জাতীয়

সুদীপ্ত হত্যা : অবশেষে জানা গেল সেই বড় ভাইয়ের নাম

চট্টগ্রামের ছাত্রলীগ নেতা সুদীপ্ত বিশ্বাসকে হত্যা করা হয়েছিল তার দলেরই এক বড় ভাইয়ের নির্দেশে। গত দুই বছরে এতুটুকুই জানতে পেরেছিল আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। শুক্রবার (১৮ জুলাই) মিজানুর রহমান নামে এক আসামির আদালতে দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে উঠে এসেছে সেই বড় ভাইয়ের নাম। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার জাহানের আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে আসামি মিজানুর রহমান জানিয়েছেন, সুদীপ্ত হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন লালখান বাজার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক দিদারুল আলম মাসুম। যিনি ঘটনার আগের দিন আরেক আসামি আইনুল কাদের নিপুকে দুই ঘণ্টার ভেতর কাজ শেষ করে, পুরো ঘটনা ভিডিও করে আনার নির্দেশ দেন।

Advertisement

২০১৭ সালের ৬ অক্টোবর ভোরে চট্টগ্রাম নগরের সদরঘাট থানাধীন নালাপাড়ার বাসায় হানা দিয়ে সুদীপ্তকে ঘুম থেকে তুলে টেনেহিঁচড়ে বাইরে নিয়ে আসে সেই বড় ভাইয়ের নিয়ন্ত্রণে থাকা ছাত্রলীগ ও যুবলীগ কর্মীরা। এরপর সেখানেই তাকে বেদম পিটিয়ে গুরুতর আহত করা হয়। পরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে সুদীপ্তকে মৃত ঘোষণা করা হয়।

পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) জানায়, চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক সুদীপ্ত বিশ্বাসকে পিটিয়ে হত্যার ধারণ করা ভিডিও ও মামলার কেস ডকেট ধরে জড়িতদের চিহ্নিত করার কাজ শেষ হয়েছে। এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত ‘কথিত’ বড় ভাইসহ ১৫-১৬ জনের নাম এসেছে। শুক্রবার মামলার অন্যতম আসামি মিজানুর রহমান সুদীপ্ত বিশ্বাসকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারীর নাম প্রথমবারের মতো প্রকাশ করেছেন।

আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে আসামি মিজানুর রহমান নিজেকে লালখান বাজার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক দিদারুল আলম মাসুমের ‘রাজনৈতিক কর্মী’ বলে পরিচয় দেন। মিজান আদালতকে জানান, ঘটনার আগের দিন (২০১৭ সালের ৫ অক্টোবর) রাত ১০টা-সাড়ে ১০টার দিকে তিনি মতিঝর্ণা এলাকায় একটি টং দোকানে বসে চা খাচ্ছিলেন। এ সময় পিচ্চি হানিফ এসে তাকে বলেন, ‘মাসুম ভাইয়ের অফিসে কাজ আছে, চল আমার সাথে।’ পরে তারা দুজন মাসুমের অফিসে যান।

Advertisement

অফিসের যাওয়ার পর মিজান মাসুমের অফিসের বাইরে একটি বেঞ্চিতে বসেছিলেন। ৩০ মিনিট পর অফিস রুম থেকে বের হন মাসুম, নিপু, ওয়াসিম ও পিচ্চি হানিফ। এ সময় মাসুম তার কাছে জানতে চায় সে ভাত খেয়েছে কি না। পরে মাসুম মিজানকে বলেন, ‘আগামীকাল সকাল ৬টার মধ্যে লালখান বাজার কর্নেল হোটেল মোড়ে চলে আসবি, কাজ আছে। নিপুদের সাথে যাবি।’

ঘটনা ৮টার মধ্যে শেষ করবি, আমি ঘুমাতে যাব

মিজান আদালতকে জানান, ঘটনার আগের দিন (২০১৭ সালের ৫ অক্টোবর) রাতে ছাত্রলীগ নেতা আইনুল কাদের নিপু দিদারুল আলম মাসুমের অফিস থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় মাসুম নিপুকে বলছিল, ‘ঘটনাটা সকাল ৬-৮টার মধ্যে শেষ করবি। ৮টার পর আমি ঘুমাতে যাব।’

মাসুম নিপুকে আরও বলেন, ‘ঘটনাটা মোক্তারকে ভিডিও করে আনতে বলবি, আমি দেখব।’ যখন মাসুম নিপুকে কথাগুলো বলছিল মিজান তাদের ২-৩ হাত পেছনে ছিলেন। ওয়াসিম, হানিফ তার সামনে দিয়ে হাঁটছিল।

Advertisement

মিজান আদালতকে জানান, পরদিন ৬ অক্টোবর ভোর ৬টা থেকে ৬টা ২০ এর মধ্যে মিজানুর লালখান বাজার এলাকার কর্নেল হোটেল মোড়ে চলে যান। সেখানে নিপু, ওয়াসিম, পিচ্চি হানিফ ও মোক্তারকে একটি বেঞ্চিতে বসে থাকতে দেখেন। এছাড়া লাল গেঞ্জি পরিহিত জাহেদকে একটি মোটরসাইকেলের ওপর বসে থাকতে দেখেন। ওখানে ১০-১২টা সিএনজি অটোরিকশা দাঁড়ানো ছিল। সেগুলোতে ৪০-৫০ জন ‘রাজনৈতিক কর্মী’ বসা ছিল। এদের মধ্যে নওশাদ, তার ভাই আরমান, পাপ্পু, বাপ্পী, খায়ের ও বাবু ছাড়া অন্য কাউকে তিনি চিনতেন না। এ সময় ছাত্রলীগ নেতা নিপু তাকে একটা সিএনজি অটোরিকশায় তুলে দিয়ে বলে, ‘তুই এদের সাথে যা। আমার নির্দেশ ছাড়া কেউ সিএনজি থেকে বের হবি না। সবাইকে যার যার দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে।’

তিনি আরও জানান, ঘটনার দিন সকাল ৬টা ৪০ মিনিটের দিকে ঘটনাস্থল নালাপাড়ায় গলির একটু ভেতরে গিয়ে তারা অবস্থান নেন। নিপু তাদের সিএনজিগুলো ঘুরিয়ে রাখতে বলেন।

মিজান আদালতকে বলেন, ‘হঠাৎ দেখতে পাই আমার সামনের ও পেছনের সিএনজিগুলো থেকে ৬/৭ জন ছেলে লোহার রড ও পাইপ নিয়ে গলির ভেতর দৌড়ে যাচ্ছে। নওশাদের ভাই আরমান আমাদের সিএনজির সামনে এসে বলে, আমাকে পাইপটা দে। আমাদের সিএনজিতে দুই থেকে আড়াই ফুট লম্বা একটি লোহার পাইপ ছিল। পাইপ যে ছিল, তা আমি জানতাম না। আমি সিএনজির পেছন থেকে পাইপটা বের করে আরমানের হাতে দেই। ২/৩ মিনিট পর হট্টগোলের শব্দ এবং এক রাউন্ড ফাঁকা গুলির শব্দ শুনি। ২-৩ মিনিটের মধ্যে নিপু, খায়ের, ওয়াসিম, মোক্তার, পিচ্চি হানিফ, বাবু, বাপ্পী, নওশাদ, আরমান, পাপ্পুকে দৌড়ে গলির ভেতর থেকে বের হয়ে আসতে দেখি।’

মিজান জানান, ঘটনার পরপরই তারা সবাই সিএনজিতে লালখান বাজার মোড়ে এসে যে যার মতো চলে যায়। সেদিন দুপুরে টিভিতে খবর দেখে বুঝতে পারি তাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সুদীপ্তকে মারার জন্য। সে সুদীপ্তকে আগে থেকে চিনত না। টিভিতে খবর দেখেই প্রথমবারের মতো সুদীপ্ত সম্পর্কে জেনেছিল।

প্রসঙ্গত, এর আগে সুদীপ্ত খুনের ঘটনায় আদালতে ফয়সল আহমেদ ওরফে পাপ্পু এবং মোক্তার হোসেন ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে জানান একজন বড় ভাইয়ের নির্দেশে এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়। অন্য এক আসামির কল রেকর্ড থেকেও বড় ভাইয়ের নাম পাওয়া গিয়েছিল।

আবু আজাদ/জেএইচ/এমএস