প্রিয়া সাহা, বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক অশান্তি তৈরির মতো উস্কানি দিয়ে আলোচনায় এসেছেন সম্প্রতি। সব সম্প্রদায় ও ধর্মাবলম্বী মানুষের মধ্যে আতঙ্ক তৈরিই শুধু নয়, সংখ্যাগুরু মুসলমানদের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকেও উৎসাহ জুগিয়েছে তার এই বক্তব্য। তারপরও প্রিয়ার অভিযোগকে সমর্থন করার সুযোগ যেমন আমাদের নেই আবার তার বক্তব্যের প্রাসঙ্গিকতাকে উড়িয়ে দেওয়ার শক্তিও কম আমাদের।
Advertisement
বাংলাদেশের অখ্যাত একজন নারী হঠাৎ করে এভাবে আলোচনায় আসার ক্ষেত্রটা সুদূর আমেরিকা। আর আয়োজনটাও যেমন তেমন নয়। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, ১৬টি দেশের সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিকে দাওয়াত করেছেন তার দরবারে। উদ্দেশ্য সংখ্যালঘুরা যে নিপীড়িত সেই কথা তাদের মুখ থেকে শুনবেন। আপাতদৃষ্টে বিষয়টি দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতো।
মনে হতেই পারে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সংখ্যালঘুদের প্রতি খুবই উদার। কিন্তু যে মুহূর্তে আমেরিকাতে এই সম্মিলন হলো তখন নিজের দেশের কৃষ্ণাঙ্গ আইনপ্রণেতাদের প্রতি বিরূপ মন্তব্য করে তিনি ব্যাপক সমালোচিত হয়েছেন। অভিভাসী আমেরিকান ৪ জন কৃষ্ণাঙ্গ কংগ্রেস সদস্যকে নিজ দেশে ফিরে যেতে বললেন তিনি। ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানদের মধ্যে বাহাস শুরু হয় এ নিয়ে। বর্ণবাদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে তাকে আখ্যায়িত করেছে তার দেশেরই মানুষ। সেই প্রেসিডেন্ট যখন সংখ্যালঘুদের কাছ থেকে তাদের নির্যাতনের কথা শোনার জন্য আমেরিকায় ডেকে নিয়ে যান তখন অবাক হওয়ার মতোই মনে হতে পারে।
হয়তো ভালো চিন্তা করেই বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ সেদেশে একটি প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছে। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোলপাড় সৃষ্টি হলে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতা অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত জানালেন, প্রিয়া সাহাকে তারা পাঠাননি। অর্থাৎ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের প্রতিনিধিত্ব করেননি প্রিয়া সাহা। যদিও ঐক্য পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক হলেন প্রিয়া সাহা। অন্যদিকে প্রিয়া সাহা নিজেকে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবেই পরিচয় দিয়েছেন। বলেছেন- স্যার আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি।
Advertisement
রানা দাশগুপ্ত বলেছেন, প্রিয়া সাহার দেওয়া বক্তব্য হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান পরিষদের নয়- এটা তার ব্যক্তিগত মতামত। প্রশ্ন হচ্ছে- কোনো সংগঠনের কোনো সদস্য যদি দেশের জন্য ক্ষতিকর এবং মিথ্যাচার করে, তাহলে সেই সংগঠন থেকে তাকে বহিষ্কার করা কিংবা তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। তারা কি সেরকম কোনো ব্যবস্থা নিয়েছেন? ২০ জুলাই সন্ধ্যা পর্যন্ত তেমন কোনো সংবাদ পাওয়া যায়নি। তাহলে প্রশ্ন আসে, ঐক্য পরিষদ কি প্রিয়া সাহার কথিত বক্তব্যকে নীরবে সমর্থন করছেন? যদি সমর্থন না করেন তাহলে নিশ্চয়ই তারা এই বিষয়ে বিবৃতি মাধ্যমে স্পষ্ট করবেন।
প্রিয়া সাহা বলেছেন, মুসলিম মৌলবাদী গ্রুপ তার বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে, তাদের জমি-জিরেত দখল করে নিয়েছে এবং মৌলবাদীরা সবসময়ই রাজনৈতিক প্রশ্রয় পেয়ে এই নির্যাতন চালিয়ে আসছে। তার মানে হচ্ছে, তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের ১ কোটি ৮০ লাখ সংখ্যালঘুর বাড়িঘরের সঙ্গে তার বাড়িঘরও পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ শনিবারই বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচার হয়েছে, প্রিয়া সাহার পিরোজপুরের বাড়ি অক্ষত আছে। শুধু তাই নয়, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতাদের কারো বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এমন তথ্যও আজ পর্যন্ত জানা যায়নি।
প্রশ্ন হচ্ছে, প্রিয়া সাহা এমনতর বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ পেলো কিভাবে? এর কোনো যোগসূত্রই কি নেই? ক্ষেত্র পরিবেশ এবং দেশের কথা বিবেচনা করে তার এমন বক্তব্য অবশ্যই দেশদ্রোহিতার শামিল এটা স্বীকার করেই বলতে হয়- প্রশাসনের কিছু ব্যর্থতাও যে কাউকে এমনতর গর্হিত কাজে প্ররোচিত করতে পারে। সেইজন্য আমাদের পেছনে তাকাতে হবে। রামু, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নড়াইলসহ আরো কিছু জায়গায় সংখ্যালঘুদের উপর পরিকল্পিত আক্রমণ হয়েছে। একইভাবে মাঝে মাঝেই সংবাদ হয় মন্দির ভাঙ্গার, মূর্তি ভাঙ্গার। কই অপরাধীদের শাস্তির সংবাদ তো হয় না? সুতরাং প্রিয়ার বক্তব্যকে বাড়াবাড়ি হিসেবে ধরে নিলেও অভিযোগগুলোর পরিবেশ সৃষ্টিতেও যে রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা কাজ করেছে তাও আমাদের মনে রাখতে হবে।
তাহলে প্রিয়াকে কোন কারণে আমরা কাঠগড়ায় দাঁড় করাবো? প্রথম কথা হচ্ছে- তিনি একবারও ভাবেননি তার অভিযোগের কারণে তার সম্প্রদায়, তার দেশ কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যদিও তিনি মনগড়া পরিসংখ্যান দিয়ে ট্রাম্প এর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হলেও বাংলাদেশে নিয়োজিত যুক্তরাষ্ট্রের নিয়োজিত রাষ্ট্রদূত দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানিয়ে দিলেন, প্রিয়া সাহা মিথ্যাচার করেছে। এই মিথ্যাচার মাধ্যমে তিনি ব্যক্তিগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এখানকার সংখ্যালঘুরা। সবচেয়ে বড় ক্ষতি হচ্ছে- এই মিথ্যাচারে উৎসাহিত হবে এখানকার মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক শক্তি।
Advertisement
যারা মনে করবে- এখন সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার করলেও পার পাওয়া যাবে। সত্যিটাও মিথ্যা হিসেবে পরিচিতি পাবে। ফলে প্রিয়া সাহার এই বক্তব্যকে যতটা সংখ্যালঘুদের স্বার্থে হয়েছে বলা যায় তারচেয়ে বেশি স্বার্থ উদ্ধার করবে দেশের সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী শক্তির। অথচ বাংলাদেশের অবস্থা হচ্ছে, সংখ্যালঘুরা বছর দশেক আগেও অবর্ণনীয় নির্যাতনের শিকার হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই পরিস্থিতি কি ধীরে ধীরে পরিবর্তন হয়নি? আবারো বলছি- সংখ্যালঘুদের নির্যাতন কিন্তু আছে। প্রশ্ন হচ্ছে- পরিস্থিতি সুপরিবর্তন হচ্ছে কিনা? নির্যাতন ক্রমহ্রাসমান কি না?
বাংলাদেশের সংবিধানের মৌলিক ধারা ধর্মনিরপেক্ষতা। এটি ভূলুণ্ঠিত হয়েছিলো একসময়। সংখ্যালঘুরা সাংবিধানিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত ছিলো। যোগ্যতা থাকার পরও তাদের মূল্যায়ন করা হতো না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়- বাংলাদেশ সরকারের সচিব পর্যায়ের কোনো কর্মকর্তা মুসলমানদের বাইরে ছিলো না। সাম্প্রতিক সময় এই প্রবণতাকে ঝেরে ফেলা হয়েছে।
যোগ্যতা থাকলে হিন্দু কিংবা মুসলমান বিচার করা হচ্ছে না। যে কারণে ডিএস থেকে সচিব পর্যন্ত সব পদেই সব ধর্মের মানুষকে এখন চাকরি করতে দেখা যায়। যা সাংবিধানিক অধিকার বলে তারা প্রাপ্য। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সরকারের সহযোগিতাও আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। আইনগত কিছু প্রতিবন্ধকতা দূরিকরণেও এগিয়ে গেছে দেশ। মসজিদভিত্তিক মক্তব যেমন চালু আছে তেমনি মন্দিরভিত্তিক শিক্ষাও চালু হয়েছে। এগুলো অগ্রগতির কিছু দিক।
এমন সময় প্রিয়ার এই ঘটনা যে কতটা উস্কানিমূলক তার প্রমাণ পাওয়া যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। পক্ষে-বিপক্ষে বক্তব্যগুলো রীতিমতো আতঙ্ক ছড়ানোর মতো। স্পষ্টত দুটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে গেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীরা। কেউ প্রিয়ার বক্তব্যকে সমর্থন করছে কেউ তুলোধূনো করছে প্রিয়াকে। আর চরম সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী তাদের স্বভাবগত আচরণে মেতে উঠেছে। প্রতিক্রিয়াগুলো দেখে স্পষ্ট বোঝা যায়- প্রিয়া সাহার এই বক্তব্য দেশে একটি অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি করতে সহায়তা করেছে। এর সূত্র ধরে মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী যদি তাদের স্বভাবজাত অনাচার বাড়িয়ে দেয় এতে করে কি সংখ্যালঘুরা আরো বিপদগ্রস্ত হবে না?
প্রিয়া সাহার অনিষ্টকর বক্তব্যকে প্রতিবাদ করার ১০১টা যুক্তি খাঁড়া করাতে পারলেও আমাদের দায়ও কিন্তু রয়ে গেছে। তার এই বক্তব্য রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল সেটাও সরকারি মহল থেকে বলা হচ্ছে। কিন্তু আমাদের জবাব দিতে হবে- আগে পরে যতগুলো সাম্প্রদায়িক অপরাধ সংগঠিত হয়েছে, সেগুলোর বিচার হয়নি কেন? অধিকাংশ অপরাধইতো দৃশ্যমান। কিছু অপরাধীর অপরাধতো প্রমাণও হয়েছে। সেই অপরাধীদের শাস্তি আমরা দিতে পারিনি। আর এসব কারণেই যদি বাইরের কোনো শক্তি প্রিয়াকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে থাকে সেটা কি অসম্ভব বলে গণ্য হবে?
আমি ভাবতে চাই, প্রিয়া সাহা নিছক ব্যক্তি স্বার্থ উদ্ধারে এমন গর্হিত কাজটি করেছে। তবে তার পেছনে গভীর কোনো ষড়যন্ত্র থাকতে পারে। যেখানে দেশের ভিতরের কিংবা বাইরের কোনো চক্র জড়িত আছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, প্রিয়া সাহা দেশে এলে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। খুব ভালো কথা, প্রিয়া সাহা কি ফিরে আসবেন? নাকি না আসার জন্যই তিনি সেখানে গিয়েছেন? যাতে করে কারো দেওয়া অ্যাসাইনমেন্ট সম্পন্ন করতে পারেন? কিংবা অন্যকিছু? এটা বের করতে হবে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষকেই। না হলে আরো প্রিয়া সাহার জন্ম হওয়ার সম্ভাবনাই বেড়ে যাবে।
লেখক : সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক।
এইচআর/এমএস