টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার নাগবাড়ী গ্রামের আ. রশিদ সিদ্দিকী এলাকায় পরিচিত ছিলেন ‘স্কোরার সিদ্দিকী’ হিসেবেও। হকি মাঠে আক্রমণভাগে দুর্বার ছিলেন। প্রতিপক্ষের রক্ষণ তছনছ করে স্কোর (গোল) করায় পারদর্শী ছিলেন বলেই তার নামের সঙ্গে যোগ হয়েছিল ‘স্কোরার’ শব্দটি। তার ছেলে মো. আতাউল হক সিদ্দিকীও জামালপুর সরকারি স্কুলের ছাত্র থাকাকালীন হকি খেলেছেন।
Advertisement
নিজে হকি খেললেও আতাউল হকের তিন সন্তানের (এক ছেলে, দুই মেয়ে) কেউই কখনো হাতে নেননি হকি স্টিক। অথচ তার মেজো কন্যা মোছা. আয়েশা পারভীন মহুয়া কিনা হকিতে করলেন দেশের হয়ে নতুন ইতিহাস! বিএএফ শাহীন কলেজের শারীরিক শিক্ষা বিভাগের সহকারী শিক্ষক মহুয়া এখন দেশের প্রথম নারী হকি আম্পায়ার।
৩৭ বছর বয়সী মহুয়া কিছুদিন আগে সম্পন্ন করেছেন হকি আম্পায়ার কোর্স। মওলানা ভাসানী স্টেডিয়ামে হওয়া এই কোর্সে অংশ নিয়েছিলেন ২২ জন। যার মধ্যে একমাত্র নারী ছিলেন মহুয়া। আম্পায়ার কোর্স ‘সি’ উত্তীর্ণ হয়ে তিনি এখন স্বীকৃত হকি আম্পায়ার। মহুয়ার লক্ষ্য পরবর্তীতে ‘বি’ ও ‘এ’ কোর্স সম্পন্ন করে আন্তর্জাতিক ম্যাচে বাঁশি বাজানো। নিজের লক্ষ্যে অবিচল বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (বিকেএসপি) সাবেক এ শিক্ষার্থী।
কখনোই হকি স্টিক হাতে তোলেননি মহুয়া। তবে ছোট্ট বয়সে দাদার (স্কোরার রশিদ) সঙ্গে বাড়ির উঠানে বাঁশ এবং কাঠ দিয়ে টেনিস বল নিয়ে খেলে মজা করেছেন। হকির সঙ্গে তার পরিচয় বলতে ছিল অতটুকুই। একবার চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে উঠানে খেলতে গিয়ে পায়ে আঘাত পেয়েছিলেন। তারপর ভয়ে হকি খেলার ধারেকাছেও ভেড়েননি মহুয়া। কিন্তু অন্যান্য খেলায় তার আগ্রহ ছিল বেশ।
Advertisement
দৌড়-ঝাপ, ছোটাছুটি। খেলাধুলার প্রতি আগ্রহ দেখেই বাবা মো. আতাউল হক সিদ্দিকী ২০০৪ সালে মেয়েকে ভর্তি করে দেন বিকেএসপিতে অ্যাথলেটিকস বিভাগে। তার প্রিয় ইভেন্টগুলো ছিল ডিসকাস, জ্যাভলিন ও শটপুট। ২০০৫ ও ২০০৬ সালে জাতীয় অ্যাথলেটিকসে অংশ নিয়ে রৌপ্য ও তাম্র পদকও পেয়েছেন তিনি। কেবল অ্যাথলেটিকসেই নয়, আরচারিতেও মহুয়া ছিলেন প্রতিভাবান। খেলতেন হ্যান্ডবল-ভলিবলও। অষ্টম বাংলাদেশ গেমসে আরচারিতে তার স্বর্ণ পদকও আছে। আরচারিতে ২০১৩ সালে তুরস্কে ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপেও ছিলেন বাংলাদেশ দলের সদস্য।
যে খেলাগুলোয় তার সাফল্য আছে এবং জাতীয় দলের জার্সি গায়ে জড়ানোর অভিজ্ঞতা আছে, সে খেলাগুলোর পরিবর্তে মহুয়া ইতিহাস গড়লেন এমন একটি খেলায় যেখানে পুরোপুরিই আনাড়ি ছিলেন তিনি। ছোট্ট বয়সে বাড়ির উঠানে দাদা ও আর চাচাতো ভাইদের সঙ্গে ‘খেলার ছলে খেলা’ ছাড়া আর কোনো অভিজ্ঞতাই ছিল না তার।
কিভাবে সম্ভব হলো এটা? জাগো নিউজের পাঠকদের সেই গল্পই শোনালেন মহুয়া। বললেন, পুরোপারি কৌতুহল থেকেই তার হকি আম্পায়ার হওয়া। ‘তিন বছর হলো বিএএফ শাহীন কলেজে চাকরি করছি। আমাদের কলেজে প্রতি বছরই হয়ে থাকে ইন্টার শাহীন ফাইভ এ সাইড হকি প্রতিযোগিতা। আমাদের কলেজে ফাইভ এ সাইড হকি খেলার মতো অ্যাস্ট্রো টার্ফও আছে। কলেজের শারীরিক শিক্ষক হিসেবে আমাদের টিমটা তৈরি করতে হতো। খেলোয়াড়দের স্কিল ও ফিজিক্যাল ডেভেলপমেন্টের জন্য আমাকে কাজ করতে হতো। আর খেলা পরিচালনার জন্য আম্পায়ার আনা হতো বিমান বাহিনী থেকে’-হকি নিয়ে কাজ করা শুরুর গল্পটা বললেন মহুয়া।
কিন্তু আম্পায়ার হওয়া? ‘বাচ্চাদের প্র্যাকটিস করানোর সময় ভাবলাম ওদের নিয়ম কানুন শেখানোর আগে তো আমাকে সেটা ভালো করে জানতে হবে। দেখলাম হকির নিয়ম-কানুনও বেশ কঠিন। তাই আমার নিজের ধারণা উন্নতি করতে হবে। কেবল একটা বই পড়েইতো হবে না। বিমান বাহিনীর হকি কোচ মো. জাহিদ হোসেন আম্পায়ার হিসেবে খেলা চালিয়েছিলেন। তার কাছে আমি নিয়মগুলো জানার চেষ্টা করেছি। তিনি আমাকে একটা হকির নিয়ম-কানুনের একটা বইও দিয়েছিলেন। আমার আগ্রহ দেখেই তিনি বলেছিলেন ‘আমি হকি ফেডারেশনকে বলে রাখবো, আম্পায়ার কোর্স হলে যেন আপনাকে ডাকে।’ জাতীয় হকি দলের খেলোয়াড় ইমরান হাসান পিন্টু আমার পরিচিত। তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখি। ২/৩ মাস পর কোর্স আয়োজন হয়। আমি অংশ নেই এবং ভালোভাবেই সম্পন্ন করি’-আম্পায়ার হওয়ার কাহিনী বলছিলেন মহুয়া।
Advertisement
আগ্রহ আর কৌতুহল থেকে দেশের প্রথম নারী হকি আম্পায়ার হওয়া মহুয়ার লক্ষ্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাঁশি বাজানো। তার জন্য আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে তাকে। তবে আগামী ৯ সেপ্টেম্বর সিঙ্গাপুরে শুরু হতে যাওয়া জুনিয়র (অনূর্ধ্ব-২১) নারী এএইচএফ কাপে তার জন্য সে সুযোগ আসতেও পারে। এখন নারী হকি দলের সঙ্গে একজন নারী আম্পায়ার থাকা বাধ্যতামূলক করেছেন এশিয়ান হকি ফেডারেশন। তাই ৬ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জুনিয়র নারী হকি দলের সঙ্গে মহুয়াও যাবেন সিঙ্গাপুরে।
তবে সেখানে তিনি বাঁশি বাজাতে পারবেন কিনা তা নির্ভর করছে একটি পরীক্ষার ওপর। সিঙ্গাপুর যাওয়ার পর আয়োজক কমিটি বিপটেস্ট নেবেন মহুয়ার। উত্তীর্ণ হলে এ বছরই তার আন্তর্জাতিক ম্যাচে আম্পায়ারিং করার সুযোগ হতে পারে। বিকেএসসির সাবেক কোচ কাওসার আলীর তত্ত্বাবধানেই হয়েছিল হকি আম্পায়ার কোর্স।
‘আমি কোর্স সম্পন্ন করে ফেডারেশনকে রিপোর্ট দিয়েছি। ফেডারেশন তাদের স্বীকৃতি দিয়েছে কিনা আমি এ মুহুর্তে বলতে পারছি না’-বলছিলেন কাওসার আলী। ফেডারেশনে যোগাযোগ করে জানা গেছে, গত ২৯ জুন অনুষ্ঠিত হকি ফেডারেশনের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় কোর্সে উত্তীর্ণ আম্পায়ারদের গ্রেড ‘সি’ হিসেবে অনুমোদন দিয়েছে।
মহুয়া ২০১০ সালে বিয়ে করেছেন তারই বিকেএসপির সহপাঠি সঙ্গী সোলেমানকে। সঙ্গী সোলেমানের বাড়ী নোয়াখালির মাইজদীতে। প্রেম থেকেই মহুয়া-সঙ্গীর পরিণয়। সঙ্গী সোলেমান বনানী ডিওএইচএস পরিষদের জিম পরিচালক পদে চাকরি করছেন। নিজেকে একজন ক্রীড়াবিদ ও ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব হিসেবে তৈরি করতে মহুয়া সবচেয়ে বড় সপোর্ট পেয়েছেন তার স্বামীর কাজ থেকে।
হকি আম্পায়ারিংয়ের কাজটাকে মহুয়া চ্যালেঞ্জ হিসেবেই নিয়েছেন। নিজের লক্ষ্যের কথা বলতে গিয়ে দেশের প্রথম এই নারী হকি আম্পায়ার বলেছেন, ‘কৌতুহল ও আগ্রহ থেকেই আমি এ পর্যন্ত এসেছি। পেশাগত জীবন, ঘর-সংসার সামলিয়ে এ পর্যন্ত পৌঁছতে আমাকে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। আমি ঘর থেকে যেমন সহযোগিতা পেয়েছি এবং পাচ্ছি তেমন পাচ্ছি আমার চাকরিস্থল থেকেও। সবার কাছেই আমি কৃতজ্ঞ। আমি একজন নারী এবং বিবাহিত। সব কিছুই আমাকে করতে হচ্ছে। এ অর্জন কেবল ধরে রাখতেই নয়, আমি চেষ্টা করবো এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের সুনাম বৃদ্ধি করতে।’
আরআই/এমএমআর/এমএস