রাজধানীসহ সারাদেশে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগের ভয়াবহ বিস্তার হলেও উপযুক্ত উপায়ে ডেঙ্গু রোগীর তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ এবং রোগের গতি-প্রকৃতি নিয়ে গবেষণা হচ্ছে না।
Advertisement
রোগতত্ত্ব ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিগত কয়েক বছরের তুলনায় চলতি বছর ডেঙ্গুর ধরন ও ভয়াবহতা অনেক বেশি। এ কারণে হাসপাতালে নিশ্চিত ডেঙ্গু রোগ নিয়ে যারা ভর্তি হচ্ছেন তাদের ক্লিনিক্যাল নমুনা ও উপসর্গ কী ধরনের, ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার ফলে তাদের কোন কোন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ (কিডনি, লিভার, হার্ট, উচ্চ রক্তচাপ) কতটুকু সময়ের মধ্যে কী ধরনের ক্ষতি হচ্ছে, রক্তে প্লাটিলেটের পরিমাণ কত, আগের ক্লিনিক্যাল গাইড লাইন অনুযায়ী চিকিৎসা প্রদান করে উন্নতি হচ্ছে কি-না, ইত্যাদি সম্পর্কে প্রতিটি রোগীর তথ্য-উপাত্ত সঠিকভাবে সংগ্রহ, সংরক্ষণ এবং তা নিয়ে ব্যাপকভাবে তথ্যভিত্তিক গবেষণা করা প্রয়োজন।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, হাসপাতাল থেকে হালনাগাদ তথ্য-উপাত্ত সঠিক উপায়ে সংগ্রহ এবং তা নিয়ে গবেষণা হচ্ছে না। ফলে প্রথমদিন থেকেই রোগীকে কী ধরনের চিকিৎসা দিতে হবে- সে সম্পর্কে চিকিৎসকরা ভালোভাবে অবহিত নন। এছাড়া নিয়মিত তথ্য পাঠানোর ক্ষেত্রে বহু হাসপাতালের অবহেলা ও গাফিলতির কারণে ডেঙ্গুর প্রকোপ ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়ছে বলে তারা মন্তব্য করেন।
রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে গতকাল পর্যন্ত (১ জানুয়ারি থেকে ২২ জুলাই) সাত হাজারের বেশি রোগী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে শুধুমাত্র চলতি জুলাই মাসেই হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা পাঁচ সহস্রাধিক।
Advertisement
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডেঙ্গুসহ যেকোনো রোগের গতি-প্রকৃতি পরিবর্তন ও প্রকোপ দেখা দিলে তা দেখভালের দায়িত্ব স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর)। মূলত এ প্রতিষ্ঠানই দেশের যেকোনো প্রান্তে নতুন কোনো রোগব্যধি দেখা দিলে কিংবা পরিচিত কোনো রোগের প্রকোপ দেখা দিলে সেখানে সরেজমিন পরিদর্শন করে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ এবং সংগৃহীত নমুনা তাদের ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে রোগটির প্রকৃত কারণ সম্পর্কে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, অধিদফতর ও গণমাধ্যমকে অবহিত করেন।
অভিযোগ রয়েছে, চলতি বছর ডেঙ্গুর মারাত্মক প্রকোপ দেখা দিলেও আইইডিসিআর ধীরগতিতে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছে! এখন পর্যন্ত সাত হাজারেরও বেশি কনফার্ম ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হলেও তাদের সকলের তথ্য-উপাত্ত তারা সংগ্রহ করতে পারেনি। এক্ষেত্রে হাসপাতাল ও তাদের মধ্যে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের সমন্বয় নেই। শুধু আক্রান্তই নয়, চলতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে কমপক্ষে ২৫/২৭ জনের মৃত্যু হলেও আইইডিসিআরের হিসাবে মাত্র পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়েও খোদ স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আইইডিসিআরের সমালোচনা করছেন।
অবশ্য আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, কোনো হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী মারা গেছে, এমন খবর পেলে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে ডেথ রিভিউ কমিটিতে পর্যালোচনার পর নিশ্চিত হলে তবেই ডেঙ্গুতে মারা গেছে বলে অফিসিয়ালি ঘোষণা দেয়া হয়। এর আগে কেউ বললে তা গ্রহণযোগ্য হবে না।
চলতি বছর হাসপাতালে সাত হাজারেরও বেশি কনফার্ম ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন, তাদের কতজনের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছেন কিংবা কোন ধরনের ডেঙ্গুতে তারা আক্রান্ত হয়েছেন- এ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি কোনো সংখ্যা উল্লেখ করতে রাজি হননি। তবে তিনি বলেন, তারা ডেঙ্গুর প্যাটার্ন নিয়ে কাজ করছেন। এখন তা চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।
Advertisement
অধ্যাপক ফ্লোরা বলেন, ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে- এ কথা সত্যি। কিন্তু দেশের জনসংখ্যার অনুপাতে তা খুব বেশি নয়। তবে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত বা মৃত্যু কারও কাম্য নয় বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
বর্তমানে ডেঙ্গুর পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে আইইডিসিআরের সাবেক পরিচালক রোগতত্ত্ববিদ ড. মাহমুদুর রহমান বলেন, পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশন চ্যানেল দেখে এবং ব্যক্তিগতভাবে খোঁজখবর নিয়ে যতটুকু জানতে পেরেছি তা হলো, গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ও ভয়াবহতা বেশি। আগে যেমন ডেঙ্গু হলে ৩/৪ দিন পর থেকে গায়ে র্যাশ উঠা, দাত দিয়ে রক্তপড়াসহ কিছু নমুনা বোঝা যেত। কিন্তু গত বছর থেকে ডেঙ্গুর নতুন প্যাটার্নের কারণে রোগী দ্রুত কোমায় পর্যন্ত চলে যাচ্ছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে সকল সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের কেইস হিস্ট্রি সংগ্রহ করে, গবেষণা করে কী ধরনের ডেঙ্গু (স্ট্রেইন বা সেরো টাইপ), এতে চিকিৎসা কী হবে তা নিয়ে গবেষণা হওয়া উচিত।
তবে জ্বর হলে ঘরে বসে না থেকে রোগীকে নিয়ে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দেন ড. রহমান।
এমইউ/এমএস