মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক প্রিয়া সাহা ওরফে প্রিয়া বালা বিশ্বাসের বক্তব্যে সরকার বিব্রত ও ক্ষুব্ধ। তবে প্রতিক্রিয়া প্রকাশে ধীর নীতি অবলম্বন করছে সরকার।
Advertisement
সরকারের একাধিক সিনিয়র মন্ত্রী (স্বরাষ্ট্র, তথ্য, আইন ও গণপূর্ত) এ ঘটনায় প্রতিক্রিয়া ব্যক্তকালে ধীরস্থির থেকে বলেছেন, প্রিয়া সাহা দেশের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করেছেন। তার কারণে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। তিনি দেশে ফিরলে কী কারণে এ কথা বলেছেন তা বলা যাবে।
তবে প্রতিক্রিয়া প্রকাশে সরকারের মন্ত্রীরা ধীর নীতি অবলম্বন করলেও প্রিয়া সাহা ও তার চার পুরুষ সম্পর্কে গ্রাম ও শহরে ঝড়োগতিতে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে।
প্রিয়া সাহা কে, তার পৈতৃক ও বৈবাহিক সূত্রে নাম-পরিচয়, তার এনজিও, স্বামীর চাকরি, সন্তান কে কোথায় রয়েছেন, সম্প্রতি আমেরিকা সফরের আগে-পরে কাদের সঙ্গে কথাবার্তা হয়েছে সে সব খতিয়ে দেখছে পুলিশসহ একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। বিশেষ করে এমন দেশদ্রোহী বক্তব্যের নেপথ্যে আমেরিকা ও বাংলাদেশে অবস্থানকারী প্রভাবশালী কোনো এক বা একাধিক ব্যক্তির ইন্ধন রয়েছে কিনা-তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বিশেষ করে আমেরিকায় পাড়ি জমানো সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা ও নোবেল জয়ী ড. মুহম্মদ ইউনূসসহ বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তির কোনো ধরনের ইন্ধন রয়েছে কিনা- তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
Advertisement
সচিবালয়ে রোববার (২১ জুলাই) একাধিক মন্ত্রীর বক্তব্যে এমন ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।
দুপুরে সচিবালয়ে নিজ দফতরে আয়োজিত প্রেস ব্রিফিংয়ে গণপূর্ত ও গৃহায়নমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শ. ম. রেজাউল করিম জানান, প্রিয়া বালা সাহা তার নির্বাচনী এলাকার হলেও তার সেখানে কোনো ঘরবাড়ি ও সম্পত্তি নেই। তিনি বলেন, ওই এলাকায় হিন্দু, মুসলমান ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিরাজ করছে।
এদিকে তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ দুপুরে তার দফতরে আয়োজিত প্রেস ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘প্রচলিত আইন অনুসারে স্বামীর অপরাধে স্ত্রী বা স্ত্রীর অপরাধে স্বামী অভিযুক্ত হন না। কিন্তু দেশবিরোধী কথাবার্তা কেউ বললে সে সম্পর্কে স্বামী বা স্ত্রীকে প্রশ্নের মুখোমুখি স্বাভাবিকভাবেই হতে হয়।’
প্রিয়া বালা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘তিনি ভিসা নিয়ে সে দেশে গেছেন, নিশ্চয় তিনি ফিরে আসবেন এবং সব প্রশ্নের জবাব দেবেন।’
Advertisement
কে এই প্রিয়া সাহা
প্রিয়া বালা বিশ্বাসের বাবার নাম নগেন্দ্র নাথ বিশ্বাস। পিরোজপুর জেলার নাজির উপজেলার মাটিভাঙ্গা ইউনিয়নের চরবানিয়া গ্রামে তার বাবার বাড়ি। বৈবাহিক সূত্রে তিনি যশোরের বাসিন্দা। তিনি বাবার বাড়ি চরবানিয়া গ্রামে বসবাস করেন না। এ গ্রামে তার নিজস্ব কোনো বাড়িঘর বা সম্পদও নেই। গ্রামে তার বাবার (নগেন্দ্র নাথের) পৈতৃক সম্পত্তি ও ভাইদের সম্পত্তি রয়েছে।
ভাই যগদীশ চন্দ্র বিশ্বাস একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। বাড়িতে কেউ থাকেন না। তাদের একটি পরিত্যক্ত ঘরে গত ২ মার্চ রাতে আগুন লাগে। ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে যগদীশ বিশ্বাসের কেয়ারটেকার কমলেশ বিশ্বাস নাজিরপুর থানায় ৩ মার্চ মামলা করেন। মামলায় কোনো ব্যক্তির নাম উল্লেখ না করে অজ্ঞাত ৫০-৬০ জনকে আসামি করা হয়। এজাহারে কোনো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার বা কোনো মৌলবাদী গোষ্ঠী বা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এ ঘটনা ঘটিয়েছে তা উল্লেখ করা হয়নি। ওই এলাকায় নদীতে জেগে ওঠা চরের মালিকানা নিয়ে বহু বছর ধরে মামলা-মোকদ্দমা রয়েছে। সম্প্রতি কমলেশ বিশ্বাস চরের জমি-সংক্রান্ত একটি মারামারির ঘটনায় হিন্দু ও মুসলমানসহ এলাকার কয়েকজনকে আসামি করে থানায় মামলা করেন। মামলাটি তদন্তাধীন বলে জানা গেছে।
নিজ থেকে নাকি কারও ইন্ধনে ট্রাম্পের কাছে অভিযোগ
রাজধানীসহ সারাদেশে প্রিয়া বালার বক্তব্য নিয়ে আলোচনা সমালোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। গ্রামের টংঘরের চা দোকান থেকে সচিবালয়ের মন্ত্রী, সচিবসহ সাধারণ মানুষের মুখে মুখে একটাই কথা প্রিয়া বালা কি নিজে থেকেই এত বড় ডাহা মিথ্যা কথা বলেছেন নাকি কারও ইন্ধনে এমন কথা বলেছেন। সবাই বলছেন, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে এমন গুরুতর অভিযোগ কেউ কখনও করেননি। প্রিয়া বালা বিশ্বাসের স্বামী দুদকের একজন কর্মকর্তা। তিনি কেন এমন কথা বললেন তা নিয়ে অনেকেই চিন্তিত ও জানতে আগ্রহী।
সরকারের প্রতি রুষ্ট কিংবা সরকারের ক্ষতি চায় এমন প্রভাবশালী কারও মদদে প্রিয়া বালা এমন অভিযোগ করেছেন কিনা-তা নিয়ে নানা কথাবার্তা হচ্ছে। বিশেষ করে সরকারের একাধিক মন্ত্রী ও সচিবের মুখে সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা ও নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নাম এসেছে। কিন্তু প্রকাশ্যে কেউ তা বলতি রাজি হননি। সরকার এ বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরত্বের সঙ্গে বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে প্রকৃত কারণ খুঁজে দেখার চেষ্টা করছে।
দুই মেয়েকে আমেরিকায় পড়ানোর অর্থের উৎস
জানা গেছে প্রিয়া বালার দুই মেয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশুনা করছেন। প্রিয়া বালা একটি এনজিও চালান। সম্প্রতি একটি পত্রিকার ডিক্লারেশনও নিয়েছেন। তার স্বামী দুদকের একজন কর্মকর্তা। এ দু’জনের আয়ে দুই মেয়েকে আমেরিকায় রেখে পড়াশুনা সম্ভব কিনা, তারা কতদিন যাবত পড়াশুনা করছেন, কত টাকা খরচ হচ্ছে এ টাকার উৎস কী ইত্যাদি সম্পর্কে খোঁজ খবর নেয়া হচ্ছে।
গত ১৬ জুলাই ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার ২৭ ব্যক্তির সঙ্গে বৈঠক করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সেখানে ১৬ দেশের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন। বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক প্রিয়া সাহাও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পান।
বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের নেতা প্রিয়া সাহা মার্কিন প্রেসিডেন্টকে বলেন, ‘আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। বাংলাদেশে ৩ কোটি ৭০ লাখ হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান নিখোঁজ রয়েছেন। দয়া করে আমাদের লোকজনকে সহায়তা করুন। আমরা আমাদের দেশে থাকতে চাই।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখন সেখানে ১ কোটি ৮০ লাখ সংখ্যালঘু রয়েছে। আমরা আমাদের বাড়িঘর খুইয়েছি। তারা আমাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে, তারা আমাদের ভূমি দখল করে নিয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো বিচার পাইনি।’
প্রিয়া সাহার এ বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে সারাদেশে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। প্রিয়া সাহার বক্তব্য এখন টক অব দ্যা কান্ট্রি।
এমইউ/এনডিএস/পিআর