মতামত

যৌন নিপীড়ক শিক্ষক : শিশুরা রক্ষা পাবে কী করে?

"শিশুর জন্য ভালোবাসা কর কি তোমরা অনুভবচাই বাধা-বন্ধনমুক্ত, আনন্দময় শৈশব"।

Advertisement

শিশুর এই চাওয়া কি এখনকার পারিবারিক ও সামাজিক বাস্তবতায় পুরোপুরি পূরণ হচ্ছে? শিশুর জন্য আনন্দময় ও নিরাপদ আশ্রয়স্থল শিক্ষাঙ্গন। হোক সেটা স্কুল কিংবা মাদ্রাসা। শিশুদের এই প্রিয় প্রাঙ্গন যখন ভীতিকর হয়ে উঠে, তখন আর সেখানে পড়াশোনা তো দূরে থাক খেলাধুলার জন্যও প্রাণোচ্ছ্বাস পায় না তারা।

শিশুরা প্রতিমুহূর্ত পার করে বিভীষিকাময় এক ঘোরের মধ্য দিয়ে। একটা সময় ছিল, যখন শিশুরা স্কুল-মাদ্রাসা-মক্তবের পড়াশোনা ঠিকমতো না করলে বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিয়ম-নীতিবহির্ভূত কাজ করলে শিক্ষকরা বকাঝকা ও মারধোর করতেন। বিষয়টা যদি নিছক শাসনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতো তাহলে কথা ছিল না। একটা পর্যায়ে শাসনটাও হয়ে উঠছিল বাড়াবাড়ি পর্যায়ের। অনেক শিক্ষার্থী মারধোরের ভয়ে স্কুলে যেতো না। মূলত: সরকারের হস্তক্ষেপেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে অযাচিত শাস্তি দেয়া বন্ধ হলো।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শুরু হলো আরেক অত্যাচার। পিতৃতুল্য শিক্ষকদের হাতেই যৌন নির্যাতনসহ নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হচ্ছে কোমলমতি শিশুরা। কিশোরী, তরুণী শিক্ষার্থীরা তো হেনস্তা হচ্ছেই। ২০১১ সালের ২৮ জুলাই ভিকারুননিসা নূন স্কুলের বসুন্ধরা শাখার শিক্ষক পরিমল জয়ধর এক ছাত্রীকে ধর্ষণের দায়ে এখনও জেলে। এখন ২০১৯ সাল। গত আট বছরে কি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি বা ধর্ষণ থেমেছে?

Advertisement

সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনা প্রবাহে দৃষ্টি দিলেই এর উত্তর মিলে। গত ২৭ জুন নারায়ণঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে অক্সফোর্ড হাইস্কুলে ছাত্রীদের সাথে প্রতারণা ও ধর্ষণের অভিযোগে আশরাফুল আরিফ নামের এক শিক্ষককে আটক করে র‌্যাব। তাকে মদদ দেয়ার অপরাধে প্রধান শিক্ষককে আটক করা হয়। শিক্ষক আশরাফুল আরিফ প্রায় চার বছর ধরে পঞ্চম শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণীর বেশ কয়েকজন ছাত্রীকে ফাঁদে ফেলে শারীরিক সম্পর্ক তৈরি করে এর ভিডিও ধারণ করতো। এরপর সেই ভিডিও দেখিয়ে ওই ছাত্রীদের মায়েদের জিম্মি করে তাদের সাথেও যৌনাচার এবং মোটা অংকের অর্থ আদায় করতো। এর প্রমাণও পেয়েছে র‌্যাব।

প্রশ্ন জাগে, এরা কি শিক্ষক! না বিকৃত রুচির মানুষরূপী পিচাশ!! সিদ্ধিরগঞ্জের এই ধর্ষণের ঘটনার সপ্তাহখানেক পরই জানা গেল জেলার ফতুল্লার একটি মাদ্রাসার কথা। যেখানে ১২ শিশু ছাত্রীকে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির অভিযোগে প্রধান শিক্ষক মাওলানা আল আমিনকে আটক করে র‌্যাব। আল আমিনের বিরুদ্ধে দু'টি মামলা হয়েছে। আগের ঘটনায় আশরাফুল আরিফও দুই মামলায় বিচারের কাঠগড়ায় আছে।

কিন্তু এসব খবরে কি সেই সব শিক্ষকরূপী ধর্ষকরা গা ঢাকা দিয়েছে, না সুবোধ বালক হয়ে পবিত্র পেশা শিক্ষকতায় নিজেকে নতুন করে সঁপে দিয়েছে। এই তো কয়েকদিন আগে, গত ২ জুলাই বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জে মাদ্রাসার এক শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায়ও তিনজনকে আটক করে পুলিশ। কিন্তু তাতে কি?

বাগেরহাটের এই ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের একদিন পরই, রাজধানী ঢাকার ধামরাই উপজেলায় এক মাদ্রাসার ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রীকে অপহরণের পর ধর্ষণের অভিযোগে একজনকে আটক করা হয়। এইসব ধর্ষকের বিরুদ্ধে মামলা, গ্রেফতার চলছে, কিন্তু ধর্ষণের ঘটনা কি থামছে? চুরি, আবার শিনাজুড়ি-র মতোই, একে তো বিকৃত লালসা চরিতার্থ করতে ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হয় না মুখোশধারী গুটিকয় পশু, কখনো কখনো নিজের দোষ ঢাকতে খুনও করে নিষ্পাপ শিশুদের।

Advertisement

এইসব যৌন নিপীড়করা শিক্ষকতার পবিত্র পেশাকে কলঙ্কিত করে, ন্যক্কারজনকভাবে দর্প নিয়ে সমাজে ঘুরে বেড়ায় ভদ্র মোড়কে। কিন্তু যখন ধরা পড়ে তখনও তাদের দর্পচূর্ণ হয় না এতটুকু। দুনিয়া জুড়েই আমরা জানি, মানুষ গড়ার অন্যতম কারিগর শিক্ষক এবং পরিবারের পর সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। আর সেই নিরাপদ আশ্রয়স্থলের প্রধান রক্ষক শিক্ষকরাই যদি শিশুদের শরীর-মন ভক্ষণের মধ্য দিয়ে তাদের নিঃশেষ করে দেয়, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে আমাদের স্থান হবে কোথায়?

স্বভাবতই বিবেকবানদের মনে প্রশ্ন উঁকি দেবে, কি সমাজ, রাষ্ট্র তৈরি করছি আমরা ভবিষ্যতের জন্য! কি শিক্ষা পাচ্ছে বেড়ে উঠা শিশু-কৈশোররা!! শিশুর সুষ্ঠু বিকাশে সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীরা যেখানে বরাবরই বলছেন, সুন্দর, স্বাভাবিক আনন্দময় পরিবেশই শিশুর উন্নত বিকাশ ঘটায়। সেটা হোক শারীরিক কিংবা মানষিক। তাই শিশুর জন্য তার প্রিয় প্রাঙ্গন শিক্ষাঙ্গনসহ প্রতিটি ক্ষেত্র নির্বিঘ্ন করতে সমাজ ও রাষ্ট্রকেই দায় নিতে হবে।

সমাজের এসব কীটগুলোকে সরিয়ে ভালবাসার পরিবেশ তৈরি করতে হবে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম তথা শিশু-কিশোরদের জন্য। সর্বোপরি এ কাজে রাষ্ট্রের পাশাপাশি সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে সচেতন মহলকেও এগিয়ে আসতে হবে। প্রাপ্তি না ঘটলেও প্রত্যাশা নিয়ে প্রতীক্ষার দৃষ্টি রাখি সামনের দিকে।

লেখক : সাংবাদিক, বাংলাভিশন।

এইচআর/এমকেএইচ