তিনদিন ধরে জ্বরে ভুগছিল শিশু নুসরাত জাহান রিয়া (৫)। সোমবার (২২ জুলাই) শ্যামলীর ঢাকা শিশু হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ডেঙ্গু ধরা পড়ে। মেয়েকে নিয়ে দুশ্চিন্তার মধ্যেই বড় ছেলে সানি (৯) ও বৃদ্ধা মাও ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হন। পরিবারের তিনজনের ডেঙ্গু ধরা পড়ায় বিপাকে পড়ে নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারটি।
Advertisement
মঙ্গলবার (২৩ জুলাই) দুপুরে ঢাকা শিশু হাসপাতালের ৭নং ওয়ার্ডের ১০নং বেডে ভর্তি রিয়ার বাবা রবিউল ইসলাম বলেন, মেয়ের জ্বর ছিল নিয়ন্ত্রণের বাইরে। জ্বরের সাথে খিঁচুনি, রক্ত বমি ও নাক মুখ দিয়ে রক্ত আসে। ডাক্তাররা রাতে মেয়ের পালস পাচ্ছিলেন না। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানা গেল, ডেঙ্গু হয়েছে। রক্তের প্লাটিলেট কমেছে। ডাক্তাররা এখন চিকিৎসা করছেন।
রাজধানীর মাদারটেকের বাসিন্দা রবিউল ইসলাম। পেশায় গাড়িচালক, থাকেন ভাড়া বাসায়। তিনি বলেন, ‘সিটি কর্পোরেশনের মশা মারার লোকজন পাড়ায় ও গলিতে ধোঁয়া (ওষুধ) দিয়ে চলে যায়। বাসার নিচে কিংবা ছাদে কেউ আসে না। আজ আমাগো পরিবারের তিনজনের ডেঙ্গু জ্বর। মেয়েকে ভর্তি করছি। ছেলেকেও আজ ভর্তি করাতে হচ্ছে। এখন বৃদ্ধা মাকে নিয়ে বিপাকে আছি। আমাদের অবস্থা কি সিটি কর্পোরেশনের মেয়র বুঝবেন? আমাদের যে কী জ্বালা, ড্রাইভার হিসেবে আমার কতই-বা আয়! কী এক মশায় আজ পুরো পরিবার হাসপাতালে!’
শুধু রিয়া কিংবা সানি নয়, মঙ্গলবার পর্যন্ত ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত ৬৫ শিশু ঢাকা শিশু হাসপাতালে ভর্তি। একই পরিবারের একাধিক শিশুও হাসপাতালটিতে চিকিৎসাধীন।
Advertisement
ঢাকা শিশু হাসপাতালের জনসংযোগ কর্মকর্তা আব্দুল হাকিম জাগো নিউজকে বলেন, এ বছর এখন পর্যন্ত ২২৮ শিশু ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছে। এখনও ৬৫ শিশু ভর্তি আছে। গতকাল সোমবার ১৬ শিশু ভর্তি হয়।
তিনি আরও বলেন, মে মাসের শেষ সময় থেকে হাসপাতালে বাড়তে থাকে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। জুলাইয়ে এসে রোগীর সংখ্যা আরও বেড়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মনিটরিং ও হাসপাতালের নিবিড় তত্ত্বাবধানে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা চলছে। এখানে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য আলাদা ডেঙ্গু সেল এবং নিবিড় চিকিৎসার জন্য আলাদা চিকিৎসক টিম গঠন করা হয়েছে।
হাসপাতাল সূত্রে আরও জানা গেছে, এখানে ছয় রোগীর অবস্থা ক্রিটিক্যাল হওয়ায় ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। এছাড়া ১০ বেডবিশিষ্ট আলাদা ডেঙ্গু সেলে ১০ শিশু ভর্তি রয়েছে। বাকি শিশুদের বিভিন্ন ওয়ার্ডে ও কেবিনে ভর্তি রাখা হয়েছে।
হাসপাতালটির ৭নং ওয়ার্ডের ৭, ৮, ১০, ১৪, ১৬, ২২ ও ২৩নং বেডে ভর্তি রয়েছে ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশু। এদের মধ্যে ২২নং ওয়ার্ডে ভর্তি দেড় বছরের শিশু তাওহিদকে আজ হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেয়া হচ্ছে।
Advertisement
তাওহিদের মা সোনিয়া বলেন, ‘ওকে (তাওহিদ) নিয়ে চারদিন ধরে হাসপাতালে নিদারুণ কষ্ট করেছি। ইট-পাথরের এ শহরে আত্মীয়-স্বজন না থাকায় সহযোগিতা পেতেও বেগ পেতে হয়েছে। স্বামী বেসরকারি চাকরি করায় সহজে ছুটিও মেলেনি। মেয়ের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। স্বাস্থ্য খারাপ হয়েছে, ওজন কমেছে। ওর কষ্ট সহ্যই হচ্ছিল না।’
পাশের দুই বেডে ভর্তি একই পরিবারের দুই শিশু। স্বামী ও দুই সন্তানকে নিয়ে আগারগাঁও ৬০ ফিটের বারেক মোল্লার মোড়ের ভাড়া বাসায় থাকেন দিপা। তিনদিন হলো নয় মাসের শিশু তামিমকে নিয়ে হাসপাতালে মা। এর মধ্যে গতকাল (সোমবার) পাঁচ বছরের শিশু তাসমিয়া আক্তারকেও হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে দিপা বলেন, ‘প্রথমে তামিমের জ্বর আসে ১০২, বেড়ে ১০৪ ডিগ্রি পর্যন্ত পৌঁছায়। খিঁচুনি দিয়ে জ্বর আসে। এটুকু বাচ্চার খিঁচুনি দেখে সইতে পারি না। এর মধ্যে মেয়েটাও অসুস্থ হলো। ডাক্তার-নার্সরা ভালোই দেখভাল করছেন। কিন্তু মন মানছে না। সুস্থ করে কবে ওদের এখান থেকে নিয়ে বাড়ি ফিরব- সেই চিন্তায় আছি এখন।’
শিশু হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ও সহকারী অধ্যাপক ডা. রিজওয়ানুল আহসান জাগো নিউজকে বলেন, ‘জ্বরের রোগী আসলেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। ডেঙ্গু হলে আলাদা বেডে নিয়ে অবজারভেশনে রাখা হচ্ছে। আমাদের এখানে ইমার্জেন্সি সব ধরনের চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে। এখানে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য বিশেষ চিকিৎসক টিম কাজ করছেন। আলাদা ডেঙ্গু সেল গঠন করা হয়েছে। গরীব রোগীদের জন্য নন-পেইং ৬৬৫টি বেড রয়েছে, সেখানেও ডেঙ্গু রোগীদের ভর্তি করা হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সিজনটা খুবই মারাত্মক। সেটা ভেবেই সবার উচিত অসুস্থ হওয়ার আগেই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। সিটি কর্পোরেশনের অপেক্ষায় না থেকে অভিভাবকদের শিশুদের মশা থেকে সুরক্ষার পদক্ষেপ নেয়া উচিত।’
জেইউ/আরএস/এমএআর/পিআর