে হিসাবে ১২৫৭ কোটি ৮৩ লাখ ৬৬ হাজার ৯৯ টাকার টার্ম ডিপোজিটের বিপরীতে সিআরআর থাকার কথা ৩১ কোটি ৪৪ লাখ ৫৯ হাজার ১৫২ টাকা। কিন্তু কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পর্ষদ জানিয়েছে, সিআরআর আছে ৬৩ লাখ ৪৯ হাজার ৪৫৩ টাকা। অর্থাৎ কোম্পানিটির যে সিআরআর থাকার কথা তার থেকে ৯৮ শতাংশ কম রয়েছে।

১৯৯৪ সালের আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগ (ডিএফআইএম)- এর নির্দেশনা অনুযায়ী, কোম্পানিটির মিনিমাম ক্যাপিটাল রিকয়ারমেন্ট (ন্যূনতম মূলধন প্রয়োজনীয়তা) থাকার কথা ৪০৪ কোটি ৯৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৬৪ টাকা। কিন্তু কোম্পানির মূলধন আছে ৩২০ কোটি ২৮ লাখ ৯৩ হাজার ৪৯০ টাকা। অর্থাৎ ৮৪ কোটি ৬৫ লাখ ৭১ হাজার ৭৪ টাকা বা ২১ শতাংশ মূলধন ঘাটতিতে রয়েছে কোম্পানিটি।

কোম্পানিটি তার সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল লিজিং সিকিউরিটিজ লিমিটেডকে আইন লঙ্ঘন করে ঋণ দিয়েছে বলেও প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং সিকিউরিটিজ লিমিটেডকে ২২৮ কোটি ৩৯ লাখ ৯৯ হাজার ৬৫৯ টাকা ঋণ দেয়া হয়েছে, যা ২০১৮ সালে কোম্পানিটির বিতরণ করা মোট ঋণের ৮৩ শতাংশ। অথচ আইন অনুযায়ী, একক ব্যক্তি বা গ্রুপকে ৩০ শতাংশের বেশি ঋণ দেয়া যায় না।

আরও পড়ুন > দুশ্চিন্তায় পিপলস লিজিংয়ের ৬ হাজার আমানতকারী

যোগাযোগ করা হলে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও কোম্পানিটির প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) সৈয়দ আবেদন হাসান জাগো নিউজকে বলেন, তারল্য সংকটের কারণে গ্রাহকের অর্থ পরিশোধ করতে না পারা, মূলধন ঘাটতি, খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়া, সঞ্চিতি ঘাটতি, পর্যাপ্ত ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও না থাকার যে তথ্য উঠে এসেছে তা সত্য।

‘আসলে ওভারঅল (সর্বোপরি) মার্কেটের অবস্থা ভালো না। ব্যাংক থেকে আমরা ফ্রেস ফান্ড পাচ্ছি না। এজন্য আমাদের তারল্যের সমস্যা হচ্ছে। তবে আমরা স্বল্প মেয়াদের যেসব ঋণ দিয়েছি, তা আদায়ে জোরালো চেষ্টা চলছে। আশা করছি, ডিসেম্বরের মধ্যে একটা পজেটিভ প্রভাব পড়বে’- বলেন আবেদন হাসান।

এমএএস/এমএআর/জেআইএম